বৈষ্ণব আন্দোলন চৈতন্যদেব প্রবর্তিত ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন, যা ‘ভক্তি আন্দোলন’ নামেও পরিচিত। তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নদিয়ায় এ আন্দোলন গড়ে ওঠে।
বৈষ্ণব আন্দোলনের সূত্রপাত হয় মূলত চৈতন্যদেবের পূর্বে চণ্ডীদাস (১৪শ শতক) ও বিদ্যাপতির (আনু. ১৩৭৪-১৪৬০) বৈষ্ণবপদ রচনার মধ্য দিয়ে; চৈতন্যদেব এতে নতুন মাত্রা যোগ করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে এটি একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়। তখন এর নতুন নাম হয় গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম, যা সাধারণ ভাবে বাংলায় বৈষ্ণবধর্ম নামে পরিচিত। হিন্দু সমাজে ভগবৎপ্রেম ও ভক্তিবাদ আশ্রিত বৈষ্ণবধর্ম বিদ্যমান থাকলেও সুফি মতবাদের উদার মানবপ্রেম ও সাম্যনীতির আদর্শ যুক্ত করে চৈতন্যদেব একে একটি নব্য ভাববাদী ধর্মমতের রূপ দেন।
বৈষ্ণবধর্মে কীর্তন প্রচলিত ছিল। চৈতন্যদেব পদযাত্রাসহ নামসঙ্কীর্তন ও নগরকীর্তন প্রবর্তন করে এতে নতুন মাত্রা যোগ করেন। নব্য বৈষ্ণবধর্মে সুফি ধর্মমতের আশেক-মাশুক তত্ত্ব, নাম-মাহাত্ম্য, জিকির বা ভক্তিবাদ এবং সামা নাচ-গানের প্রভাব পড়েছিল বলে পণ্ডিতগণ অভিমত পোষণ করেন। ভক্তিভাবাশ্রিত নামসঙ্কীর্তনে বৈষ্ণব আন্দোলন প্রাণবন্ত ও গতিশীল হয়। এ কারণে বৈষ্ণব আন্দোলন ‘ভক্তি আন্দোলন’ নামেও অভিহিত হয়। আবার সার্বিক ভাবে চৈতন্যদেবের অবদানের কথা স্মরণ করে একে ‘চৈতন্য আন্দোলন’ও বলা হয়। চৈতন্যদেবের এই আন্দোলনের প্রধান কারণ ছিল দুটি: এক -- স্বধর্ম ও স্বসমাজের সংস্কার সাধন এবং দুই -- শাসক শ্রেণির ছত্রচ্ছায়ায় ইসলাম ধর্মের ক্রমবর্ধমান প্রভাব রোধ করা। তিনি এক দিকে বিরাজমান হিন্দু অভিজাতদের ম্লেচ্ছাচার রোধ করেন, অপর দিকে নামসঙ্কীর্তনের মাধ্যমে সর্বসাধারণকে নব্য প্রেমধর্মে সমান অধিকার দেন। এ ভাবে তিনি উচ্চ ও নিম্ন বর্গকে অভিন্ন ধর্মাচরণ ও ভাবাদর্শে পরস্পরের কাছে এনে এক আত্মীয়ভাবাপন্ন হিন্দু সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
চৈতন্যদেবের সময়ে হিন্দু সমাজের অবস্থা ছিল খুবই সঙ্কটজনক। সমাজে তখন বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথার কারণে অস্পৃশ্যতা, অস্পৃশ্যতার কারণে বৈষম্য এবং বৈষম্যের কারণে সামাজিক অনৈক্য বিরাজ করছিল। উপরন্তু সতী প্রথা, কৌলীন্য প্রথা, গৌরীদান বা বাল্যবিবাহ, জাতিচ্যুতি, প্রায়শ্চিত্ত ইত্যাদি সংস্কার হিন্দু সমাজকে নানা দিক থেকে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। স্মার্ত পন্ডিত রঘুনন্দন নব্যন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্র প্রবর্তন করে সমাজকে বজ্রবন্ধনে আবদ্ধ করেন। তিনি পুণ্যফল, পরকাল ও ঈশ্বর সামীপ্যের লোভ দেখিয়ে এবং অজস্র বিধিনিষেধ আরোপ করে মানুষকে অনুষ্ঠানক্লিষ্ট করে তোলেন। চৈতন্যদেব হিন্দু সমাজের এই অচলায়তন ভেঙে তাতে মানবতার নবপ্রাণ সঞ্চার করেন। তাঁর কাছে কোনও জাতিভেদ, ধর্মভেদ বা বর্ণভেদ ছিল না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে প্রচার করেন যে, কৃষ্ণভক্তদের মধ্যে কোনও জাতিকুল বিচার নেই, সবাই সমান। বৈষ্ণব আন্দোলনের মূল শক্তি এখানেই নিহিত।
