তখনও চতুর্দিকে ‘নারী দিবস’ এমন উদযাপনের ব্যাপ্তি পায়নি। পঞ্চাশ বছর আগে আমার বাল্যকালের কথা বলছি। কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টির মেয়েরা সোভিয়েত রাশিয়াকে অনুসরণ করে নিজেদের মতো করে ৮ মার্চ পালন করতেন। সেই পালনে তেমন জাঁকজমক থাকত না। কিন্তু আন্তরিকতার কোনও অভাবও হত না।
তখনও ‘নারীর অর্ধেক আকাশের অধিকার’ বোঝার বয়স আমার হয়নি। কিন্তু মা পার্টি সদস্য ছিলেন এবং মহিলা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে, মা এবং তাঁর আন্দোলনের সাথীদের সঙ্গে আমিও ৮ মার্চের মঞ্চে হাজির থাকতাম। আমার কাজ ছিল, কখনও নাজিম হিকমত, কখনও নজরুল বা সুভাষ মুখোপাধ্যায় না বুঝে আবৃত্তি করা। বস্তুত ওই সব কবিতার মর্ম আমি অনেক পরে একটু একটু বুঝতে শিখেছি।
আমার পারিবারিক পরিমণ্ডলে আমি তখনও নারী-পুরুষের কোনও ভেদের তেমন প্রকাশ দেখিনি। বাবা-মা দু’জনেই বাইরের নানা কিছুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে, বাবাও গৃহস্থালি কাজ করতেন। তাতে যে তাঁর কোনও অসম্মান ছিল, তা জানতামই না। পরে বুঝতে পেরেছি আমার মামাবাড়ি ছিল পুরুষতান্ত্রিকতার পীঠস্থান কিন্তু এত মসৃণ, এত স্বাভাবিক ভাবে সমস্ত ব্যবস্থাটা চলত, যে কোথাও কোনও অসংগতি আছে বলে মনেই হত না। পুরুষের আধিপত্যের দাঁত-নখ ঢাকা থাকত মেয়েদের মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার চিরকালীন শিক্ষায়। এমনকী স্বামীর বিবাহ-বহির্ভূত দ্বিতীয় সংসারকেও মেনে নিতে দেখেছি। আক্ষেপ ছিল, বিদ্রোহ ছিল না, আত্মসম্মানবোধও না। কিন্তু এ সব বোঝার আগেই ৮ মার্চ আমাকে অন্যতর কোনও সত্যের দিকে মুখ ফেরাতে শিখিয়েছিল অস্বীকার করা যাবে না।
সেই মুখ ফেরানোর যাত্রায় যাঁরা আমার হাতেখড়ি দিয়েছিলেন, তাঁরা আমার মায়ের কাজের সাথী, কিন্তু আমার কাছে তাঁদের জায়গা মায়ের পরেই। তাঁরা যে নিজের জায়গায় একেবারে অনন্য ছিলেন, সে সব আমি পরে জেনেছি। সর্বাগ্রে তাঁরা আমার স্নেহশীল অভিভাবক।
প্রথম প্রজন্মের এই প্রতিবাদী মেয়েদের সারা দেশ থেকে এনে জড়ো করেছিল ৮ মার্চ। অধিকাংশই ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের। যশোরের কনক মুখোপাধ্যায়, বরিশালের মণিকুন্তলা সেন, দিনাজপুরের রানি মিত্র (দাশগুপ্ত) ময়মনসিংহের কমলা মুখোপাধ্যায়। তাঁদের সঙ্গে অভিজাত, ধনী বিদেশে পড়াশুনো করা রেণু চক্রবর্তী --- সকলেই সামিল ছিলেন সাম্যের দাবিতে, নারীর সমানাধিকারের লড়াইয়ে। সে এক অন্য ৮ মার্চ। রাজনীতির মেরুকরণ তখন অন্য রকম ছিল।
গরিব দেশের মানুষ তাকিয়ে থাকত সোভিয়েত রাশিয়ার দিকে।
