অসমীয়া   বাংলা   बोड़ो   डोगरी   ગુજરાતી   ಕನ್ನಡ   كأشُر   कोंकणी   संथाली   মনিপুরি   नेपाली   ଓରିୟା   ਪੰਜਾਬੀ   संस्कृत   தமிழ்  తెలుగు   ردو

লং মার্চ

লং মার্চ

মাত্র ষোলো বছর বয়স থেকেই একটা মুক্তির খোঁজ করেছিল মেয়েটা। বাবার পরিচয়ে বড় হয়ে ওঠা এই ষোলোটা বছরে যেন বারবার মনে হতো, ‘ইস! যদি আমাকে কেবল আমার নামে কেউ চিনত …’। মা বলতেন, না, ও ভাবে হয় না। বাবার নামেই নাকি মেয়েদের পরিচয়, বিয়ের আগে পর্যন্ত। আর বিয়ের পর স্বামীর পরিচয়ে পরিচিত হওয়াটাই একটা নিয়তি। মা অবশ্য তাকে এও বলত, ভালো লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করতে পারলে হয়ত চিনতে পারে লোকজন। কিন্তু সে তো অনেক দূরের কথা….আজন্ম বেড়ে ওঠা মফস্সলের জীবন যেন একটা শান্ত তটিনীর মতো।

একটা গতি আছে, কিন্তু বেগ বড়ই কম। বারো ক্লাসের পরীক্ষাটা শেষ করার পর কলকাতার কয়েকটা কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ট্রেনের জানলায় বসে এই সবই ভেবেছিল সে। তার চোখের সামনে ফিরে ফিরে ভেসে উঠছে, ইংরেজ আমলের বড় বড় থামওয়ালা কলেজ। তার বড় বড় ফটক আর সেই সিঁড়িটা। আবার, রোয়াক বাঁধানো বড় বড় বাড়ি আর প্রশস্ত মাঠ। সামনেই একখানি ঝিল। একটা কাঠের ব্রিজ দিয়ে এ পার -ও পার হওয়ার ব্যবস্থা আছে। রঙচঙে ছেলেমেয়ে। পাশাপাশি জোড়ায় জোড়ায় বসে রয়েছে। কী সুন্দর ওরা! ওদের জামা, জুতো…পায়ের মোজা, মাথার ক্লিপ…সব যেন ছবির মতন। কিন্তু শহরের কলেজে ভর্তি হওয়ার পর সমস্ত ছবি কেমন যেন একটু একটু করে বদলাতে লাগল। ঝাঁ চকচকে কলেজের দেওয়াল মিললেও মিলল না তেমন থাকার জায়গা। হস্টেলের ঘরগুলো কেমন যেন! দু’বেলা খাওয়া পাওয়া গেলেও কলেজ থেকে ফিরেই যে খেতে ইচ্ছে করে, সেটা এখানে কেউ বোঝে না।

আবার, প্রথম প্রথম কলেজের সারা দিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে এলে কেউ ডেকে রাতের খাবার দেয় না। রাতের খাবারে ডাল, তরকারি আর কোনও কোনও দিন দু-এক টুকরো মাছ। হস্টেলে আসার প্রথম দিকে বাবা-মা’কে ফোন করে রোজ রাতের মেনু বলত। সেই বার গরমের ছুটিতে বাড়ি ফিরে গিয়ে জানতে পেরেছিল, ওর বাবা-মা আর এখন রোজ মাছ কিনে খান না। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর এসেছিল, ‘তুমি পাও না মা, আমরা মুখে রোজ তুলি কী ভাবে।’ তার পর থেকে বাড়িতে রাতে ফোন করাটা কাটিয়ে দিয়েছিল। রাতের ফোন করাটা কাটিয়ে দিলেও মেসবাড়ির ঘরটায় তো ওর মা কখনও থাকেননি। কলেজ স্ট্রিটের ধারে অথবা লেক গার্ডেন্স বা যাদবপুরের কলোনি এলাকার মেস। জানলা খোলার উপায় নেই। জানলার নীচ দিয়ে নর্দমা। দীর্ঘ দিনের নোংরা জমে গন্ধ আর মশার দায়ে টেঁকা দায়। ওরা রোজ রাতে এক সঙ্গে খাবার নিয়ে ঘরে চলে আসত। তার পর অনেক রাত করে খেত। মেসবাড়িটা হস্টেলের মতো নয়। আরও অনেক ঘিঞ্জি, এখানে সবাই যেন সবার গায়ের উপরে সারা ক্ষণ সেঁটে রয়েছে। ঘুমের ঘোরে হাত বাড়ালেই পাশের খাটে বন্ধুর গায়ে হাত লেগে যেতে পারে। ঘুমের মধ্যেই বন্ধু বিরক্তি প্রকাশ করবে। একটু বড় দিদি পাশে থাকলে, আধো ঘুমে বিছানায় বসে মাথায় হাতও বুলিয়ে দিতে পারে। তার পর একটু ইয়ার্কি মেরে প্রশ্নও করতে পারে, ‘কী রে ধেড়ে বয়সে মায়ের জন্য মন কেমন করে নাকি!’ ‘ধ্যেত্ তা কেন করবে? আসলে এই সময় বাড়িতে পিঠে-পুলি হয়। খেতে ইচ্ছে করছিল।’ এই খাটে শুয়েই এক দিন ও শুনতে পেয়েছিল, কারা যেন ভুল করে ওকে সুমন্তিকা বলে ডেকেছিল। ও তখন গভীর ঘুমে অচেতন। সবাই সন্দেহ করছে আর বলছে, ‘বোধহয় ওডি (ওভারডোজ) কেস! আর বাঁচল না।’ না না ওডি কেন হবে? পুরনো গ্যাসের পাইপলাইন থেকে লিক করা গ্যাস প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল সুমন্তিকার। সেটা প্রথমে কেউ বোঝেনি। ও বুঝেছিল। অচেতন অবস্থায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে বলার চেষ্টাও করেছিল। আসলে সুমন্তিকা তো গত তিন বছর ধরে ওর সঙ্গেই থাকে। অস্ফুট শব্দ শোনার দায় কারও ছিল না। পুলিশ এসে প্রমাণ করার পর সবাই ‘আহা রে, বেচারা’ মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিল।

