বঙ্গদেশ কত প্রাচীন যদি বলতে হয়, তা হলে যেটাকে আমরা বাংলায় ছোটনাগপুরের মালভূমি বা ইংরেজিতে সাউথ ইস্টার্ন মার্জিন বলি, অর্থাৎ আমাদের রাজ্যের যেটা পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল, সে দিকে আমাদের দৃষ্টিটা নিয়ে যেতে হবে। এর ভিতরে পড়ছে পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান-এর পশ্চিম ভাগ এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের মূল অংশটাই। এই অংশের ল্যান্ডফর্ম খুবই পুরনো। একেবারে ‘প্রি-ক্যামব্রিয়ান’ যুগের। এখানে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।
ছোটনাগপুরের মালভূমি জায়গাটা ‘ডেকান-ট্র্যাপ’ বা দাক্ষিণাত্যের যে মালভূমি অঞ্চল, তার থেকেও পুরনো। ‘ডেকান-ট্র্যাপ’ জিওলজিক্যালি, মানে ভূতাত্ত্বিক দিক দিয়ে অনেক পুনর্গঠিত। ভূতাত্ত্বিক দিক দিয়ে ছোটনাগপুরের মালভূমির বয়স বেশ কিছু কোটি বছর তো হবেই।
ভারতে সব চেয়ে প্রাচীন যে ‘ডেট’ বা তারিখটা আমরা পাচ্ছি, সেটা হচ্ছে তামিলনাড়ুর ‘আতিরাম পাক্কাম’ বলে একটা কেন্দ্রে। সেখান থেকে প্রায় দেড় কোটি বছর আগেকার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। ওখানে সেই সময়কার কিছু যে টুলস অর্থাৎ পাথরের যন্ত্র পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো আমরা বলছি ‘অ্যাসুলিয়ন টুলস’, এটা নিয়ে কাজ করেছেন, শর্মা হেরিটেজ সেন্টারের শান্তি পাপ্পু এবং তার কিছু বিদেশি সহকর্মী। এখনও পর্যন্ত এটাই ভারতে প্রাপ্ত প্রাচীনতম প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিদর্শন।
বলা যায়। তবে প্রাণীদের মধ্যেও এর ব্যবহার দেখা গিয়েছে। শিম্পাঞ্জীদের নিয়ে কিছু কাজ হয়েছে। দেখা গিয়েছে তারাও অনেক সময়ে কিছু টুল ব্যবহার করত। হয়ত একটা কাঠি ব্যবহার করল, যেগুলো আমরা ‘কবল্’ বলি, বড় বড় পাথর ব্যবহার করল, এই রকম আরকি!
পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় অঞ্চলে সাম্প্রতিক কালে যে খননের কাজ হয়েছিল, এখন তার প্রাচীনত্ব নিরূপণের ‘ডেট’ বা তারিখগুলো এসে গিয়েছে। সেখানে আমরা এখনও পর্যন্ত প্রাচীনতম যে তারিখ পাচ্ছি সেটা আজ থেকে বিয়াল্লিশ হাজার বছর আগের। ওই একই অঞ্চলে মূল অযোধ্যা পাহাড় ও তার সংলগ্ন কাছাকাছি দুটো জায়গা থেকে নমুনা নিয়ে তা পরীক্ষা করে আমরা আরও চারটে প্রাচীন তারিখ পেয়েছি। সেগুলো যথাক্রমে এখন থেকে একুশ হাজার, পঁচিশ হাজার, একত্রিশ হাজার এবং চৌত্রিশ হাজার বছরের পুরনো। এবং এই প্রত্যেকটা ‘ডেট’ যে সব জায়গা থেকে পেয়েছি, সেই সব জায়গা থেকেই এই মাইক্রোলিটস, বা টুলসগুলো পাচ্ছি। এখানে একটা জিনিস পরিষ্কার করে নিতে চাই। এই অঞ্চলে এবং গোটা পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু আরও পুরনো ‘ডেটস’ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ, আতিরাম পাক্কাম-এ যে রকম ‘টুলস’ পাওয়া গিয়েছে, সেই ধরনের ‘টুলস্’ কিন্তু শুশুনিয়া থেকে পাওয়া গিয়েছে, পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে পাওয়া গিয়েছে। এবং এই পুরো মালভূমি অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গা থেকেও পাওয়া গিয়েছে। এখনও অবধি সেগুলো নিয়ে তেমন ভাবে কাজ হয়নি। আসলে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক যুগ নিয়ে পদ্ধতিগত গবেষণার কাজ সে রকম ভাবে হয়নি। হলে কিন্তু অনেক অজানা তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তখন তো রান্নার ব্যাপারটা আসেনি। তাই ওই টুল সবই শিকারের অস্ত্র। পশুশিকার, মাছশিকার ইত্যাদি।
