অসমীয়া   বাংলা   बोड़ो   डोगरी   ગુજરાતી   ಕನ್ನಡ   كأشُر   कोंकणी   संथाली   মনিপুরি   नेपाली   ଓରିୟା   ਪੰਜਾਬੀ   संस्कृत   தமிழ்  తెలుగు   ردو

এক বীরাঙ্গনার লড়াই

এক বীরাঙ্গনার লড়াই

অবিস্মরণীয় সেই বারুদবালিকার উদয় ঊনিশ শতকের অস্তলগ্নে।

মায়ের পেশার অনিবার্য অনুসরণের জন্য সাধারণ এক বারাঙ্গনা-কন্যার যতটুকু রূপ-গুণ-শিক্ষার দরকার ছিল, বালিকার অর্জন ছিল তার চাইতে অনেক বেশি। মায়াবী লাবণ্য, অসাধারণ গানের গলা এবং পড়াশোনায় চমক লাগানো নৈপুণ্য (ঝামাপুকুর এএম গার্লস স্কুল থেকে মধ্যবাংলা পরীক্ষায় দারুণ নম্বর পেয়ে পাশ)! ব্যস!--- মায়ের খুশি আর ধরে না! বাজারে এ বার চড়া দাম হাঁকাবে গর্বিতা মা।

কিন্তু না, সমস্ত হিসেব নিজস্ব জেদে উল্টে দিয়ে দিব্যাঙ্গনা সেই কিশোরী এসে দাঁড়াল অচেনা নাট্যাঙ্গনাদের মধ্যে। মায়ের আশা কিংবা বাসা থেকে চিরকালের মতো বার হয়ে এসে। প্রথমে ‘ক্লাসিক’, পরে ‘মিনার্ভা’, মাঝে মেছুয়াবাজারে রামকৃষ্ণ রায়ের তৈরি ‘গেইটি’ থিয়েটার। উপেক্ষার আর অনাদরের সেই ট্রায়াল পর্ব শেষে চোরাবাগানের ‘এম্প্রেস’ থিয়েটারে এসে নটী সুশীলাবালার ইচ্ছাপূরণের সূচনা --- ‘স্নেহসিক্ত আশ্রয়ে মুখোমুখি শিক্ষাগুরু-প্রবাদ-প্রতিম আচার্য অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফী! বিনম্র, জিজ্ঞাসু শিষ্যাকে প্রথম দিনের পরীক্ষার পরই বলেছিলেন --- ‘সুশীলা, দেখে নিও , তুমি এক দিন মস্ত বড় অভিনেত্রী হবে, শুধু লক্ষ্য স্থির রেখো।’ পঞ্চদশী সেই মুহূর্তে সব-পেয়েছির দেশে! নূপুরের নিক্কণ, ক্ল্যারিওনেটের সুর, মুগ্ধদের ‘এনকোর’ আর করতালির শব্দ আর করিনথিয়ান থামগুলির সব ভোলানো হাতছানি--- এই জন্মের এই সব পরমার্থের জন্যই সে বোধহয় এক দিন মায়ের আঁচল ছেড়ে থিয়েটারের হাত ধরেছিল এক অলৌকিক সম্মোহনে, যেন ঘর-ছাড়ানো নিশির ডাক! আচার্য অর্ধেন্দুশেখরের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সুশীলা পেয়েছিল সে সময়ের সেরা অভিনেত্রী তিনকড়ির স্নেহ, সখ্য আর নিঃস্বার্থ সমর্থন! বেহিসেবি মালিক এম্প্রেস থিয়েটার ঠিকমতো চালাতে পারছিল না। তিনকড়ি নতুন থিয়েটারে ঢুকতে চলেছেন, অনুগতা কিশোরী প্রতিভাকে একান্তে ডেকে বললেন, ‘চল সুশীলা, নতুন থিয়েটারে যাই, ওই মালিক ভালো পয়সা দেবে। তোর এমন গানের গলা, এমন রূপ।--- চল, সামনে আরো সুখের দিন,--- আরো, অনেক টাকা!’ নম্র হাসিতে সুশীলার প্রত্যাখ্যান--- ‘না দিদি, গুরুর কাছে পাঠ তো শেষ হয়নি। তিনি যত দিন এখানে, আমি তত দিন এখানেই আছি’। শেষ পর্যন্ত এম্প্রেস বন্ধ হয়েই গেল। তিনকড়ি সুশীলাকে ভোলেননি, নিয়ে এলেন গিরিশচন্দ্রের কাছে। গিরিশচন্দ্র তত দিনে স্টার থিয়েটার ছেড়ে রাজসাহীর বোদালিয়ায় একটি সাধারণ রঙ্গালয় স্থাপনের দায়িত্ব নিয়েছেন। গিরিশের পরিচালনায় বোদালিয়ার ‘মার্ভেল থিয়েটার’-এ সুশীলাবালা সর্বার্থেই পাকা অভিনেত্রী হয়ে উঠল। বোদালিয়া থেকে ফিরে আবার ক্লাসিক থিয়েটারে, তার পর আবার মিনার্ভায়। এই দুটো জায়গা থেকে এক দিন উপেক্ষার জ্বালা নিয়ে চলে আসতে হয়েছিল সুশীলাবালাকে। নতুন পরিস্থিতিতে দুই থিয়েটারেই জনমোহিনী আকর্ষণ সুশীলাবালার গান আর অভিনয়। গিরিশচন্দ্রের ‘বলিদান’ নাটকে ‘জোবি’র ভূমিকায়, ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটকে লুত্ফার ভূমিকায়, ‘মীরকাসিম’ নাটকে বেগমের ভূমিকায় তার অভিনয় অগণিত দর্শক-সমালোচকদের বিস্মিত বিমুগ্ধ করে দিল। সুশীলাবালা উদ্দীপক অভিনয়ের পাশাপাশি যখন মধুর দরাজ গলায় গান ধরতেন --- ‘বীর -করে তরবারি ধরে।/তরবারি সাজে আর কার করে।। ’--- তখন দর্শকরা দাঁড়িয়ে উঠে স্লোগান তুলতেন ‘বন্দে মাতরম’।