কলকাতায় এসে মাস ছ’য়েক থাকার পর প্রথম বাড়ি ফিরে যেন সব কিছু আবিষ্কার করার মতো। বাড়িতে কাচা জামা কাপড়গুলো কী ফর্সা! বাড়িতে রান্না-মাসির করে দেওয়া নিম-বেগুনও কী ভালো। বাড়ির বাথরুমটা কত পরিস্কার। এখানে যখন তখন চাইলেই খেতে পাওয়া যায়। সন্ধে বেলার চিঁড়ে-দুধ, রোল-চাউমিনের চেয়ে ঢের ভালো। অথচ, এগুলোকেই ও এত দিন এক্কেবারে ভালোবাসত না। কী বোকাই না ছিল তখন! এ সব উপলদ্ধি যে ওর একার নয়, একটা সন্ধেয় সেটা প্রমাণ হল। মেসের বন্ধু মুনকিও একই কথা বলে। ওদের বাড়িতে বিশেষ দিনে তুলাইপাঞ্জির ভাত হয়। লালশাকের সঙ্গে পাতে একটু বাড়িতে বানানো কাসুন্দি দেয় মুনকির মা। আর ওর মা? কাসুন্দি একেবারেই কেনেন না। তবে, গরম ভাতে এক টুকরো মাখন আর মাছভাজা দিয়ে স্কুল যাওয়ার আগে ভাত মেখে দিতেন। এখানে তো সকালে কেউ খেতে ডাকে না। না খেয়ে চলে গেলেও কেউ কিচ্ছুটি বলে না। মুনকি ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে বাড়ি যায় প্রতি বার। কিন্তু কলেজে এসে এসেই তো বয়ফ্রেণ্ড হয় না। তা ছাড়া মুনকির বয়ফ্রেণ্ড তো স্কুলে থাকতে হয়েছে। ওর স্কুলের বন্ধুরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তার মধ্যে ওর বয়ফ্রেণ্ড কেউ না। আর এখানে সব বয়ফ্রেণ্ডদের গার্লফ্রেণ্ড আছে। ওরা এক সঙ্গে শান্তিনিকেতন বেড়াতে যায়। বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে শান্তিনিকেতন বেড়াতে যাওয়া যায় নাকি! ইস! মা শুনলে খুব কষ্ট পাবেন। বাবা সটান হাজির হলে বিপদ ঘটে যাবে। প্রথম বার, কলেজের ইলেকশনে ও ভোট দিতে গিয়েছিল। ওদের সে বার ইলেকশনে খুব মারামারি হল। যারা সব মার খেয়ে কুপোকাৎ হল, তাঁদের সবাইকে ও চেনে না। তবে ওরা মাটিয়ে শুয়ে পড়েও স্লোগান দিতে ছাড়েনি। এটা বেশ নতুন লেগেছিল। ইলেকশনের দিন সবাই খুব টেনশন করে। ঘনঘন বিড়ি সিগারেট খায়। ওকে নিয়ে কফি হাউজের তলায় স্বপনদা’র দোকানে একটা বড় সিগারেট কিনে দেয় ময়ূরী। বাদামি রঙের সিগারেট। ঠোঁটে ঠেকলে লবঙ্গের গন্ধ পাওয়া যায়। মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ আসে। ওই সিগারেটটা ইলেকশনের পরও এক বার ওরা ক্যান্টিনে বসে খেয়েছিল। তার পর থেকে প্রায়শই খেত। ফেস্টের দিন বা উঁচু ক্লাসের দিদিদের ফেয়ারওয়েল দেওয়ার দিন। ওই দিন ওরা সবাই শাড়ি পরে এসে একে একে সিগারেট জ্বালিয়ে বসেছিল। শাড়ি আর সিগারেট, কম্বিনেশনটাই যেন কেমন আলাদা গোছের। তাই একটা লম্বা ফোটোসেশনও করে ফেসবুকে পোস্ট করে দিল। তার পর থেকে মেসে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়াটা একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি দিল। মুনকি এর মধ্যে খুব বেশি থাকত না। তবে রিংকি, স্নিগ্ধা বা পারো’র মতো বন্ধুরা থাকত। স্নিগ্ধা এক বার বাড়ি থেকে ঝেড়ে বাবার মদও এনেছিল। কালো প্লাস্টিকের বোতলে মাথাপিছু এক ছিপি। তাই খেয়ে সে কী গড়াগড়ি। গন্ধে বমি উঠে এসেছিল। মুনকি বিরক্ত হয়ে সে বার বাড়ির মালকিনকে বলে দিল। তার পর একধার সে বকুনি জুটল সবার কপালে। তিন দিন কেউ মেসের খাবার খেল না। এক জন, অন্য জনের ঘাড়ে দোষ চাপাল। কিছু দিন ঝগড়া চলল। এই ঝগড়ার কথাটা কলেজে বিনয়কে বলেছিল। বিনয় গল্পটা শুনে খানিক হ্যা হ্যা করে হেসে বলল, ‘চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ বিনয়ের সঙ্গেই ওর কলেজে সব চেয়ে বেশি সময় কাটত। বিনয় ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকত। ওপরের ক্লাসে ও যখন ক্লাস করতে যেত, বিনয় তখন ওর অপেক্ষায় ক্লাস-টাস শিকেয় তুলে ক্যান্টিনে বসে থাকত। আর ওর ক্লাস হয়ে গেলেই ছুট ছুট। কলেজ স্ট্রিট, বিবেকানন্দ রোড ক্রসিং, ওয়াইএমসিএ হয়ে ফের ফেরৎ আসা। বিনয়ও ওরই মতো কলকাতার ছেলে নয়। বাইরের। ও হস্টেলে থাকত। বিনয় মাঝেমধ্যেই অভিযোগ করত, হস্টেলে ছেলেদের সঙ্গে মতে একদম মেলে না। এই হস্টেলে থাকলে পড়শোনা হবে না বিনয়ের। অনেক খুঁজে খুঁজে বিনয় আর নীলাদ্রি একটা বাসা ভাড়া নিল। টালিগঞ্জ মেট্রোর কাছে। ওটা বেশ মজার ছিল। তখন, যাদবপুর থেকে একটা অটোয় যাওয়া-আসা করা যেত। বিনয়দের ওই বাসায় একটা রান্না করার গ্যাস ছিল। ওরা কত কী রান্না করার চেষ্টা করত! মুরগির মাংস, চাটনি আর সিমাইয়ের পায়েস। এক বার সারা দিন বিনয়ের ফোন বেজে গেল। কলেজেও নেই বিনয়। বিনয়ের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারল বিনয়ের সারা রাত শ্বাসকষ্ট হয়েছে। নীলাদ্রি বাড়িতে নেই। ডাক্তারের খোঁজে বেরিয়েছে। বিনয়ের বাবার এসে পৌঁছতে আরও বারো ঘণ্টা লাগবে। সন্ধের দিকে মন সায় না দিলেও বিনয়দের ঘরটা ছেড়ে মেসে ফিরে গিয়েছিল। তার পর প্রায় দিন পনেরো কেটে গেল …তার পর এক দিন বিনয়ের ফোন এল। জানাল ‘ভালো আছে’।