প্রমাণ বলতে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের কথা ধরতে হবে। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নির্ভর করে সংরক্ষণের উপর। কতটা প্রত্নপ্রমাণ সংরক্ষিত করে রাখা গিয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। গাঙ্গেয় উপত্যকার কোথাও কোথাও এখন থেকে দশ হাজার বছর আগেকার এমন কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছে যেগুলো থেকে আগুনের ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তখন অবশ্য এখনকার মতো উনুনে হাঁড়ি-কড়া চাপিয়ে রান্না হত না। কারণ ইউটেনসিলস বা রান্না করার জিনিসপত্র তখনও আবিষ্কার হয়নি। পশু শিকার করে এনে আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার পদ্ধতিটুকুই তারা জানত। তাই যে পাথরের উপরে পশুর মাংস পোড়ানো হত তার নিদর্শন অর্থাৎ, কার্বন কণার উপস্থিতি দেখে রান্না হত কি না বোঝা যায়। কিন্তু আমরা অযোধ্যা পাহাড়ের এই অঞ্চল থেকে যে সমস্ত নমুনা পেয়েছি সেখানে কার্বন কণা পাওয়া যায়নি। তাই সেই যুগটায় ওই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষেরা রান্না করে খেত না বলা হচ্ছে। পাশাপাশি আবার এটাও ভাবতে হবে, তখন কিন্তু মানুষ ‘হোমো সেপিয়েন্স’-এ রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। মানে অনেকটাই আধুনিক, কাজেই ওরা কাঁচা মাংস খাচ্ছে না। ওরা সেগুলো নিশ্চয়ই রোস্ট করে খাচ্ছে। অথচ তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হাতেনাতে সব সময় পাওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যেতে পারে প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ভূতাত্ত্বিক সংরক্ষণ হয়নি বলেই রান্নার চিহ্ন অমিল।
প্রথমেই বলি, এই কাজটা সম্ভবই হত না যদি না স্থানীয় লোকজনের এবং সেই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য পেতাম। আমরা অযোধ্যা পাহাড়ে কাজ শুরু করি ১৯৯৮-৯৯ সালে, তখন আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন কাস্ট-এর (সেন্টার ফর আরকিওলজিক্যাল স্টাডিজ অ্যান্ড ট্রেনিং) সঙ্গে যুক্ত। সেই সময়ে সেখানকার অধিকর্তা ছিলেন গৌতম সেনগুপ্ত। তাঁর উত্সাহে কাজ আরম্ভ করি। সেই পর্বে তাঁদের কাছ থেকে বিপুল সহযোগিতা পেয়েছি। আর স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা তো সব সময়েই পেয়েছি এবং পাচ্ছি। আমি এক জনের নাম বলব, যাঁকে ছাড়া আমি অযোধ্যায় কাজ করার কথা ভাবতেই পারি না। তিনি আমার পারিবারিক সদস্যের মতোই হয়ে গিয়েছেন। তাঁর নাম গোপীনাথ গোস্বামী। বলরামপুরে বাড়ি। তিনি এবং তাঁর পরিবার যে ভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তা বলে বোঝানো যাবে না। অযোধ্যা পাহাড়ে যে কাজ আমরা করছি, তাঁর সহযোগিতা ছাড়া হত না। বলতে পারেন, ওখানে তিনি আমার লোকাল গাইড বা পথপ্রদর্শক। তিনি ছাড়াও রয়েছেন সুখেন বিশ্বাস। তাঁর একটা ছৌ নাচ অ্যাকাডেমি আছে, যেখানে স্থানীয় আদিবাসী ছেলেদের ওঁরা প্রশিক্ষণ দেন। আর এক জন আছেন, গান্ধীরাম মাহাতো। তিনি ঝুমুর গান করেন। এঁদের সাহায্য ছাড়া ওখানে আমরা গবেষণার কাজ করতে পারতাম না। পাশাপাশি অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশাসন এবং পুলিশের সহযোগিতার কথা বলতে হয়। ২০১১ -১২ সালে যখন আমরা ওখানে কাজ করতে শুরু করি, সেখানে তখন মাওবাদী সমস্যা চলছিল। কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার দীনেশ বাজপেয়ী তখন আমাদের অনেক সাহায্য করেন। অযোধ্যা পাহাড় এলাকার স্থানীয় পুলিশের প্রশাসনও আমাদের প্রভূত সাহায্য করে। নানা কারণে ওই জায়গায় আমাদের যাওয়ার অনুমতি ছিল না। কিন্তু পুলিশ প্রহরা দিয়ে তাঁরা সাহায্য করেন। এঁদের সকলের কাছেই আমি ভীষণ ভাবে কৃতজ্ঞ।
