কম্পিউটার ব্যবস্থার মস্তিষ্ককে বলা হয় সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (সি পি ইউ বা কেন্দ্রীয় প্রক্রিয়ণ বিভাগ)। বস্তুত, এটিই মূল কম্পিউটার। এর প্রধান অংশগুলি হলো কন্ট্রোল ইউনিট বা নিয়ন্ত্রণ শাখা, প্রাইমারি স্টোরেজ ইউনিট বা প্রাথমিক সংরক্ষণ শাখা এবং অ্যারিথমেটিক অ্যান্ড লজিক ইউনিট বা পাটিগণিত ও যুক্তি সংক্রান্ত শাখা।
কি বোর্ড ও মাউস এই সি পি ইউ-র সঙ্গেই তারের মাধ্যমে যুক্ত থাকে। অর্থাৎ, কি বোর্ড বা মাউসের মাধ্যমে যে কাজ করা হয়, তার ফলাফল সি পি ইউ হয়ে কম্পিউটারের পর্দায় আমরা দেখতে পাই। আমরা জানি, কম্পিউটার চলে বিদ্যুতে। সি পি ইউ-র সঙ্গেই বিদ্যুৎ সংযোগ যুক্ত থাকে। সি পি ইউ-এ পাওয়ার নামক একটি সুইচ আছে, যেটি টিপে কম্পিউটার চালু করতে হয়।
এখন আমরা সি পি ইউ-এর বিভিন্ন অংশ নিয়ে আলোচনা করব।
কোনও কম্পিউটার ব্যবস্থায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তথ্যের জোগানকে বজায় রাখে কন্ট্রোল ইউনিট। বস্তুত, কন্ট্রোল ইউনিট একটি কম্পিউটারের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র বা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের ভূমিকা পালন করে। একটি কম্পিউটারের বিভিন্ন অংশের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদানকে পরিচালনা করে কন্ট্রোল ইউনিট।
কম্পিউটারে যে তথ্য ঢোকানো হয়, তা জমা থাকে তার স্মৃতি বা মেমোরিতে। কম্পিউটারের স্মৃতিশক্তি বা স্মৃতি ভাণ্ডারে তথ্য ধারণের ক্ষমতা বিপুল। বস্তুত, কম্পিউটারের প্রযুক্তিগত উন্নয়নে তার স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। কম্পিউটার তার স্মৃতিতে নানাবিধ তথ্য শুধু জমিয়েই রাখে না, ব্যবহারকারীর প্রয়োজন অনুযায়ী তা জোগানও দেয়।
কম্পিউটারের স্মৃতিকে দু’ ভাগে ভাগ করা যায় —১)মূল স্মৃতি বা প্রাথমিক পর্যায়ে সংরক্ষিত স্মৃতি (মেইন মেমোরি বা প্রাইমারি স্টোরেজ) এবং (২) অনুবর্তী পর্যায়ে সংরক্ষিত স্মৃতি (সেকেন্ডারি স্টোরেজ)। মূল স্মৃতি আবার দু’ রকমের। (ক) শুধুমাত্র পাঠযোগ্য স্মৃতি বা রিড অনলি মেমোরি (Read Only Memory) বা সংক্ষেপে (ROM) এবং (খ) অবাধ ব্যবহারযোগ্য স্মৃতি বা র্যানডম অ্যাক্সেস মেমোরি (Random Access Memory) বা সংক্ষেপে র্যাম (RAM)।
একটি চিপে স্থায়ী ভাবে সংরক্ষিত কিছু তথ্য দিয়ে রম তৈরি। রমের সাহায্যে বিভিন্ন রকমের কাজ হয়ে থাকে। যেমন, (১) কম্পিউটার চালু করা হলে রমে ধরে রাখা তথ্য পর্দায় ফুটে ওঠে, (২) বাধ্যতামূলক ও অপরিবর্তনীয় কিছু নির্দেশও রমে ধরে রাখা হয়।
অনেকগুলি ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট বা আই সি দিয়ে র্যাম তৈরি হয়। মূলত বিভিন্ন তথ্য ও বিন্যাসের প্রণালী (প্রোগ্রাম)-কে অস্থায়ী ভাবে সংরক্ষণ করার কাজে এটিকে ব্যবহার করা হয়।
