বাবার ঠেলাগাড়ি চালাতে গিয়ে খেলাধুলোয় হাতে খড়ি। সেই মেয়েই আজ দেশের সেরা হেপ্টাথলিট। তিনি স্বপ্না বর্মন।
জলপাইগুড়ির এক প্রত্যন্ত গ্রাম ঘোষপাড়া থেকে উঠে আসা স্বপ্নার খেলাধুলোর সঙ্গে প্রথম যোগাযোগটা ছিল কিছুটা কাকতালীয়। গাড়ি ঠেলার জোর ছিল না গায়ে। গ্রামের পুরোহিত নিদান দিয়েছিলেন, ‘খেলাধুলো করো, তা হলে গায়ে জোর হবে’।
পরের দিনই গ্রামের অন্য মেয়েদের সঙ্গে স্বপ্না নেমে পড়েছিল কবাডি খেলতে। মাসখানেক পর ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলা। মেয়ের দস্যিপনা দেখে বাবা মায়ের থেকেও বেশি চিন্তিত ছিলেন পড়শিরা। খেলার ফাঁকে সময় পেলে বাবার সঙ্গে ঠেলা চালানো আর পড়াশোনা - এই ছিল স্বপ্নার রোজনামচা।
হেপ্টাথলনে যিনি সেরা, তাকে অ্যাথলেটিক্সের সাতটি ইভেন্টে পারদর্শী হতে হয়। তাই হেপ্টাথলনের সেরাকেই বলা হয় দেশের সেরা অ্যাথলিট। সেই অর্থে স্বপ্নাই এখন দেশের সেরা অ্যাথলিট। অথচ নিজের গ্রামেই তার কোনও স্বীকৃতি নেই। বরং আছে সন্দেহ আর প্রশ্ন। স্বপ্নার বাবা মায়ের কাছে প্রায়ই গ্রামের লোকজন খোঁজ খবর নেয়, মেয়ে শহরে কী করে? এমনকী তার পরিবারও যে মেয়ের কীর্তির কথা সবটা বোঝেন, এমন নয়।
তিরুঅনন্তপুরমে সদ্য শেষ হওয়া জাতীয় গেমসের হেপ্টাথলনে সোনা জয়ের পরেই স্বপ্না ফোন করেছিলেন বাড়িতে, ‘মা আমি ফার্স্ট হয়েছি’। মায়ের প্রশ্ন, ‘কীসে ফার্স্ট হয়েছিস রে’। স্বপ্নার জবাব ‘অ্যাথলেটিক্স’। পরের প্রশ্ন, ‘এটা আবার কী খেলা ?’ কলকাতায় বসে এ সব কথা বলতে গিয়ে মন খারাপ হয়ে যায় বছর উনিশের স্বপ্নার। কিন্তু তিনি জানেন অভাবের সংসারে মেয়ের খেলা নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই মায়ের।
বাবা পঞ্চানন বর্মন শয্যাশায়ী। দুই ভাই থাকলেও সংসারে তাদের কোনও অবদান নেই। তাই মাকে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে নাম লেখাতে হয়েছে। কোচ সুভাষ সরকারের হাত ধরে স্বপ্না যে দিন শহর কলকাতায় পা রেখেছিলেন, সে দিনটা আজ আর সে ভাবে মনে পড়ে না তার। মেয়ে কলকাতায় গিয়ে ঠিক কী করবে? এই প্রশ্ন করেননি মা। বদলে তাঁর প্রশ্ন ছিল, কলকাতায় গিয়ে মেয়ে খেতে-পরতে পাবে তো? নানা জায়গায় পুরস্কারের টাকা পেলেই তাই বাড়িতে পাঠিয়ে দেন স্বপ্না।
গত চার বছরে রাজ্য চ্যাম্পিয়ন, জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, জাতীয় গেমসে চ্যাম্পিয়ন ও দেশের হয়ে এশিয়াডে নামা - সব হয়ে গিয়েছে। কিন্তু স্বপ্না জানেন, যেতে হবে আরও পথ।
সূত্র: এই সময়, ৫ মার্চ, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/31/2020