সে বার কলকাতা জুড়ে সবার ডেঙ্গু হল। হস্টেলের কেউ বাদ পড়ল না। কে কাকে দ্যাখে! বাড়িতে খবর গেল। ওর বাড়িতেও গেল। বাবা কোন একটা কাজে মুম্বই যাওয়ায় কেউ আসতে পারলেন না। লোকাল গার্জেন ডাক্তারকাকু এসে নিয়ে গেলেন তাঁদের বাড়িতে। হাসপাতালে ভর্তি করার মতো অবস্থা। কিন্তু বাড়ির লোক আসেনি। বিনয় খবর পেলেও দেখতে আসার সাহস জোগাতে পারল না। ডাক্তারকাকুর তত্ত্বাবধানে তাঁদের বাড়িতেই চিকিত্সা চলল। একে অন্যের বাড়ি, তায় রোগগ্রস্ত। অস্বস্তির সীমা নেই। শরীরের ক্ষমতাও বিশেষ নেই। শুয়ে শুয়ে মা-বাবার উপরে রাগ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। বিনয়ের সঙ্গেও আর কোনও দিন কোনও কথা বলবে না বলেই ঠিক করল। দিন সাতেক পরে, যখন বাবা নিতে এলেন, তখন জানাল ও ফিরবে না, সুস্থ হয়ে উঠেছে। এখন হস্টেলে ফিরিয়ে দিলেই চলবে। সে কথা অবশ্য তখন কোনও ভাবেই খাটেনি। কলকাতার জীবনে একটা তরঙ্গ ছিল। সেটা হয়তো একটু বেশি বুঝতে পেরেছিল কারণ ও বাইরের মেয়ে। এক হস্টেল থেকে অন্য হস্টেল, এক মেস থেকে অন্য মেস। কোনও জায়গায় মালকিনরা খুব ভালো। প্রাণে মমতা আছে। আবার কোনওটায়, একেবারে ওয়ান পাইস ফাদার মাদার। এক চিলতে জমি ছেড়ে কথা বলবে না। বাবা শুরুর দিকটায় মাসে এক বার করে আসতেন। পরের দিকটায় সেটা কমে গেল। পরীক্ষার সময়গুলো খুব কষ্টের। যেখানে পরীক্ষার সিট পড়ত, সেখানে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। পরীক্ষা শুরু যে দিন হতো, সে দিন ঠিকানা খুঁজে যেতে হত। পরীক্ষা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখা যেত, কত ছেলেমেয়ের বাবা-মা’য়েরা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। উত্সুক মুখে অপেক্ষা করছেন প্রশ্নপত্র কেমন হল তা জানতে। ওদের তো কেউ নেই। অনাথের মতো হ্যারিসন রোড ক্রসিংয়ের পরীক্ষা সেন্টার থেকে হেঁটে কলেজ স্ট্রিট ফেরা। সেখান থেকে ট্যাক্সি করে মেসে বা হস্টেলে। এক বার তো পরীক্ষার সময় পা-টাই মচকে গেল। হস্টেলের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বেকাদায় পড়ে গেল। খুব টেনশন ছিল সেই বার। কী করে পরীক্ষা দিতে যাবে? এক দিন মেসের এক দিদি পৌঁছে দিয়েছিল। পরের দিনগুলো অবশ্য হাতে সময় নিয়ে একলা একলাই যেত। একলা চলতে চলতে চার পাঁচ বছরে এটা ভুলেই গিয়েছিল, একটা মুক্তির নেশা নিয়ে শহরে পা রাখলেও, পরিচিতি সহজে কেউ দেয়নি। আরও বেশি করে ছিন্নমূল করেছে। শহরে আসার সময়টায় তখনও প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি। কিন্তু আজ ও ভাবে, তখন থেকেই তো এই শহর ওকে ওর নামেই চেনে। ওর বাবার নাম কেউ জানে না। বাড়ির ঠিকানা কেউ জানে না। ওর জেলার নামেও চেনে কেউ কেউ। তাই বন্ধুদের বাড়িতে গেলে শুনতে হয়, ‘ও তুমি অমুক জেলার মেয়ে! তোমার মুখের ভাষায় তো কোনও টান নেই।’ টান নেই? টানটা হয়তো ভাষায় নেই। যেখানে আছে, তার খবর আপনাকে দিতে যাব কেন শুনি। ইচ্ছে করত মুখের উপর বলে দিতে, বন্ধুর কথা ভেবে বলত না। তা ছাড়া বন্ধুদের বাড়িতে বা স্থানীয় আত্মীয়দের বাড়িতে ওকে অনেক সময়ই গিয়ে থাকতে হত। নানা সুবিধে অসুবিধেয় পড়লে গত্যন্তর থাকত না। শহরের বন্ধুদের বাড়ি কিম্বা আত্মীয়দের বাড়ি, ঘরদোরের সাজগোজ অন্য রকম। কিন্তু শহরের লোকেদের সেই সব জিনিসপত্র ঘরে সাজিয়ে রাখা নিয়ে একটা যেন দম্ভ আছে। সেই দম্ভের চোটে তারা নিজেরাও নিজেদের বাড়ির সম্পূর্ণ সুখটুকু উপভোগ করতে পারে না। এক বার তো মাসির বাড়িতে গিয়ে ফ্রিজের গায়ে লাগানো একটা ম্যাগনেট স্টিকার হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাওয়ায় কী অপমানিতই না হতে হল। ‘ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আনা .. এখানে পাওয়া যাবে না। পাওয়া গেলেও অনেক দাম …. কেনা মুখের কথা নয়।’ এখানে এসে প্রথম প্রথম জামা-কাপড় নিয়ে একটা দীর্ঘ আলোচনা চলত হস্টেলে। কোন জামাটা ফ্যাশন ‘ইন’ কোনটা ‘আউট’। কারণ জামা-কাপড়েও যেন একটা অন্য রকম ব্যাপার ছিল শহরের মেয়েদের মধ্যে। বিভিন্ন ব্র্যান্ড, দামের নিরিখে বিচার.. এই সব। মজার ছিল, ওদের বেশির ভাগেরই ‘আউট’ গোছের জামাকাপড়ই বেশি ছিল। তাই হয় সেগুলোকে বহু চেষ্টা করে ‘ইন’ করে নেওয়া অথবা প্রচণ্ড উদাসীনতা দেখিয়ে ‘ইনটেলেকচুয়াল’-বনে যাওয়াটাই পরবর্তীকালে দস্তুর হয়ে উঠল। শহরে এসে আদব-কায়দাগুলোর মধ্যে একটা হল ডিনারের শেষে একটু ডেজার্ট। ওদের বাড়িতে শীতের রাতে শেষপাতে রসগোল্লা বা গুড় পাওয়া যেত। এক বার, অনুশ্রীদের বাড়িতে রাতের খাবার খেতে গিয়ে দেখেছিল সেখানে ডেজার্টের চল আছে। বাড়িতে বানানো পুডিং বা কাস্টার্ড অথবা ফ্রুট সালাডের একটা সস্তা ধরন দিয়ে সারা। এক দিন অনুশ্রীর মা খাবার টেবিলে বসেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার মা পুডিং বানাতে পারেন? মানে তোমরা বাড়িতে খাও?’