একটি অবধারিত প্রশ্ন ওঠে যে, কম্পিউটারের স্মৃতিতে এই প্রকারভেদ থাকার প্রয়োজনীয়তা কী? এই বিষয়টি বুঝতে গেলে প্রথমেই যা জানা দরকার, তা হলো, রম যে তথ্য ও নির্দেশ ধারণ করে, তা কম্পিউটার চালু হবার পর র্যামের মধ্যে জমা হয় এবং কম্পিউটার বন্ধ করে দিলে তা আবার মুছে যায়। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, রমের মধ্যে সঞ্চিত নির্দেশাবলির সাহায্যে কম্পিউটার মসৃণ ভাবে চলতে পারে। কাজেই এমন একটি ব্যবস্থা দরকার, যা কম্পিউটারের সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপিত হওয়ার পরে একটি বাধ্যতামূলক নির্দেশ দেবে, যাতে প্রয়োজনীয় তথ্য র্যামে সঞ্চিত হয়। এই কাজটিই রমের জন্য নির্দিষ্ট। রম বিভিন্ন বাধ্যতামূলক নির্দেশ, যেমন সমস্ত যন্ত্রাংশ সঠিক ভাবে সংযুক্ত আছে কি না, তা পরীক্ষা করে। রমে সঞ্চিত সমস্ত নির্দেশ পালনের পর কম্পিউটার র্যামে সঞ্চিত নির্দেশাবলির সাহায্যে সমস্ত কাজ করতে পারে।
আগেই বলা হয়েছে, কম্পিউটারের স্মৃতি দু’ ধরনের। (১) প্রাথমিক স্মৃতি (Primary Memory), (২) অনুবর্তী পর্যায়ের স্মৃতি (Secondary Memory)।
কম্পিউটারের মূল প্রাথমিক স্মৃতি বলতে র্যামকে (Primary Memory) বোঝায়। কি বোর্ড কিংবা অন্য কোনও ভাবে কম্পিউটারে যে তথ্য ও প্রোগ্রামই ঢোকানো হোক না কেন, তা প্রথমে গিয়ে সোজা জমা হয় র্যাম নামক স্মৃতিকক্ষে। কিন্তু কম্পিউটার বন্ধ করে দেওয়া মাত্র ঐ স্মৃতিকক্ষে সঞ্চিত তথ্য ও প্রোগ্রাম নষ্ট হয়ে যায় বা হারিয়ে যায়। অর্থাৎ যতক্ষণ কম্পিউটার চালু থাকে, ততক্ষণই কেবলমাত্র র্যামে তথ্য ও প্রোগ্রাম সংরক্ষিত রাখা যায়, কম্পিউটার বন্ধ হলেই তার আর অস্তিত্ব থাকে না। সেই কারণেই এই স্মৃতিকে উদ্বায়ী বা অস্থায়ী বা অস্থিতিশীল স্মৃতি বলা হয়ে থাকে।
কম্পিউটারের অনুবর্তী পর্যায়ের স্মৃতিতে স্থায়ী ভাবে তথ্য সংরক্ষণ করে রাখা যায়। কম্পিউটার যন্ত্রটির বাইরে এই স্মৃতি ধরে রাখা হয়। কিন্তু তাকে ব্যবহার করা হয় কম্পিউটারের সাহায্যেই। অর্থাৎ এটি তথ্য সংরক্ষণের স্থায়ী মাধ্যম। এ ক্ষেত্রে কম্পিউটার বন্ধ করে দেওয়া হলেও তথ্য নষ্ট হয় না বা হারিয়ে যায় না। ফলে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলেই তথ্য ও প্রোগ্রামকে কম্পিউটারের সাহায্যে ব্যবহার করা যায়। তথ্যকে এ ভাবে সংরক্ষণ করার জন্য নানা ধরনের উপকরণ আছে, যেগুলিকে বলা হয় সেকেন্ডারি স্টোরেজ ডিভাইস। যেমন, ফ্লপি ডিস্ক, হার্ড ডিস্ক, কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা সি ডি, ম্যাগনেটিক টেপ ইত্যাদি।
নমনীয় প্লাস্টিক জাতীয় বস্তু বা ফ্লেক্সিবেল প্লাস্টিক মেটেরিয়াল দিয়ে ফ্লপি ডিস্ক তৈরি হয়। সেই কারণেই এর নাম ফ্লপি ডিস্ক। এই ডিস্কে পাতলা গোলাকৃতি প্লাস্টিকের উভয় দিকে চৌম্বক পদার্থের আবরণ থাকে, যাতে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। অর্থাৎ, এই আবরণটি রেকর্ডিং সাবস্টেন্সের ভূমিকা পালন করে। এই আবরণের উপরে অতি ক্ষুদ্র অদৃশ্য আকৃতির চৌম্বক গুঁড়ো হিসাবে তথ্য সন্নিবিষ্ট হয় রেকর্ডিং-এর মাধ্যমে। ফ্লপি ডিস্ক বিভিন্ন মাপের বা ব্যাসের হতে পারে। যেমন, ৮ ইঞ্চি, ৫.২৫ ইঞ্চি, ৩.৫ ইঞ্চি। তবে আজকের দিনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ফ্লপি ডিস্কেরই ব্যাস হয় ৩.৫ ইঞ্চি।