এত সব প্রাপ্তি আর স্বীকৃতির পাশাপাশি সুশীলাবালাকে নিয়ে কিন্তু গুণমুগ্ধদের তরফে সমালোচনা কম হয়নি। ৩১ বছরের ছোট্টো পরমায়ুতে অভিনয় জীবনের প্রাথমিক পাঠের পর প্রবল খ্যাতি আর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার মুখে সে বার বার ভুল ঠিকানায় গিয়েছে, ভুল নাটক করেছে, ভুল উদ্যোগের সঙ্গী হয়েছে;--- এক অস্থির একগুঁয়েমিতে অকিঞ্চিত্কর প্রযোজনা আর প্রযোজকের নীরক্ত উদ্যোগগুলোর দায় একা কাঁধে নিয়েছে। কিন্তু থিয়েটার তো গলফের মতো একার খেলা নয়! তবে? এত বড় প্রতিভা কেন বার বার নিজেকে এমন চন্দ্রাহতের মতো অপচয়িত করল? প্রেম!সেই এম্প্রেস থিয়েটারে সুশীলার মুকুলিত যৌবনের দিন থেকে শ্রীপুরের জমিদার নরেন্দ্রনাথ তার অভিনয়ের নিয়মিত দর্শক। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় মুগ্ধ চোখের আমন্ত্রণ আর নির্বাক অনুরাগের অব্যর্থ সংকেত নিয়ে এম্প্রেস থেকে ক্লাসিকে হাজিরা দিচ্ছেন বিত্তশালী জমিদারমশাই। বাইজির ঠেক, বারাঙ্গনাদের নিশিবাসর কিংবা বাঁধা মেয়েছেলের নেশাতুর বিছানার বাইরে তখন অন্য বিনোদনের সুখ খুঁজছেন নরেন্দ্রনাথ। সদ্যযৌবনা অভিনেত্রীও সে দিন হয়তো প্রথম বঙ্কিমবাবুর ভাষায় নিজের সংলাপ তৈরি করেছিল---‘এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর।’ আমৃত্যু সুশীলা তার এই প্রাণেশ্বরকে ছাড়েনি। বাতাসে তখন বার বার গুঞ্জন উঠছে --- কোন-কোন বিপুল বিত্তবান বাবু কয়েকশো টাকায়, কেউ বা হাজার টাকায় কলকাতার এই ‘প্রাইমা ডোনা নাইটিঙ্গেল’-এর এক রাত্রির সঙ্গ চাইছেন। কত মুগ্ধজন তার জন্য উন্মাদ! কিন্তু সুশীলার সমর্পণ পর্ব যে শেষ! সেই যে ১৪ -১৫ বছরেই বাঁধাধরা জীবনের হিসেবের বাইরে সে পা রেখেছিল, হিসেব কখনওই তার আর দখল পায়নি। কোনও দিন সুশীলাবালা তার একমুখী প্রেমকে কলুষিত করেনি, কোনও দিন অবিশ্বস্ত হয়নি নরেন্দ্রনাথের প্রতি। মিনার্ভার দুরবস্থায় নরেন্দ্রনাথ শুধুমাত্র সুশীলাবালাকে পুরোপুরি দখলের লোভে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে মিনার্ভার দায়ভার নিলেন, গিরিশচন্দ্রকে সামনে রেখে তার অস্থির মানসিকতা কিংবা উচ্চাশার ঘুড়ি উড়ছে তখন! তত দিনে সুশীলাবালা নরেন্দ্রনাথকে ঘর বাঁধতে রাজি করিয়েছে। কিন্তু এই নরেন্দ্রনাথই আরও বড় উচ্চাশায় আর অস্থিরতায় গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে এক দিন তাঁর এগ্রিমেন্ট বাতিল করে দিলেন। গিরিশবাবু মিনার্ভা ছেড়ে গেলেন, কিন্তু সুশীলাবালা নরেন্দ্রনাথকে ছেড়ে যায় কেমন