প্রশ্ন : প্রতিভা বসুর জন্ম-শতবর্ষ তো এ বার। এই ১৩ তারিখ। বলা তো যায়, রানু সোমের জন্ম শতবর্ষও। যিনি নজরুলের কাছে নজরুলগীতি, দিলীপ রায়ের কাছে দ্বিজেন্দ্রগীতি-অতুলপ্রসাদী এবং পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন, তিনি গান ছাড়লেন কেন?
দময়ন্তী বসু সিং : বাড়িতে সর্বদাই গান হত। আমার ছোটবেলায়, মা গাইছেন, আমি নাচছি, এ তো নিত্যকার ঘটনা। উনি ‘চাইল্ড প্রডিজি’ ছিলেন। তবে, ছোট থেকে গান খুব যে সচেতন ভাবে ভালোবেসে করতেন, তা হয়তো নয়। আমার দিদিমা-দাদু মেয়ের প্রতিভা বিকাশের জন্য অনেক কিছু করেছেন। তাঁরা যদি মেয়ের গুণ যত্ন করে নার্চার না করতেন, তা হলে সে সময়ে তাঁর প্রতিভা বিকশিত হত না। সে কালে রীতি বহির্ভূত ভাবে মেয়েকে ছোটবেলাতেই মুসলিম উস্তাদের কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিখিয়েছেন। ক্রমশ ঢাকা এবং কলকাতায় রানু সোমের গান বিশেষ সমাদৃত হয়। এর মধ্যে চিত্তরঞ্জন দাশ, দিলীপ রায়, সত্যেন বসুর পরিবারও তাঁর গানের প্রতিভার জন্য রানুকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। আর নজরুলের গল্প তো সবাই জানেন। ঢাকায় মা-দের বাড়িতে বসে অনেক গান লিখেছিলেন। উনি গান লিখতেন, সুর করতেন এবং রানুকে শিখিয়ে বলতেন গানটা করতে। সেই গানের খাতা আমার কাছে এখনও রয়েছে। পরে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যও পেয়েছেন। এত সব সত্ত্বেও আমরা কিন্তু মায়ের রেকর্ড আমাদের বাড়িতে দেখিনি। হতে পারে, দেশভাগের সময়ে অনেক কিছুর সঙ্গে রেকর্ডগুলো হারিয়ে গিয়েছিল। উনি বলতেন , ‘আমার গান শোনার যোগ্য নয়। আজকালকার মেয়েরা কী সুন্দর গান করে …।’ অনেকে মনে করেন, বুদ্ধদেব বসু চাইতেন না বলেই প্রতিভা বসু গান করলেন না।
এ কথাও ভীষণ অসত্য। তবে, বুদ্ধদেব তো সে অর্থে গানের কনেসর নন, কথার কনেসর। যে ভাবে রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী তাঁকে ছুঁয়ে যেত, নজরুল বা দ্বিজেন্দ্রগীতি তাঁকে হয়তো সে ভাবে স্পর্শ করত না। আরও একটা কথা, বিয়ের পর প্রতিভা এবং বুদ্ধদেব বহুকাল পর্যন্ত দু’কামরার বাড়িতে থাকতেন। এক ঘরে লেখকের আড্ডা, পাশাপাশি অন্য ঘরে তানপুরা-তবলা নিয়ে গান হয়তো সম্ভবও হত না বলেই প্রতিভা মনে করেছেন। তা ছাড়া সন্তানদের মানুষ করা এবং সংসার তো পাশাপাশি চলেছে। তবে বুদ্ধদেব চাইতেন, তাঁদের কবি-সাহিত্যিকের আড্ডায় স্ত্রীও থাকুন। বিয়ের পরে এক বার, হিমাংশু দত্তের গান রেকর্ড করেছিলেন যা, ‘প্রতিভা বসু’ নামে প্রকাশিত হয়, রানু সোম নয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিভা বসুর সম্ভাবনা বুদ্ধদেব টের পেয়েছিলেন এবং তার আরও বিকাশ চেয়েছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই গান আর সামনে আসেনি।