মধ্যযুগে বিভিন্ন বর্ণশ্রেণিতে বিভক্ত হিন্দু সমাজে চৈতন্যদেবের এই মতবাদ ছিল কল্পনাতীত। তখন সমাজের উচ্চ কোটিতে ছিল ব্রাহ্মণ, আর নিম্ন কোটিতে শূদ্র। চণ্ডাল শূদ্র শ্রেণিভুক্ত। ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকারে আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। তুর্কি বিজয়ের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের কঠোরতা আরও বৃদ্ধি পায়। এরূপ অবস্থায় ব্রাহ্মণ সন্তান চৈতন্যদেব চণ্ডাল, মুচি, ম্লেচ্ছ, বৈশ্য, কায়স্থ, ব্রাহ্মণ সকল বর্ণের মানুষকে কৃষ্ণের প্রেমমন্ত্রে ডাক দিয়ে ঐক্যসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করেন। চৈতন্যদেব নিজে কোনও কিছুর চর্চা করে অন্যকে তা শিক্ষা দিতেন। চৈতন্যভাগবতে আছে : নবদ্বীপে নগরভ্রমণ উপলক্ষে তিনি প্রথমে তন্তুবায়ের গৃহে যান এবং তার দান হিসেবে নববস্ত্র গ্রহণ করেন। পরে গোয়ালার ঘরে দধিদুগ্ধের মহাদান গ্রহণ করেন। এ ভাবে তিনি গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক, মালাকার, তাম্বলী সকলের ঘরে গিয়ে তাদের আন্দোলনের শরিক করেন। তিনি যে জাতিভেদ মানতেন না এবং জাতিচ্যুত হওয়ার ভয়ও করতেন না, এ সব দৃষ্টান্তে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। শ্রীচৈতন্য জাতিভেদের কঠোরতা শিথিল করেন। তাঁর কাছে শাস্ত্রের চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য ছিল অধিক। তাঁর পরিকর-পার্ষদবর্গের মধ্যে ব্রাহ্মণ (রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, জীব গোস্বামী), বৈদ্য (মুরারি গুপ্ত, অদ্বৈত আচার্য), কায়স্থ (রঘুনাথ দাস, নরোত্তম দাস), যবন (হরিদাস), সুবর্ণবণিক (উদ্ধারণ দত্ত), সদগোপ (শ্যামানন্দ দাস) প্রভৃতি বর্ণ বা গোত্রের ব্যক্তিরা ছিলেন। তাঁর প্রেমভক্তিবাদে সমাজের সব স্তরের মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল। এতে সামাজিক সচলতার লক্ষণ প্রকাশ পায়। সে কালের বর্ণবাদী হিন্দু সমাজের প্রেক্ষাপটে বৈষ্ণবরা এ ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক চেতনার পরিচয় দেন।
শীর্ষ স্থানীয় বৈষ্ণব গুরুদের মধ্যে নারীরও স্থান ছিল। নিত্যানন্দের কনিষ্ঠা পত্নী ও বীরভদ্রের বিমাতা জাহ্নবীদেবী খড়দহে বৈষ্ণব কেন্দ্র গড়ে তুলে ধর্মপ্রচার করেন। তিনি ভক্তের চোখে ‘ঈশ্বরী’ রূপে খ্যাত ছিলেন। বিষ্ণুপুরের শ্রীনিবাস আচার্যের কন্যা হেমলতা ঠাকুরানিও অনুরূপ ভাবে আখড়া পরিচালনা, ভক্তদের দীক্ষাদান ও ধর্ম প্রচারের অধিকার লাভ করেন। নাথপন্থায় মহাজ্ঞানের অধিকারিণী ময়নামতীও গুরুর অধিকার ভোগ করেন। সুফিবাদে নারীর এ ধরনের অধিকার ছিল না। ধর্মপ্রচারে নারী ও পুরুষকে সমান অধিকার দিয়ে বৈষ্ণবগণ প্রগতিশীল সাংগঠনিক ও মিশনারি চেতনার পরিচয় দিয়েছেন।
সূত্র : উইকিপিডিয়া, amadernangalkot.com,thesundayindian.com
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/29/2020