উত্তর সুউচ্চ হিমালয় থেকে দক্ষিণে নিবিড় বাদাবনসঙ্কুল বদ্বীপ আর দীর্ঘ উপকূল; পশ্চিমে লালমাটির দেশে শাল-পিয়ালের অরণ্য --– ভারতবর্ষের আর কোনও রাজ্যে নেই পশ্চিমবঙ্গের মতো বাস্তুতন্ত্রে এই বৈচিত্র্য। স্বভাবতই জীব বৈচিত্র্যের নিরিখে দেশের অন্যতম র্শীষে এই রাজ্য। ভৌগোলিক মাপে দেশের স্থলভূমির মাত্র ২.৭% এই রাজ্যের। অথচ গোটা দেশে যে ১০ প্রকারের জীব ভৌগোলিক অঞ্চল রয়েছে তার মধ্যে চার প্রকারের অবস্থান পশ্চিমবঙ্গে। এগুলি হল, হিমালয় পর্বতমালা (মধ্য হিমালয়), গাঙ্গেয় সমভূমি (নিম্ন গাঙ্গেয় উপত্যকা), উপকূল (পূর্ব উপকূল) এবং দাক্ষিণাত্যের মালভূমি (ছোটনাগপুর-পুরুলিয়া, বাঁকুড়া)। এ রাজ্যের বিপুল জীবজগতে রয়েছে প্যালিয়ারটিক, ইন্দোমালয়ান এবং আফ্রোট্রপিক্যাল জীবভৌগোলিক উপাদান।
পশ্চিমবঙ্গের মোট আয়তনের ১৩.৪% জুড়ে বনাঞ্চলে মোট দশ ধরনের অরণ্য দেখা যায় (চ্যাম্পিয়ন ও শেঠ, ১৯৬৮)। এর মধ্যে ৩১.৭৫% মাত্র সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বলা বাহুল্য রাজ্যের মোট পরিসরের খুবই সামান্য বিধিবদ্ধ সংরক্ষণের আওতায়। সংরক্ষিত এলাকার বাইরে যে বিপুল পরিসর তার মধ্যেও ছড়িয়ে আছে প্রাচুর্যময় এক জীবকুল। গ্রামবাংলার আনাচে কানাচে ঝোপঝাড়, পুকুর-ডোবা-খাল বিল বাসভূমি যে জীবজগতের, তাদের অনেকেই আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। বিধিবদ্ধ সংরক্ষণের বাইরেও এদের বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রয়াসের।
সংরক্ষণের আওতায় যে সমস্ত বনাঞ্চল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য-অত্যুচ্চ ও নাতিশীতোষ্ণ বনাঞ্চল, দক্ষিণের শুষ্ক পর্ণমোচী বনাঞ্চল এবং ২,১২৩ কিমি. বিস্তৃত সুন্দরবনের বাদাবন বা ম্যানগ্রোভ। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় সুন্দরবনের জীবকুলের-বদ্বীপের জোয়ার ভাটার তালে তাল মিলিয়ে পর্যায়ক্রমিক মিষ্টি আর নোনা জলে খাপ খাইয়ে জীবনযাপন এদের।
এই রাজ্যে রয়েছে প্রায় ৫৪টি প্রধান (১০০হেঃ) প্রাকৃতিক জলাভূমি। প্রধান এই জলাভূমিগুলি ছাড়াও বাংলার গ্রামে প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বিল আর ঝিল। নানান প্রজাতির মাছ, জলচর পাখি, উদ্ভিদ এবং জীবজগতের বিভিন্ন সদস্যের বিপুল সমারোহ এই জলাভূমিগুলিতে। সরাসরি যে বাস্তুতান্ত্রিক পরিষেবা দিয়ে থাকে এ সব জলাভূমি তার মধ্যে অন্যতম বন্যা এবং জলস্তর নিয়ন্ত্রণ। পৃথিবীর প্রধান প্রধান জলাভূমিগুলিকে ‘রামসর সাইট’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কলকাতা শহরের পূর্ব উপকন্ঠে বিস্তৃত যে ভেড়ি অঞ্চল তা রামসর সাইট হিসাবে চিহ্নিত।
প্রায় ৭০০ প্রজাতির উদ্ভিদ (ব্যাকটেরিয়া সহ) নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জলবায়ু ও উচ্চতায় ছড়িয়ে আছে, এক বিশাল বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদকুল। গুপ্তবীজী (৩৫৮০ প্রজাতির), ব্রায়োফাইট বা মসজাতীয় (৫৫০ প্রজাতির) এবং টেরিডোফাইট বা ফার্নজাতীয় (৪৫০ প্রজাতির) উদ্ভিদকুলের বৈচিত্র উল্লেখ্য। এ ছাড়াও এ রাজ্যে শৈবাল ও ছত্রাকের প্রায় ৮৫০টি প্রজাতির খোঁজ মেলে। এই রাজ্যের স্থানীয় পুষ্পক উদ্ভিদের মধ্যে প্রচুর বহিরাগত ফুলগাছের অন্তর্ভুক্তিকরণ উল্লেখ্য। বেশ কিছু বহিরাগত উদ্ভিদের বাড়বাড়ন্ত দেশীয় উদ্ভিদকুলের সংরক্ষণের সংকট ডেকে আনছে।
উর্বর সুফলা পশ্চিমবঙ্গের কৃষি জীব বৈচিত্র্যও উল্লেখ করার মতো। দুঃখের বিষয়, গত পাঁচ দশকে এই অমূল্য বৈচিত্র্যের অনেকটাই হারিয়ে গেছে। পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী সবুজ বিপ্লবের আগে এ রাজ্যে প্রায় ৪২০০ ধরনের ধান ছিল। এই সব স্থানীয় ধরনের ধান বৈচিত্র্য শত বছরের লোকজ্ঞান নির্ভর পরীক্ষানিরীক্ষার ফসল। স্থানীয় নানান কৃষি বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ একটি জরুরি প্রয়োজন।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতান্ত্রিক বাসস্থানগত সমাবেশ এক বিপুল ও বৈচিত্র্যময় প্রাণীকুলের ধারক। এই রাজ্যে প্রাপ্ত মোট ১১,০০০ প্রজাতির প্রাণী, সমগ্র দেশে প্রাপ্ত মোট প্রজাতির প্রায় ১২%। রয়েছে প্রচুর স্থানীয় প্রজাতির (Endemic Species) প্রাণী যা কেবলমাত্র এই রাজ্যেরই বিশেষ কিছু অঞ্চলে পাওয়া যায়।