করে? গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে প্রায় সব গুণী শিল্পীই মিনার্ভা ছেড়ে গেছেন। একের পর এক নিজের জলসা বা প্রযোজনায় নীরক্ত নাটক নামাচ্ছেন নরেন্দ্রনাথ, সঙ্গে একমাত্র আকর্ষণ সুশীলাবালা। সুশীলার নামে দর্শক আসেন, শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে ফিরে যান। অজস্র দেনায় আচ্ছন্ন নরেন্দ্রনাথ নিজেকে শেষ পর্যন্ত দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন। সর্বস্বহারা নরেন্দ্রনাথকে নিয়ে একাই সংসারযুদ্ধ শুরু করলেন সুশীলাবালা, সকলের চোখের আড়ালে এক বীরাঙ্গনার লড়াই। ১৯১৪-র ২৪ জুন পর্যন্ত সুশীলাবালা এক নাগাড়ে কাজ করে চলেছিল, তত দিনে সুশীলা সন্তানসম্ভবা। প্রবল পরিশ্রমে, নরেন্দ্রনাথকে সুস্থ আর স্বচ্ছল রাখার একরোখা প্রতীক্ষায় সে ভুলে গেল যে তার নিজের শরীরে নানা রোগের উপসর্গ। নরেন্দ্রনাথ সুশীলাবালার সঙ্গে ঘর করেছেন, কিন্তু তাঁকে ঘরনির ন্যায্য সম্মান দেননি কোনও দিন। সম্ভবত সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারটিতেও তার প্রবল আপত্তি ছিল। মৃত সন্তান প্রসবের পর অসুস্থ দুর্বল সুশীলাবালা কিন্তু ডাক্তারদের নিষেধ উপেক্ষা করেই আবার স্টারে নিয়মিত অভিনয় শুরু করলেন। যে কোনও মূল্যে নরেন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরে রাখার সে এক আত্মঘাতী প্রয়াস। ১৯১৫-র ৩ জানুয়ারি সুশীলাবালার ৩১ বছরের জীবন যখন শেষ হয়ে গেল, নরেন্দ্রনাথ তার আগে থেকেই নিরুদ্দেশ। সুশীলাবালার মৃত্যু নিয়ে রহস্য এখনও মেটেনি। অধিকাংশই বলেন, আত্মহত্যা, কেউ কেউ বলেন রোগে মৃত্যু। সে যুদ্ধে বিনোদন-লোভী উচ্চাকাঙ্খী এক স্বার্থপর তরুণ জমিদারকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেও স্ত্রীর সম্মান না পাওয়া এক অভিনেত্রীর মৃত্যুরহস্য নিয়ে কে পোস্টমর্টেমের দাবি তুলবে? তবু তার অকালপ্রয়াণের পর জনপ্রিয় অভিনেত্রীর শবযাত্রায় অনুগমন করেছিলেন অসংখ্য মানুষ, বহু অনুরাগী ভদ্রজন! সে যুগে এমন সুভদ্র শবযাত্রার দৃশ্য বিরল ছিল। সে দিন সুশীলার উদ্দেশে রচিত হয়েছিল বেশ কিছু সমর্থ শোক-কবিতা। সে যুগে সাধারণ রঙ্গালয়ের কোনও অভিনেত্রীর ভাগ্যে এমন দুর্লভ সম্মানপ্রাপ্তি ঘটেনি। কিন্তু এ সবই মৃত্যুর পর, মৃত্যুর আগে? খ্যাতির আলোকস্তম্ভ ছেড়ে সব কেড়ে নেওয়া অদৃষ্টের অন্ধকারে নরেন্দ্রনাথকে নিয়ে একান্তে সে, শুদ্ধ সংসারীর মতো বাঁচার স্বপ্ন দেখছে শান্ত লড়াকু সুশীলাবালা। ১৯১২-র ৯ ফেব্রুয়ারি খবর এল গিরিশচন্দ্রের প্রয়াণ ঘটেছে। সুশীলাবালা তখনও অগ্রগণ্যা অভিনেত্রী। গিরিশচন্দ্রের শিক্ষণ আর আশীর্বাদধন্যা সব অভিনেত্রীদের সম্মিলিত করে চিরপ্রশান্ত সুশীলার সেই প্রবল শোকে অন্য চেহারা, তখন সে প্রতিবাদিনী নেত্রী। কারণ গিরিশ-প্রয়াণের পর কলকাতার টাউন হলে সারদাচরণ মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা বর্ধমানের রাজা বিজয়চাঁদ মহতাবের সভাপতিত্বে যে বিরাট শোকসভার ডাক দিলেন সেখানে মৃতের প্রতি সম্মান আর শুদ্ধতার অজুহাতে অভিনেত্রীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছিল। প্রতিবাদে সুশীলাবালার নেতৃত্বে অভিনেত্রীরা তাদের শিক্ষক ও পিতৃতুল্য গিরিশচন্দ্রের প্রতি প্রকাশ্যে শোক প্রকাশের অধিকার দাবি করেছিলেন। দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। প্রতি বার কলকাতার সেই নীতিবাগীশদের প্রতি ঘৃণায় আর ক্ষোভে ফুঁসে ওঠা সুশীলাবালার নেতৃত্বে শেষ পর্যন্ত ১৮ সেপ্টেম্বর অভিনেত্রীদের তরফে একটি উল্লেখযোগ্য শোকসভা হয় স্টার রঙ্গমঞ্চে। সেই প্রেক্ষিতেই সুশীলাবালার ক্ষুব্ধ জিজ্ঞাসা ছিল--- ‘নারীকে বেশ্যা বানায় যাঁরা তাঁরা বেশ্যাকে ঘৃণা করে কোন মুখে?’ শোকসভায় সুশীলাবালা বলেছিলেন, ‘... পতিতা আমরা, সমাজ বর্জিতা বটে --- কিন্তু আমরা মানুষ। ... প্রিয়জন বিরহে যদি ক্রন্দনের অধিকার থাকে, ... বুকফাটা হাহাকারে যদি দোষ না থাকে তবে আমাদের শোক দূষণীয় হইবে কেন?’ সে যুগে অভিনেত্রীদের এই প্রতিস্পর্ধা ঐতিহাসিক ভাবে একটি বিরল ঘটনা। হয়তো শূন্যগর্ভ আভিজাত্য আর খবরদারিতে অভ্যস্ত (সুশীলাবালার) একমাত্র প্রেমিকটি চিরপ্রশান্ত চিরঅনুগতা সুশীলাবালার এই ক্ষুব্ধ প্রতিবাদী মূর্তিটির কথা আগে ভাবতেও পারেননি। তিনি এ বার ভাবলেন, এবং বহু দিন এক জায়গায় আটকে থাকা জমি হারানো জমিদারমশাই অভ্যস্ত অস্থিরতায় বছর দুয়েকের মধ্যে নতুন জমির খোঁজে গোপনে বেরিয়েও পড়লেন!--- তাঁর এত দিনের আশ্রয় আর প্রেম সুশীলাবালা তখন একা, মৃত্যুর মুখোমুখি!

সূত্র: এই সময়, রবিবারোয়ারি, ৮ মার্চ, ২০১৫,

সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/28/2020



© C–DAC.All content appearing on the vikaspedia portal is through collaborative effort of vikaspedia and its partners.We encourage you to use and share the content in a respectful and fair manner. Please leave all source links intact and adhere to applicable copyright and intellectual property guidelines and laws.
English to Hindi Transliterate