বাড়িতে পুডিং সত্যিই কবে খাওয়া হয়েছিল, মনে পড়ে না। উত্তর দিল, ‘মা খুব ভালো পায়েস বানাতে পারে।’ ..... ‘না না পায়েস-টায়েস অত করার আমাদের সময় হয় না আসলে। তা ছাড়া অত ক্যালোরির খাবার খাওয়াও তো স্বাস্থ্যকর নয়। তোমার বাড়িতেও বোলো যাতে একটু খাওয়া-দাওয়া সামলে রাখাই ভালো।’ কলকাতার লোকেদের এথিক্সটাই অন্য রকম। সবার একটা দেখনাই আছে, কিন্তু আন্তরিকতায় বড়োহাতটান। তার উপরে, ওর মতো হস্টেল বা মেসবাসীদের বোধহয় সবাই ভয় পেত। পাছে, নিয়মিত থাকার জায়গা দিতে হয়। এ ছাড়া এখানকার লোক কাউকে ঠিক অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে আলাদা করে ছাড় দেয় না। হিসেবটা কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেয়। তারই মধ্যে দু-একটা সেকেলে লোকের সঙ্গে আলাপ হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। তাঁদের নিজের পাড়ার অমুক কাকু, তমুক জেঠুর মতো লাগে। অনেককে দেখে নিজের বাবার মতোও লাগে।