প্রশ্ন : ‘গায়িকা’ রানু সোম থেকে ‘সাহিত্যিক’ প্রতিভা বসু---এই রূপান্তর তো আপনার জন্মের সময় ….।
দময়ন্তী : কথাটা এক অর্থে ঠিক আবার এক অর্থে ঠিক নয়ও। কারণ, মা নিজে ছোট থেকে লিখতেন, পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন। বেশির ভাগই কবিতা। বুদ্ধদেবের একটা লেখা নাট্যরূপ দিয়ে এক বার ঢাকায় মঞ্চস্থও করেছিলেন। কিন্তু, বিয়ের পর যে আবহে এলেন, সেখানে কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডা। এক সময় জ্যোতিকাকা (জ্যোতির্ময় রায়) মজা করে বললেন, ‘ছোট গল্পের প্রতিযোগিতা হচ্ছে, আপনিও লিখবেন নাকি?’ মা তত্ক্ষণাৎ লিখতে বসে গেলেন। ‘মাধবীর জন্য’। তখন পুরস্কার পেয়েছিলেন, পরবর্তীকালে সিনেমাও হয়। প্রথম উপন্যাস ‘মনোলীনা’ (১৯৪৪) কবিতা ভবন থেকে প্রকাশিত হয়। আমার জন্মের পরবর্তী কালে অর্থাৎ চারের দশকে এসে সাহিত্যিক হিসেবে কলকাতায় মায়ের আত্মপ্রকাশ। উপন্যাসটির বিষয় এবং ভাষার আধুনিকতা লক্ষ করার মতো। বাবা বলতেন, ‘তোর মায়ের মতো সংলাপ বাংলা সাহিত্যে কেউ লিখতে পারে না।’ সুধীন দত্তকেও এ কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু, সেই ভাবে দেখতে গেলে তেমন পুরস্কার তো পাননি।
এ-কথা ঠিক যে, পুরস্কার হয়তো সব নয়। তবে, একটা স্বীকৃতি তো বটে।
মহিলারা মায়ের লেখার অন্ধ ভক্ত হলেও অনেকে বলতেন, পুরুষ সমাজের কাছে প্রতিভা বসু খুব গ্রহণযোগ্য নন। আমার মনে হয়, যখন প্রতিভা বসুর একের পর এক উপন্যাস এবং অন্য লেখা প্রকাশিত হচ্ছে, তারই সঙ্গে পরপর তাঁর কাহিনি চলচ্চিত্রায়িত হচ্ছে, তখন তাঁর স্বীকৃতি অন্য ভাবে পেলেন। সাগরময় ঘোষ, সন্তোষকুমার ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ বা অম্লান দত্তের মতো ব্যক্তিত্ব তাঁর লেখার অনুরাগী ছিলেন। একটা কথা কী জানো তো, ছোটগল্প আসলে খণ্ডকাব্য, তার শুরু এবং শেষটা খুব ক্রিটিক্যাল। প্রতিভা বসুর যে কোনও গল্পেই শুরু এবং শেষ ভীষণ অভিনব। উদাহরণ হিসেবে, ‘সুমিত্রার অপমৃত্যু’ও ‘বিচিত্র হৃদয়’ গল্প দু’টো ধরা যাক। আজও পড়লে মনে হয় কত আধুনিক --- প্রথম গল্পে হিন্দু-মুসলমানের প্রেম এবং দ্বিতীয় গল্পে দেখি মা এবং মেয়ে একই ব্যক্তির প্রেমে পড়ছে। এই রকম থিম তখন কোথায় ছিল? প্রতিভা বসু এই গল্প লিখছেন চারের দশকে। এই দশকের শেষে তাঁকে বাইরের জগৎ স্বীকৃতি দিল, যখন বসুমতী থেকে উপন্যাস লিখতে বলা হল। সেই উপন্যাস ‘মনের ময়ূর’। প্রকাশিত হল ‘নাভানা’ থেকে। সে সময় বুদ্ধদেব ‘কবিতা ভবন ’ প্রকাশনা ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিলেন। মাকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটা তিনি তত দিনে সম্পন্ন করে ফেলেছেন।
প্রশ্ন : ৮২ বছর বয়সে লিখলেন ‘মহাভারতের মহারণ্যে’৷ কিছু বিতর্ক হল। শোনা যায়, এই বই হয়ে ওঠার পিছনে আপনার নাকি অবদান ছিল?
