পাতা উল্টাতে উল্টাতে কাগজের একটা জায়গায় গিয়ে চোখটা আটকে গেল নীহারদেবীর। নারী দিবস উপলক্ষে কত্ত আয়োজন। কেউ বলছে কেনাকাটায় ডিসকাউন্ট, কেউ বলছে অল্প খরচে হেলথ চেক আপ, কারও বা রসনাতৃপ্তির পাঁচ তারা বন্দোবস্ত। নিজের মনে হাসেন তিনি। এখন বয়স ৮৫ বছর। ছোট্ট বয়সে বিয়ে হয়ে এ দেশে চলে আসা। পায়ে বেড়ি পড়ল তখনই। যৌথ পরিবার, নানা গঞ্জনা, ঘটি-বাঙালের চিরন্তন খাদ্য কোন্দল। ধূসর স্মৃতি উঁকি দেয়। নীরবে শুধু চোখের জল ফেলেছেন। আর তিন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে নিজেই সাহস জুগিয়েছেন। ‘আমাকে পারতেই হবে।’ সে দিন তাঁকে উত্সাহ দেওয়ার কেউ ছিল না। আজও যেমন নেই লক্ষ লক্ষ নীহারের পাশে। পণের জন্য মেরে ফেলা, ভ্রূণ হত্যা, শিশু কন্যা হত্যা, নারী পাচার, যৌন হেনস্থা, ধর্ষণ --- এ সব তখনও ছিল, এখনও আছে। বরং তখন হয়তো বা সামান্য কমই ছিল। যেখানে বিশ্ব জুড়েই ছবিটা এতটা ভয়ানক, সেখানে কেন এমন উদযাপন? তাই স্বাভাবিক ভাবেই যে প্রশ্নটা উঁকি দিচ্ছে, তা হলে কি নারী দিবসও ভ্যালেন্টাইনস ডে, মাদার্স ডে-র মতো ব্যবসায়িক উপলক্ষ হয়ে দাঁড়াল? সে কথা অবশ্য মানতে নারাজ ‘দ্য তাজ’।
তাদের মতে, এই দিনটা ঐতিহাসিক। সে জন্যই মহিলাদের জন্য আয়োজন। তাঁদের শ্রদ্ধা জানানো। এই প্রজন্মকে কুর্নিশ করা। প্রায় একই মত দ্য পার্কেরও। সেখানকার জনসংযোগ আধিকারিক সুপ্রিতা সিং বললেন, ‘না না এর মধ্যে কোনও ব্যবসায়িক দিক নেই। এই দিনটার গুরুত্ব আলাদা। সে কারণেই আমরা বিশেষ আয়োজন করি।’ কিন্তু ব্যবসায়িক দিক থেকে যে এর তাত্পর্য আছে, তা প্রকারান্তরে স্বীকারই করে নিল একটি মাল্টি চেন রিটেল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আধিকারিকের মতে, ‘দেখুন, কোনও কিছুই কি ক্ষতি করে হয়? এই ধরনের আয়োজনে আসলে রথ দেখা, কলা বেচা দুই-ই হয়। মানে মহিলাদের শ্রদ্ধাও জানানো হচ্ছে আবার ব্যবসায় লাভও হচ্ছে।’ সে কথার সঙ্গে সহমত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কুণাল চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘দেশ জুড়ে মহিলাদের সংকট বেড়েই চলেছে। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, নারী শরীরকে পণ্য হিসেবে তুলে ধরা, গার্হস্থ্য হিংসা --- থামার কোনও লক্ষণই নেই। তাই পাঁচতারা হোটেলগুলো যখন নানা অফার দেয়, সে ক্ষেত্রে মহিলারা তখন হয়ে যান টার্গেট গ্রুপ, কখনওই তা স্ট্রাগল আর সংগঠিত করার বার্তা হতে পারে না।’ এই নিয়েই কথা হচ্ছিল সোমা, ঐন্দ্রিলাদের সঙ্গে। সোমা দত্ত একটি সংস্থার ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রেনার। তাঁর মতে, ‘এই ধরনের অফারগুলো খুবই অদ্ভুত। যাওয়া মানেই তো অনেক টাকা খসবে। আর কিছু মহিলা নিশ্চয়ই এই হুজুগে মাতবেনই। ফলে লাভের অঙ্ক ঠিকই থাকবে।’ তাঁরই সহকর্মী দোয়েল রায়। তিনি অবশ্য বললেন, ‘ক্ষতি কী! নানা সময়ে যেমন ডিসকাউন্ট সেল চলে, তেমনই দিচ্ছে। আমার তো বেশ ভালোই লাগে। সফটওয়্যার কর্মী ঐন্দ্রিলা মজুমদারের মতটা একেবারেই ভিন্ন। তিনি বললেন, ‘সমান বেতন ও ১০ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ছিল নারী আন্দোলনের তাত্পর্য। তা এখনও কোথাওই হয়নি। সে দিকে নজর না দিয়ে আমরা কেন অন্য দিক নিয়ে ভাবছি? বরং তা কী করে কার্যকর করা যায়, সেটাই আমাদের ভাবা উচিত। ডিসকাউন্ট, ফুড -- এ সব নিয়ে আমি আগ্রহী নই।’ আর ঠিক এই কথাটাই বুঝিয়ে বললেন নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ। বললেন, ‘বিষয়টা অনেকটা ভ্যালেন্টাইনস ডে’র মতো হয়ে উঠেছে। সেখানে যেমন দামি গিফটে ভালোবাসা মাপা হয়, এখানেও তেমনই দেখা হচ্ছে এক জন মেয়ের প্রতি কতটা পয়সা খরচ করতে পারছেন। অথচ নারী আন্দোলনের মূল যে তিনটি দাবি, তা কিন্তু পুরোটা এখনও পূরণ হয়নি।’ অন্য দিকে, মেয়েরা যতটা এগোতে পেরেছে, সেটাকেই মূলধন করে নিয়েছে বিভিন্ন সংস্থা। সিএসআর হিসেবে নিয়ে তারা এই দিনটাকে প্রোডাক্ট প্রোমোশনের কাজে লাগিয়েছে। শাশ্বতীদেবীর কাছে এটা প্রত্যাশিত। কারণ তিনি মনে করছেন উপযুক্ত বিকল্প তৈরি করা যায়নি। সে সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে অন্যরা। তাই নীহারদেবী বলেন, ‘এ সব কেন, কার জন্য?’ আবার একই সঙ্গে প্রশ্ন করেন, ‘ওই নির্ভয়া মেয়েটার অবস্থা দেখ, বেচারি মারা গিয়েও শান্তি পেল না।’ তাঁর কাছে এই সব অর্থহীন। তেমনই অর্থহীন ভারতের কোনও গণ্ডগ্রামের দলিত কন্যার কাছে, কোনও ধুঁকতে থাকা দিনমজুরের ঘরে। তারা শুধু স্বপ্নই দেখে। তৈরি হয় ভাবনার পরিসর। কিন্তু গেয়ে উঠতে পারে না, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় …
সূত্র: এই সময়, ৮ মার্চ, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/26/2019