জেলাগুলির মধ্যে দার্জিলিং প্রাণী বৈচিত্র্যে শীর্ষস্থান দখল করে (৪,২৮৯ প্রজাতি), আশ্চর্য ভাবে তার পরেই রাজধানী কলকাতার স্থান (২,৫৫৩ প্রজাতি)।
সুন্দরবন তার ব্যাপক জীব বৈচিত্র্যের কারণে (প্রায় ১,১০০-১,৫০০ প্রজাতি) ও জীবকুলের স্বতন্ত্রতায় এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এই ব-দ্বীপাঞ্চলের স্থানীয় অমেরুদণ্ডী কাঁকড়া বা King crab (Carcinocorpius rotandicauda ও Tachypleusgigus) প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছে। এ ছাড়াও সুন্দরবন বনাঞ্চলের বিপুল মেরুদণ্ডী প্রাণী বৈচিত্র্যেও লক্ষণীয়। এ অঞ্চল প্রায় ১৪১ প্রজাতির মাছ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৫৭ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬১ প্রজাতির পাখি ও ৪০টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আবাসস্থল। সুন্দরবনের প্রাণীকুলের বর্ণনা ‘বাদাবনের বাঘ’ বা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার-এর উল্লেখ ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ভয়ঙ্কর সুন্দর এই প্রাণীটি পৃথিবীর একমাত্র এই অঞ্চলেই বাদাবনাঞ্চলে অভিযোজিত।
সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ঠিক কত ? এদের বর্তমান পরিসংখ্যান এক বিতর্কিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী। বাদাবনাঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। আজ বললে বিশ্বাস হয় না, এক সময় এই বাদাবনাঞ্চলে বাস করত জাভাদেশীয় গন্ডার। এ ছাড়াও অন্যান্য মুখ্য প্রজাতিগুলির মধ্যে মোহনার-কুমিরও (Crocodylus porosus) বিলুপ্তপ্রায়। মেছো বিড়াল (Prionalurus begalensis), স্নাব নোসড ডলফিন (Orcacella brerirostris), লিটল পরপয়েস (Neophocaena phocaenoides), দৈত্য বক (Ardea goliath)- এই অঞ্চলের অন্যান্য বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির মধ্যে সংকটাপন্ন। বিগত দু’ শতকে লুপ্ত হয়েছে – জাভাদেশীয় গন্ডার, বন্য মহিষ, বানর, হরিণ, সোয়াপ ডিয়ার এবং হোয়াইট উইংড উড ডাক।
পশ্চিমবঙ্গের বিপুল জীবসম্পদ আজ সংরক্ষণজনিত সমস্যার মুখে। গত কয়েক দশকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এবং নগররায়নের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক বাসস্থান, অবক্ষয়িত হচ্ছে বনাঞ্চল।
কলকারখানার আর কীটনাশকজনিত দূষণ আরও ঘনীভূত করেছে এই সংকটকে। এ রাজ্যের বুক থেকে হারিয়ে গেছে ও যাচ্ছে অমূল্য জীববৈচিত্র্যের নানা উপাদান। অধুনা লুপ্ত প্রজাতিগুলির মধ্যে -- এশীয় দ্বিশৃঙ্গ গন্ডার, নীলগাই, কৃষ্ণসার মৃগ, কস্তুরীমৃগ, তুষারচিতা, ব্ল্যাক ফিনলেস পরপয়েস এবং ইন্ডিয়ান পাইলট হোয়েল – প্রভৃতি স্তন্যপায়ী প্রাণী উল্লেখ্য। পাখিদের মধ্যে মোনাল ফেজ্যান্ট, গোলাপী মাথা হাঁস এবং পাহাড়ি তিতির উল্লেখযোগ্য।
সর্বশেষ জীব পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে, ২৬ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২৫ প্রজাতির পাখি, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও অন্তত একটি উভচর প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত আজ সংকটের মুখে। বিশেষ ভাবে সংকটজনক ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – হিমালয়ের থর, এশীয় কালো ভাল্লুক, বামন শূকর, থ্রিবেন্ডেড পাম সিভেট বা ভাম, হগ ব্যাজার, বার্মিজ ফেরার ব্যাজার এবং বেঙ্গল ফ্লোরিক্যান আজ অবলুপ্তির পথে।
প্রসঙ্গ সন্ধান : স্টেটাস অফ বায়োডাইভারসিটি অফ ওয়েস্টবেঙ্গল, জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ২০১২।
সূত্র : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংসদ ও দফতর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
সর্বশেষ সংশোধন করা : 1/15/2020