দময়ন্তী : হ্যাঁ, ওই লেখার সঙ্গে আমি ভীষণ ভাবে জড়িত। শেষের দিকে মা ‘কমিশনড’ না হলে লিখতেন না। হয়তো তখন কল্পনার জগতে যেতে পারছেন না , বা নতুন কোনও আইডিয়া আসছে না। সেই সময়টায় প্রচুর পড়তেন। আমি তখন কানপুর আইআইটিতে। শিবনারায়ণ রায়ের ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকার ‘লাইফ মেম্বার’ ছিলাম। সেই পত্রিকার একটা সংখ্যায় দেখলাম মায়ের প্রবন্ধ, ‘নায়িকা সত্যবতী’। সেটা পড়ে আই ওয়াজ সো এক্সাইটেড অ্যান্ড সো মুভড! দেখলাম, প্রতিভা বসু ভীষণ নতুন কথা বলছেন। আমি কলকাতা এসে মাকে বললাম, তুমি অসাধারণ প্রবন্ধ লিখেছ। কিন্তু তোমার বক্তব্য এত অল্প কথায় বললে হবে না। ২০০০ টাকা মাকে দিয়ে বললাম এটা অগ্রিম, এই বইটি দিয়ে আমি প্রকাশনা শুরু করব। তখনও জানি না, আমি আদৌ কখনও কলকাতা ফিরতে পারব কি না , প্রকাশনা করা তো দূরস্থান। মা তো তখন হাসলেন, কিন্তু অচিরেই লিখতেও শুরু করলেন। বেশ কিছু মাস পর বললেন, ‘আমি তো অনেক পাতা লিখে ফেলেছি, তোকে এডিট করতে হবে।’ এডিটিং শুরু করলাম। বইটা আমাকেই মা উত্সর্গ করেন। সত্যিই এই বই দিয়ে আমার প্রকাশনা সংস্থা ‘বিকল্প’ শুরু। বই নিয়ে অনেক বিতর্কও আছে। তেমনই আবার অম্লান দত্ত, সাগরময় ঘোষ, শিবনারায়ণের মতো মানুষেরা মুগ্ধও হয়েছেন। ওঁর লেখায় চরিত্র হিসেবে মেয়েরা অনেক বেশি শক্তিশালী। এই সব কাহিনি যখন তিনি লিখছেন, তখন এখানে ‘মানবীবিদ্যা চর্চা’ বলে কোনও শাখা আসেনি।
প্রশ্ন : প্রতিভা বসুকে নারীবাদী লেখিকা বলা চলে?
দময়ন্তী : এ কথা সত্যি যে, প্রতিভা বসু যে সময় লেখা শুরু করেছেন, তখন পড়াশোনার বিষয় হিসেবে আলাদা করে ‘ফেমিনিজম’ বা ‘উওমেন স্টাডিজ’ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সে ভাবে আসেনি। পরবর্তী কালে আমাদেরও মাকে ‘নারীবাদী’ বলেই মনে হয়েছে। মজা করে মাকে বলতাম, ‘তোমার মতো ফেমিনিস্ট খুব কম দেখা যায়!’ আসলে, জীবনটাও তো একটা আয়না। প্রতিভা বসুর লেখা পড়লে দেখা যায়, তিনি নারীদের সব সময় জিতিয়ে দিয়েছেন।
তার মানে পুরুষকে তিনি হেয় করেননি। তাঁর মেয়ে চরিত্ররা উদ্ধত নয়। ‘ফেমিনিজম’ বা ‘নারীবাদ’ কথাটার মধ্যে যে ‘ঔদ্ধত্য’ রয়েছে, সেই বিষয়টা মায়ের লেখা বা স্বভাবের মধ্যে ছিল না। ঔদ্ধত্য বলতে আমি বোঝাতে চাইছি, এমন কথা --- ‘আমি নারী, আমি জন্ম দিতে পারি। সুতরাং আমার আর কারওকে দরকার নেই… ইত্যাদি।’ এ সব তিনি বিশ্বাসও করতেন না। ব্যক্তি জীবনে ছিলেন খুবই স্নেহশীল। সংসারের সব দায়িত্ব তাঁর। সে গয়না বিক্রি করে আমাদের স্কুলে ভর্তি করা হোক বা দোকানের দেনা মেটানো। আমার মনে হয়, প্রতিভা বসুর প্রথম দিকের উপন্যাস, ছোটগল্প খুব উচ্চতারে বাঁধা।
প্রতিভা বসু নারীবাদী কি না,তার থেকেও তাই আমার কাছে বড় কথা, তাঁর গল্প বলার ক্ষমতা, ভাষার ব্যবহার, সংলাপ লেখার দক্ষতা এবং থিম্যাটিক ভ্যারিয়েশন। তাঁর গল্প-উপন্যাসে ‘মহিলা’ ব্যাপারটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা বিষয়। আশপূর্ণা দেবীর পর প্রতিভা বসুর উত্থানটা ‘উত্থান ’ হিসেবে দেখা উচিত ছিল। প্রতিভা বসুর প্রতি যে অবিচার হয়েছে, তা তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। বুদ্ধদেবকে যে ভাবে বারবার আঘাত করা হয়েছে, তা এখন মনে পড়লে যেমন কষ্ট পাই, তেমন সাহিত্যের বৃহৎ পরিসর থেকে প্রতিভা বসুকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল ভাবলেও খারাপ লাগে। মনে হয়, ওঁর অনেক বেশি প্রাপ্য ছিল। প্রতিভা বসুর কাজের বিচক্ষণ মূল্যায়ন এখনও হয়নি।
সূত্র: এই সময়, ৮ মার্চ, ২০১৫, রবিবারোয়ারি
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/8/2020