রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ির সারি আর ফুটপাথ দিয়ে ছুটছে এক ঝাঁক স্বপ্ন। উস্কোখুস্কো চুল মেয়েগুলির। ভরপেট খাওয়াও জোটে না। তবুও স্বপ্ন ছোঁয়ার দৌড় থামে না ওদের। মাঠে প্র্যাকটিস করার জায়গা নেই ওদের। কারণ বছরের বেশির ভাগ সময় বারাসতের বড় মাঠগুলি থাকে মেলার দখলে। কাবেরী, নাজিয়া, সোনিয়া, রুম্পাদের ভরসা তাই ফুটপাথ।
ওরা প্রায় সবাই জাতীয় স্তরের অ্যাথলিট। সংবাদপত্রে ওদের ছবিও ছাপা হয়েছে বেশ কয়েক বার। তার পর অন্ধকার। কেউ আর ফিরে তাকায় না। বারাসতের ফুটপাথ ধরে চোয়াল শক্ত করে ছুটতে ছুটতে ওরা মাড়িয়ে যায় সব বাধা, সব উপেক্ষা।
যদি মাঠে মেলা জাতীয় কিছু না থাকে, তা হলে সকালে কাছারি মাঠে হাজির হয় সবাই। সেখানেই চলে কড়া অনুশীলন। এক জন আছেন, যিনি এই ‘কোনি’দের স্বপ্নের সঙ্গে এক সূত্রে বেঁধে ফেলেছেন নিজেকে। গত পঁচিশ বছর ধরে একই ভাবে তাদের খুঁজে চলেছেন নাওয়া-খাওয়া ভুলে। কোচ দেবাশিস দাস। কাকভোরে তিনিও হাজির হয়ে যান বারাসতের কাছারি মাঠে। নিজেও ছোটেন অ্যাথলিটদের সঙ্গে।
তাঁদের কারও বাবা সবজিবিক্রেতা, কারও আছে চায়ের দোকান। কেউ রাজমিস্ত্রি, কেউ সংসার চালান ব্যাগ বিক্রি করে। প্রায় সকলেরই বাড়িতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। কিন্তু এরা প্রত্যেকেই অ্যাথলেটিক্সের বিভিন্ন বিভাগে বাংলার প্রতিনিধি। দু’ চোখে স্বপ্ন নিয়ে ওরা ভুলে থাকে না-পাওয়ার সব যন্ত্রণা।
তবে লড়াই করার সাহস ওদের বাড়িয়ে দিয়েছেন ওদের কোচ। সবার প্রিয় লকিদা। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী দেবাশিস শুধু সোনিয়া, নাজিয়াদের প্রশিক্ষণই দেন না, প্রাণশক্তিও জোগান। কিছু দিন আগে পর্যন্ত অ্যাথলিটদের পোশাক বদলের জায়গা ছিল না। শেষ পর্যন্ত তাঁর চেষ্টাতেই বারাসত সাব ডিভিশন স্পোর্টস কমিটি ওদের জন্য একটি ঘর করে দিয়েছে।
পদে পদে যে সমস্যা নিয়েই দৌড়তে হবে, তা এক রকম ভবিতব্য হিসেবেই ধরে নিয়েছেন এই চ্যাম্পিয়নরা। কাবেরীর সহজ প্রশ্ন, ‘কী হবে অভিযোগ করে? আমাদের কাজ আমাদেরকেই করতে হবে’। নিজেদের দুরবস্থার কথা বলতে গিয়ে চোখ চকচক করে ওঠে হালিমা, নাজিয়া, অনামিকাদের। কিন্তু কথায় নয়, তাঁরা বিশ্বাস করেন কাজে।
ষাট ছুঁই-ছুঁই কোচের টানটান চেহারাটা কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। ভেসে আসে নির্দেশ। ফুটপাথ দিয়ে ফের ছোটা শুরু হয় কিছু স্বপ্নের।
সূত্র: এই সময়, ৫ মার্চ, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/14/2019