শিক্ষকদের মধ্যে বেশ কয়েক জনের কথা থেকে ধর্মগত এবং জাতিগত দিক থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পার্থক্যের কথা উঠে এসেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অভিরামপুর অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিবশংকর বাগ-এর মতে :
‘ গ্রামে হিন্দু পরিবারবর্গ বেশির ভাগই বর্ধিষ্ণু পরিবার কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায় হল পিছিয়ে পড়া অংশ। বিদ্যালয়ে প্রথম দিন থেকেই দেখতাম হিন্দু পরিবারের ছেলেমেয়েরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে এলেও মুসলমান ছাত্রছাত্রী অনিয়মিত বা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি।’
মুর্শিদাবাদ জেলার ৪০ নং পূর্ব নাজিরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহঃ সফিকুজ্জমান-এর ও একই বক্তব্য। তাঁর মতে, ‘...সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার কাজে অনেক পিছিয়ে থাকে। তুলনামূলক অন্য সম্প্রদায়ের শিশুদের আগ্রহ অনেক বেশি এবং তারা সক্রিয়।’
সব মিলিয়ে দেখতে গেলে, সমাজে জাতি, শ্রেণি, লিঙ্গ ইত্যাদি বিভিন্ন বিভাজন যে ভাবে পরস্পর জড়িয়ে আছে সেখানে সমস্যাগুলো তত সহজ সরল হতে পারে না।
কিন্তু একজন শিক্ষক–এর কথায় ব্যতিক্রমী কথাও উঠে এসেছে। দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর এফ পি স্কুলের সঞ্জিৎ মাহাত–এর মতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরা পঠনপাঠনে বেশি এগিয়ে থাকে। এক জন শিক্ষকের কথা থেকে যদি এই রকম ব্যতিক্রমী কথা উঠে আসতে পারে তা হলে অন্যান্য শিক্ষকদের কথাতে কেন অন্য রকম কথা শোনা যায় সেটা সত্যি বিচারের বিষয়। শিক্ষকদের কথায় মেয়েদের শিক্ষার কথাও উঠে এসেছে। কোচবিহারের জাটিগাছা এ পি স্কুল–এর শিক্ষক অনন্ত মোদক এর কথায় :
‘বিগত তিন বছর ধরে আমাদের বিদ্যালয়ে ছাত্র এবং ছাত্রীদের অনুপাত প্রায় সমান সমান। ছাত্রীরা কোনও অংশে পিছিয়ে নেই। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলাতেও গ্রামের মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে চলছে। এ ক্ষেত্রে আমরা শুধু তাদেরকে উৎসাহ দিচ্ছি।’
উত্তর দিনাজপুর জেলার দুলহর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কৃষ্ণেন্দু রায় চৌধুরীর কথায় :
‘ছেলেদের থেকে আনুপাতিক হারে মেয়েরাই বিদ্যালয়ে বেশি উপস্থিত থাকে।’
গরিব বলেই লোকে নিরক্ষর, আবার নিরক্ষর বলে গরিব যে লোকেরা, তাঁদের সাংস্কৃতিক চৈতন্য আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক চৈতন্যের সঙ্গে মেলে না। এ চেতনায় রোজ আনা রোজ খাওয়া এক অন্য জীবন দর্শনের জন্ম দেয়। এমন নয় যে তার শিশুর শিক্ষা বিষয়ে কোনও আগ্রহ নেই — সেটা যে পূর্ণমাত্রায় আছে তা আমরা অসংখ্য উদাহরণ থেকে দেখেছি। কিন্তু তার মধ্যে যেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় সেই দৈনিক বেঁচে থাকাটাকে সভ্য সমাজ যদি গুরুত্ব ও মর্যাদা না দেয় তা হলে সমাজের অগ্রগতি কতখানি সম্ভব?
সূত্র : কলমচারি, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/26/2020