আমি যে জায়গায় কাজ করেছি, কানাপাহাড়ে গ্রাম আছে। সেখানে শিক্ষিত মানুষজন বাস করেন। কিন্তু আমাদের প্রত্নক্ষেত্র যেখানে, সেই মহাদেববেরা, ঘাটবেরা অঞ্চল একদম জঙ্গলের ভিতরে এবং সেখানে মূলত আদিবাসীদের বসবাস এবং বেশির ভাগই আর্থিক ভাবে দারিদ্র সীমার নীচে রয়েছেন। কিন্তু তাঁদেরও যে এত উদ্দীপনা এবং আগ্রহ তা না দেখলে বোঝা যাবে না। ওখানে এক জন আছেন, আমি তাঁকে গোপাল খুড়ো বলে ডাকি। ওখানে গেলে উনি সব কাজ ফেলে আমার কাছে চলে আসেন। সব থেকে আশ্চর্য হল, ওই সব মানুষের সচেতনতা! ২০০৬-০৭ থেকে উনি আমার সঙ্গে আছেন। উনি এক বার আমাকে বলেছিলেন, ‘দিদি, আমরা যে কাজটা করছি, সেটা কি বাঁধিয়ে রাখা যায় না যাতে পরবর্তী প্রজন্ম দেখতে পারে ?’ সচেতনতা না থাকলে এমন কথা বলা সম্ভব নয়। এই স্তরের সহযোগিতা না পেলে এই কাজগুলো একেবারেই সম্ভব হত না।
এ বার একটু আধুনিক ইতিহাসের দিকে মুখ ফেরাই৷ পশ্চিমবঙ্গে এমন অনেক জায়গা আছে যা ইতিহাসের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বাণগড়, কর্ণসুবর্ণ ইত্যাদির মতো জায়গাগুলোতে পর্যটন শিল্প সে ভাবে গড়ে ওঠেনি।
অবশ্যই করা যায় এবং তা হচ্ছেও। ধরা যাক, মালদা মিউজিয়াম বা বেহালার মিউজিয়মের কথাই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডাইরেক্টরেট অফ আর্কিওলজি বা প্রত্নতত্ত্ব পরিদফতরের অধীন এই সব মিউজিয়াম অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
রাজ্যের এই পরিদফতর দীর্ঘদিন ধরেই উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছে। কাজেই সরকারি উদ্যোগ তো রয়েছেই, পাশাপাশি আমরা যারা এই সব বিষয় নিয়ে চর্চা করছি, আমাদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের দেশে সেই উপনিবেশিক যুগ থেকেই থেকেই ‘সাইট মিউজিয়াম’ বা আঞ্চলিক প্রদর্শশালা তৈরির কথা বলা হয়ে আসছে। এটা কর্ণাটকে হয়েছে। আমারই শিক্ষক, প্রফেসর কে পাদায়া করেছেন। ডেকান কলেজের এই শিক্ষক সোরাপুর দোয়াবে দীর্ঘ কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে গবেষণার কাজ করেছেন। উনি নিজের উদ্যোগে ওখানে একটা সাইট মিউজিয়াম খুলেছিলেন, যাতে শুধুমাত্র সোরাপুর দোয়াবের মানুষকে তাদের পরিবেশ, তাদের ইতিহাস সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা যায়। আমার মনে হয় যে, এই উদ্যোগটা, আমাদেরও কিছুটা নেওয়া উচিত। মানে আমরা যারা গবেষণা করি আমাদেরও একটা দায়বদ্ধতা আছে। কখনও কোনও উদ্যোগ নিয়ে এই রকম কিছু করা যায় কিনা ভাবা দরকার। এখানে টাকার ব্যাপারটা একটা খুব বড় ফ্যাক্টর। তাই সব ক্ষেত্রে সরকারের মুখের দিকে না তাকিয়ে কিছু বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা নেওয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে। এমন ‘সাইট মিউজিয়ম’ আরও তৈরি হলে আঞ্চলিক মানুষজন তাঁদের নিজের অঞ্চলকে চেনার, বোঝার সুযোগ পাবেন পাশাপাশি পর্যটকেরাও উপকৃত হবেন।
সূত্র : এই সময়, ৩০ মার্চ, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 12/21/2019