শহর এলাকার লোকেদের কাছে ভাষার সমস্যাটা কত বড় তা সহজে বোঝা সম্ভব নয়। শিক্ষকদের লেখাগুলি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলিতে ভাষার সমস্যা একটা বড় ব্যাপার। পুরুলিয়ার দশরথ মাণ্ডি লিখছেন :
‘এই বিদ্যালয়ে যে সমস্ত ছাত্রছাত্রী পড়ে তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ সাঁওতাল ছেলেমেয়ে। তাদের মাতৃভাষা সাঁওতালি। বাড়িতে তারা মা, বাবা, ভাই, বন্ধুদের সাথে সর্বদাই সাঁওতালি ভাষাতেই কথা বলে। ফলে বিদ্যালয়ে বাংলা মাধ্যমে পঠনপাঠনের ক্ষেত্রে এবং ভাষা বোঝার ক্ষেত্রে তাদের খুব অসুবিধা হয়। তার ফলস্বরূপ এরা বিদ্যালয়ে বয়স অনুপাতে পিছিয়ে পড়ে এবং হীনমন্যতায় ভোগে, যার ফলে বিদ্যালয়-ছুট হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যায়।’
এই সমস্যা বহু বিদ্যালয়ে। বিশেষত জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এই সমস্ত জেলাগুলিতে নেপালি এবং অন্যান্য ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা বেশি। আবার পুরুলিয়াতে সাঁওতালি ভাষার শিশুদের বেশি দেখা যায়। কিছু কিছু শিক্ষক অন্যান্য ভাষা শিখে নিয়ে ঐ ভাষায় কথা বলে শিশুদের বেশি দেখা যায়। কিছু কিছু শিক্ষক অন্যান্য ভাষা শিখে নিয়ে ঐ ভাষায় কথা বলে শিশুদের বাংলা ভাষাটা সড়গড় করে দিতে চান এবং বেশ সফলও হন। যেমন জলপাইগুড়ির কাজল সূত্রধর লিখেছেন :
‘যারা বিদ্যালয়ে উপস্থিত তাদের ভাষা বুঝতে পারি না, কী ভাবে তাদের পাঠদান করব, না জানি রাজবংশী, না সাদরি। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আমি ভাবতে শুরু করলাম এ কোথায় এসে পড়লাম? ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ক্লাস শেষ হওয়ার পর চুপচাপ বসে টিফিনবেলায় ভাবতে শুরু করতাম কী করে সম্ভব? যাদের আমি নিজেই বুঝতে পারি না তাদের কী ভাবে বোঝাব? সে ভাবেই কেটে যাচ্ছিল। বাচ্চা ছেলেমেয়গুলি বাংলা ঠিক ভাবে বুঝতে না পারলে পড়ার পরিবেশ কী ভাবে তৈরি হবে। এ ভাবেই আমার ঠিক করা হয়ে উঠছিল না, আমার শিক্ষক হিসাবে কী করণীয়। সেই সময় ঠিক করলাম আমাকে রাজবংশী ও সাদরি দু’টোই বুঝতে হবে। না হলে আমি ওদের বাংলা শেখাতে পারব না। রাজবংশী আয়ত্ত হলেও সাদরি এখনও পুরোপুরি আয়ত্তে আসেনি। এখন শিশুদের সাথে কথা বলা সহজ হয়েছে। ওদের মনের চাহিদাগুলি বুঝতে পারছি। সব চেয়ে আবার যেটা অবাক লাগে দু’টো ভাষাই আমি আয়ত্ত করেছি শিশুদের সঙ্গে কথা বলে। শিশুদের কাছে গিয়ে তাদের শিক্ষকতা করতে গেলাম, হয়ে গেলাম ছাত্র — যারা আমার ছাত্রছাত্রী তারা হয়ে গেল আমার শিক্ষক। নিজেকে ওদের অনেক কাছের বলে মনে করি।’
সুতরাং একটি বিষয় প্রমাণিত যে শিশুগুলিকে তার মাতৃভাষায় শিক্ষা না দিয়ে একটি অন্য ভাষা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
সূত্র : কলমচারি, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/18/2020