এটি একটি চৌম্বক ডিস্ক বা ম্যাগনেটিক ডিস্ক, যা আসলে পাতলা বৃত্তাকার ধাতু নির্মিত একটি প্লেট। এই প্লেটটির দু’ দিকেই চৌম্বক বস্তুর আবরণ থাকে। যে হেতু প্লেটটি ধাতু দিয়ে তৈরি, তাই একে হার্ড ডিস্ক বলা হয়ে থাকে। একটি ডিস্ক প্যাকে এ রকম বেশ কয়েকটি ডিস্ক থাকে, দু’টি বা তার বেশি, যেগুলি প্রতি মিনিটে ৫৪০০ বা তার বেশি বার চক্রাকারে ঘোরে। প্রতিটি ডিস্কে বেশ কিছু সমকেন্দ্রিক বৃত্ত থাকে, যেগুলিকে চোখে দেখা যায় না। এদের বলে ট্র্যাক। ডিস্ক প্যাকের সবগুলি তলের একই ব্যাসার্ধ যুক্ত বৃত্তগুলিকে একত্রে বলা হয় সিলিন্ডার বা চোঙ। এই হার্ড ডিস্কের মধ্যে ধাতুর প্লেটগুলির খুব কাছে এক একটি রিড অ্যান্ড রাইট হেড (Read & Write Head) থাকে যা রেকর্ডিং সাবস্টেন্সের চৌম্বক ধর্মের তারতম্য থেকে তথ্য অনুধাবন এবং সংরক্ষণ করতে পারে।
হার্ড ডিস্কে তথ্য লেখার সময় এই যন্ত্রাংশগুলিই খুব সীমিত জায়গার মধ্যে চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করে রেকর্ডিং সাবস্টেন্সের চৌম্বক ধর্মের পরিবর্তন ঘটায়। এই পরিবর্তনকে তারা আবার পরবর্তী কালে তথ্যের আকারে অনুধাবন করতে পারে। এই ভাবে তারা তথ্য সঞ্চয় ও পুনুরদ্ধার করে। এক বার চৌম্বক ধর্মের পরিবর্তন করলে তা বহু দিন একই ভাবে থাকে। এর ফলে সঞ্চিত তথ্য বহু দিন একই ভাবে সঞ্চিত রাখা সম্ভব।
এটিকে কম্পিউটারের গণনা শাখা বলা যেতে পারে। অঙ্ক ও যুক্তি সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম করে এ এল ইউ। শুধু সমস্ত রকম গণনার কাজই নয়, সেগুলির তুলনাও করা হয় এ এল ইউ-এর মাধ্যমে। প্রকৃতপক্ষে, কম্পিউটারের প্রসেসর (Processor) নামে একটি বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশ থাকে, যার আবার একটি অংশ এ এল ইউ। এর কাজের গতি মানুষের কল্পনার বাইরে। কিন্তু প্রসেসর যদি স্মৃতি থেকে তথ্য না পায়, তা হলে তার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। যে হেতু প্রসেসরের গতি বেশি, তাই সে যদি একই রকম উচ্চগতিসম্পন্ন বৈদ্যুতিন স্মৃতি থেকে তথ্য আহরণ করতে পারে, তা হলেই তার পক্ষে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা সম্ভব। কাজেই তাকে র্যামের কাছ থেকে তথ্য নিতে হয়। অপর পক্ষে র্যামের কয়েকটি অসুবিধা আছে। যদিও র্যামের পক্ষে উচ্চ গতিতে তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব, কিন্তু র্যামের সঞ্চিত তথ্য কম্পিউটার বন্ধ করলে মুছে যায়। তা ছাড়া র্যামের তথ্যধারণ ক্ষমতাও সীমিত। এ ক্ষেত্রে হার্ড ডিস্ক অনেক তথ্য চিরন্তন ভাবে ধরে রাখতে পারলেও একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা ছাড়িয়ে দ্রুতগতিতে তথ্য সরবরাহ করতে পারে না। প্রসেসর ও হার্ড ডিস্কের সমন্বয়ে কম্পিউটারের এমন একটি ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে হার্ড ডিস্কে সঞ্চিত তথ্য প্রয়োজন অনুযায়ী র্যামে সঞ্চিত হয় আর প্রসেসর তার দরকারমতো র্যাম থেকে তথ্য জোগাড় করতে পারে।
সূত্র : কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, আই আই আই এম
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/23/2020