থিয়েটারের যাঁরা আসল প্রভু, তাঁদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব সহজে দেখা মেলে মঞ্চ থেকে বেশ দূরে। আসলে যান্ত্রিক ভাবে বহু কাল ধরে মেনে চলা রীতিনীতির পুনরাবৃত্তিতে তাঁদের বিশেষ আগ্রহ থাকে না। সস্তা গতানুগতিকতার পুনর্মঞ্চায়নেও তাঁরা নিরুত্সাহী। তাঁরা খুঁজে ফেরেন সময়ের গভীরে হৃদস্পন্দনের উত্সকে। খুঁজে ফেরেন সেই জীবন্ত প্রবাহকে, যা অভিনয়মঞ্চকে ছাপিয়ে বাইরের জগতেও প্রবল ভাবে সচল। এক দল মানুষ যারা মঞ্চে কোনও একটা জগতের বা অন্য কোনও বিশেষ ক্ষেত্রের নকল করে চলেছে, তাদের এড়িয়েই সেই প্রবল সচলতা। যে চেনাজানা দুনিয়াকে নিয়ে আমরা প্রায়শই আলোচনায় ব্যস্ত, কিংবা যে আবেগ ভাসাভাসা ভাবে মনে অভ্যস্ত আলোড়ন তোলে, নতুন সৃষ্টির বদলে থিয়েটারে সে সবের নকল করে চলেছি আমরা। অথচ সত্যি কথা বলতে কি, মানুষের সমস্ত গোপন অনুভব বা গভীর আবেগকে ভালো ভাবে প্রকাশের একমাত্র জায়গা তো থিয়েটারই।
এই অবস্থায় পথ নির্দেশের জন্য আমি প্রায়ই চোখ ফেরাই নিত্য স্মর্তব্য কিছু গদ্যরচনার দিকে। দিন আসে, দিন যায়, আমার ভাবনার জগৎ দখল করে থাকেন সেই সব লেখক যাঁরা প্রায় শতবর্ষ আগে সংযত ভবিষ্যদ্বক্তার মতো সত্য উন্মোচন করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ইউরোপীয় ঈশ্বরদের প্রতি এত কালের সশ্রদ্ধ (কিংবা প্রশ্নহীন আনুগত্যের) মানসিকতায় এখন ক্ষয়রোগ ধরেছে। তাঁরা তুলে ধরেছেন আমাদের যাপনের সেই সব করুণ সন্ধ্যাকে, যা সভ্যতাকে নিমজ্জিত করে ফেলেছে অন্ধকারে, যে অন্ধকার থেকে এখনও আমরা মুক্ত আলোয় উত্তরণ পাইনি। আমার ভাবনার দখল নেওয়া সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন গদ্যলেখকদের মধ্যে আছেন ফ্রানত্জ কাফকা, টমাস মান আর মিশেল প্রুস্ত। সে সব দৈববাণীকার গদ্যলেখকদের সঙ্গে আমি আজ যোগ করতে চাই ম্যাক্সওয়েল কোয়েত্জির নামও। নিজেদের সাধারণ জ্ঞান থেকেই এই অসাধারণরা ছকে বাঁধা দুনিয়ার অনিবার্য সমাপ্তির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে নয়, তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছিলেন মানবিক সম্পর্কের ছকভাঙা ব্যাপারগুলোকে, আর নতুন সামাজিক অবস্থান আর বৈপ্লবিক ধ্যানধারণাকে যা তীব্র ভাবে আধুনিক ও সচল, এখনও, এখানেও। এই সচলতা কিন্তু আমাদেরই জন্য, যারা নিজেদের পৃথিবীর শেষ দিনের পরও বেঁচে থাকছে। আজকের সর্বব্যাপ্ত মিডিয়ার চেয়েও দ্রুতগতিতে প্রতি দিন নতুন নতুন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়া এত সব ঘটমান অপরাধ আর দ্বন্দ্বের অগ্নিপরিধির মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তারা বেঁচে থাকে। সেই জ্বলন্ত আগুন কিন্তু দ্রুত বাড়তে বাড়তে এক সময় একঘেয়ে হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমের উত্তেজক বিবরণী থেকে এক দিন উধাও হয়ে যায়, আর ফেরে না। তখন আমরা অসহায় বোধ করি, আতঙ্কিত হই, মনে হয় আমরা বোধ হয় ঘেরাও হয়ে আছি। আর আমরা কোনও দুর্গ বানাতে পারব না। যে দেওয়ালগুলো আমরা উদ্ধত ভাবে বানিয়েছি, সেগুলি আমাদের আর সুরক্ষা দিতে পারছে না। উল্টে আমাদের এত কালের নির্মাণগুলিই এমন বিপন্ন অবস্থায় পড়েছে যে আমাদের জীবনীশক্তির জোগান দেওয়ার স্বার্থে তারা এখন সুরক্ষা আর প্রযত্ন চাইছে। এই অবস্থায় আমাদের মনে হতে থাকে, ওই সব দেওয়াল-ঘেরা দরজার বাইরেটাকে পরখ করার জন্য, দেখার জন্য যে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দরকার, তা আমাদের মধ্যে আর নেই। এবং এখানেই, এই সঙ্কটেই আসলে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে থিয়েটারের অস্তিত্ব, যার কাছ থেকে আমরা নিত্য নতুন ভাবে অর্জন করতে পারি আমাদের শক্তি আর সামর্থ্য। যা দেখা বারণ, এত দিনের সেই নিষেধের আঙিনায় যা আমাদের উঁকি দিতে প্রাণিত করে চলে।
‘রূপকথার আখ্যান কিন্তু অবিশ্লেষণীয়কে ব্যাখ্যা দিতে চায়, যা সত্যের ভূমিসম্ভূত, সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে সব সময় তার চূড়ান্ত ব্যাখ্যা অসম্ভব’--- এই ভাবেই কাফকা এক দিন প্রমিথিউসের আখ্যানের বিবর্তনকে দেখেছিলেন। আমাদের আজকের থিয়েটার প্রসঙ্গেও আমি এই কথাগুলিকেই আর এক বার মনে করতে চাই, মান্যতা দিতে চাই। এখানে আমি কিন্তু সেই থিয়েটারের প্রসঙ্গই টানছি, যা সত্যের ভূমিজাত এবং যার অন্তিম লক্ষ্য এত দিনের ক্লিশে ব্যাখ্যাগুলিকে অস্বীকার করা। এই প্রেক্ষাপটেই আমি মঞ্চের ওপর সক্রিয় সমস্ত নাট্যকর্মীকে এবং মঞ্চের ও-পারে সমস্ত দর্শককে শুভেচ্ছা জানাই। সমস্ত অন্তর দিয়েই নিবেদিত এই শুভেচ্ছা।
ভাবানুবাদ : চন্দন সেন (নাট্যকার)
সূত্র: এই সময়, ২৭ মার্চ, ২০১৫
ছবি : এই সময়
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/23/2020