এঁদের কাছে ছিল গল্পের ঝুড়ি। সেই সব অভিজ্ঞতার কথা তাঁরা আমায় উপুড় করে দিয়েছেন। কনকমাসি ‘ফ্যাসিবিরোধী ’ আন্দোলনের গল্প বলতে বলতে চোখের সামনে এঁকে দিতেন ঘরের মেয়েদের বাইরের ঘটনার প্রতি আগ্রহের ছবি। আবার কখনও তাঁর সৎ-মায়ের ব্যবহারের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতিও আমার সঙ্গে ভাগ করে নিতেন। মণিমাসির কাছে শুনেছি বিভিন্ন জেলার মেয়েদের মধ্যে অভ্যর্থনার কেমন ফারাক হয়ে যায়। সুন্দরবনে গ্রামের মেয়েরা বিড়ি বা হুঁকো দিয়ে অভ্যর্থনা করেন আবার বর্ধমানে পা ধোয়াতে আসেন। এই সব নানা ছোট-ছোট অভিজ্ঞতা, কখনও মজার গল্প, কখনও পুলিশের অত্যাচার। রানি মাসি ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের প্রথম সারির কর্মী। কৃষক-মেয়েদের জেদ আর কষ্ট সহিষ্ণুতার কত গল্প যে শুনেছি! পরে সোভিয়েত রাশিয়ায় গিয়ে বিশেষত মেয়েদের দেখে, তাঁর স্বপ্নভঙ্গের কাহিনিও শুনেছি। মা-মেয়ের গল্পে তো কোনও আড়াল থাকে না। থাকা সম্ভব নয়। বাল্যকালে শোনা সেই সব গল্পের মধ্যে আজ বুঝি কী অদম্য স্বপ্ন বোনা ছিল তাঁদের। তাঁদের নিজেদের লড়াইও কম কিছু ছিল না। রানি মাসি বাড়ির বাইরে বেরোবার জন্য অনশন করতেন। ঘরে বন্ধ হয়েও থাকতে হয়েছে। দেশ ভাগের পর এঁরা সবাই সংসারের দায়িত্ব নিয়েছেন। ঘরে ঘরে তখন এই মেয়েদের এগিয়ে চলার কাহিনি। অর্গল ভাঙার গান। সেই অর্গল হয়তো ভেঙে গেছে কিছুটা। কিন্তু মেয়েদের স্বাধীনতা --- এখনও দূর অস্ত।
এইখানে বলে রাখি, এঁরা সকলেই কিন্তু সিঁদুর পরতেন এবং স্বামীর পদবি ব্যবহার করতেন। ভাই বোনের সব দায়িত্ব পালন করে, বেশ বেশি বয়সে বিবাহ করেছিলেন রানিমাসি। তার পর থেকে শ্বশুরবাড়ির পদবি ব্যবহার করতেন।
হয়তো এই বহিরঙ্গের আচারে তাঁদের কিছু এসে যেত না। সেই সব নিয়ে কথা হচ্ছিল আমার সঙ্গে। কথায় কথায় রানিমাসি বলেছিলেন, ‘তোরা, অনেক কিছু এগিয়ে ভাবতে পারিস। আমরা তো আত্মরক্ষাতেই ব্যস্ত ছিলাম।’ কথাটা কেন জানি না, আমাকে খুব ভাবিয়েছে। নানা সময় নানা ঘটনার সামনে পড়ে আমার মনে হয়েছে আত্মরক্ষার পালা কি সত্যিই শেষ হয়েছে? নন্দীগ্রামে বাইক-বাহিনী অধিকারীপাড়ার বারো বছর থেকে বাহাত্তর বছরের কোনও মেয়েকে যৌনপীড়ন থেকে বাদ দেয়নি, তার পরের দিন লাঞ্ছিতা বৃদ্ধা আমার হাত ধরে একটু বিষ চেয়েছিলেন; সদ্য যুবতী মেয়েটি বলেছিল, ‘যেখানেই যাব, লোকে আমার দিকে তাকিয়ে বলবে এই মেয়েটা রেপ হয়েছে।’ সেই হাহাকারের সামনে দাঁড়িয়ে আমি উপলব্ধি করেছিলাম, ‘আত্মরক্ষা’ শব্দটির ব্যাপ্তি কত বিশাল! তার দায়িত্ব নিতে আমরা আজও কি প্রস্তুত? রাজনীতিতে এখনও মেরুকরণ আছে। তার হিসেব অবশ্য অন্য রকম। সে দিনও নারী শরীরের বাজার ছিল। আজও আছে। কিন্তু সে দিন সেই বাজারের সঙ্গে কোথাও নৈতিকতার একটা বিরোধ ছিল। আজ ঘুচে গেছে। বিজ্ঞাপনে, সিরিয়ালে কিংবা ব্রতকথায় যে নারীর জয় জয়কার, সে তো আদর্শ স্ত্রী, মা বা কখনও বোন। তার কাজ সহনশীলতার প্রতিমূর্তি হয়ে পুরুষের মনোরঞ্জন করা। স্বামীর