তাঁদের সান্নিধ্য পেতে গেলে অনেক সময় অপ্রীতিকর হয়ে ওঠে। মানেটা উল্টে যায়। তখনই নিজের শহরের কথা কথা মনে পড়ে। বন্ধু-বান্ধব কাউকে ভালো লাগে না। কারণ ওদের মতো মানুষদের জন্য দু-এক জন বন্ধু আছে বটে, সেই বন্ধুত্বের পাশাপাশি উচ্চাকাঙ্খাও আছে। উচ্চাকাঙ্খার প্রতিযোগিতা আছে। তবে এই শহরের মর্মপ্রাচীরের সব চেয়ে বড় বিষয় হল, অচেনা থাকার বাসনা। পরিচিতির ঊর্ধ্বে-ভিড়ে মিশে যাওয়ার আনন্দ আর মুক্তি। চেনা হয়ে থাকার যে বাঁধন তাকে নিজের আকাশ খুঁজে নিতে বারবার এগিয়ে দিয়েছে, এখানে এসে না-চেনার খুশিই মেয়েটাকে আজ আশ্বস্ত করে। কারণ সুমন্তিকা বা সুবর্ণাদের মতোই ও নিজেও হয়ত চিহ্নহীন। অথচ কয়েকটা ঘটনা ওদের আপাতত মাইলস্টোন করে রাখে। তার পর ক্ষণে ক্ষণেই বদলে দেয় মুক্তির মানে।

আকাশের রঙ পাল্টে পাল্টে যায়। মনে মনে বলে, সুমন্তিকা সুমন্তিকা ওইখানে যেয়ো না কো তুমি, কয়ো নাকো কথা…..কী কথা…..সেই কথার জার্নিটা বোধহয় এ ভাবেই চলতে থাকে। এখনও চলছেই, চলবেও।

সূত্র: এই সময়, রবিবারোয়ারি, ৮ মার্চ, ২০১৫

সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/30/2020



© C–DAC.All content appearing on the vikaspedia portal is through collaborative effort of vikaspedia and its partners.We encourage you to use and share the content in a respectful and fair manner. Please leave all source links intact and adhere to applicable copyright and intellectual property guidelines and laws.
English to Hindi Transliterate