লাম্পট্য, সন্তানের অসভ্যতা সবই তাকে এক ভাবে বা অন্য ভাবে মেনে নিতে হবে। এর ওপর আছে শরীর। যে শরীর তাকে প্রতিনিয়ত ঘষে-মেজে দর্শনধারী করে রাখতে হবে। কারণ তার আসল পরিচয় তো শরীরে। মেধায়, মননে বা কল্পনাশক্তিতে নয়। একুশ শতকে যে নারীর ছবি উঠে আসে সে কম্পিউটার দক্ষ, চলনে বলনে স্মার্ট, মাতৃভাষা দক্ষতায় বিদেশি ভাষা বলে, যে কোনও পোশাকে তার কোনও অস্বাচ্ছন্দ্য নেই কিন্তু মনে মনে সে বাস করে অষ্টাদশ শতকে। আঙুলের আংটি কিংবা শুক্রবার ব্রত রাখায় তার আধুনিকতায় আঘাত লাগে না। অন্য দিকে, বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ হয়ে যায় নারীশিক্ষার অগ্রগতি। পণের টাকা জোগাড় করতে স্নেহলতার বাবাদের আজও বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়। ভাগ্য-সমর্পিত এই বাতাবরণে বড় হচ্ছে আমাদের উত্তর -প্রজন্ম। অথচ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা যে মরে যায়নি তার প্রমাণ কামদুনি বা মধ্যমগ্রাম।
দীনদরিদ্র পিতার ঘরের মেয়েটি বইকে হাতিয়ার করে নিজের জায়গা খুঁজতে চেয়েছিল। তারা বুঝেছিল আসলে বর্ণ পরিচয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার আত্মপরিচয়। ৮ মার্চ এলে, ওই ছোট ছোট মেয়েদের এই বড় উপলব্ধির কথাই আরও বড় হয়ে ওঠে।
আমার মায়েরা যে উদযাপন শুরু করেছিল ছোট করে, আজ সেই উদযাপন মহল্লায় মহল্লায় মঞ্চে মঞ্চে ছড়িয়ে গিয়েছে। অনেকেই বুঝতে পেরেছে ৮ মার্চের কথা কেন স্মরণ করব আমরা। দিন বদলেছে। আজ আর পাশাপাশি বসে কাজ করা সহকর্মী পুরুষটির সঙ্গে ততটা নিরাপদ নয় মেয়েটি। প্রতিবেশী চোর চোর খেলার বাল্যসাথী মেয়েটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিচয় বদলে নারী শরীর হয়ে গিয়েছে। চেনা দিতে মেয়েটির কেমন ভয় ভয় করে। অস্বস্তি হয় ছেলেটির চাউনিতে। এই সব বদল মনে করাতে আসে ৮ মার্চ। মাথায় পাকাচুল নিয়ে ভাবি , কাজের অধিকার, ভোটের বা শিক্ষার অধিকার কিছুই কেন মেয়েদের মর্যাদা দিতে পারল না? পোশাক পালটে, ভাষা বদলে, আজও কেন মেয়েরা পুরুষতন্ত্রের হাতের পুতুল? যেমন নাচায়, তেমনই নাচে।
তা হলে কি ভুল ছিল ভাবনায়? আত্মরক্ষার লড়াইটাই যে এখনও শেষ হল না। সমানাধিকার খাতায়-কলমে বন্দি। মায়েরা যে লড়াইটা শুরু করেছিল, আজ নানা গলিপথ পার হয়ে এক নিরেট দেওয়ালের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যে দেওয়ালের নাম ‘বাজার’। যেখানে সবই পণ্য। আজ পুরুষতন্ত্র সেই বাজারকে হাতিয়ার করে মেয়েদের আত্মরক্ষার লড়াইকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ৮ মার্চ সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার দিন।
সূত্র: এই সময়, রবিবারোয়ারি, ৮ মার্চ, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/22/2020