কলকাতা শহরের একটি দর্শনীয় ভবন ‘মার্বেল প্যালেস’। যতটা না মর্মর প্রাসাদের জন্য, দর্শনীয় আরও বেশি এখানকার চিত্রভাস্কর্যাদির এক বিচিত্র সংগ্রহশালার জন্য। ৪৬ মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটে অবস্থিত এই প্রাসাদ বাবু রাজেন্দ্রনাথ মল্লিক বাহাদুরের (১৮১৯-৮৭ খ্রিস্টাব্দ) তৈরি। রাজা রাজেন্দ্রলাল চোরবাগানের মল্লিক বংশের সন্তান। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৮৩৫ সালে তিনি এক ফরাসি স্থপতিকে দিয়ে এই ‘মার্বেল প্যালেস’ নির্মাণ শুরু করান। শেষ হতে সময় লাগে ৫ বছর। উত্তর কলকাতার উনবিংশ শতকের প্রাসাদগুলির মধ্যে সৌন্দর্যের দিক থেকে এটি সর্বোত্তম। বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও জমিদার নীলমণি মল্লিকের দত্তকপুত্র ছিলেন রাজেন্দ্র মল্লিক। নীলমণি মল্লিক উত্তর কলকাতার মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে তাঁর বসতবাড়িতে জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণ করেন। মার্বেল প্যালেসের অন্দর মহলের প্রাঙ্গণে মন্দিরটি এখনও রয়েছে। এই ৪৬ নম্বর মুক্তারামবাবু স্ট্রিটেই রাজেন্দ্র মল্লিক গড়ে তোলেন অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত মার্বেল প্যালেস। নিউক্ল্যাসিকাল স্থাপত্যরীতিতে গড়ে তোলা এই তিনতলা ভবনটির সামনে বাঙালি রীতিতে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ও বিশাল বাগান রয়েছে। ভিতরে রয়েছে বাঙালি রীতিতে তৈরি ঠাকুরদালান। এই মন্ডপে যেমন পূজা হত তেমনি যাত্রাপালা ও কীর্তনের আসরও বসত। তিনতলা ভবনটির সামনে রয়েছে কোরিন্থিয়ান রীতিতে তৈরি স্তম্ভ এবং কারুকার্য করা বড় বারান্দা। চিনা প্যাভিলিয়নের ধরনে নির্মিত হয়েছে ঢালু ছাদ।
ভবনটির ভিতরে রয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। বিশেষ করে গ্রিক ও রোমান পুরাণের দেবদেবী জিউস, মিনার্ভা, মার্কারি, অ্যাপোলো, হেরা, ভেনাস, কিউপিড যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে শ্বেত পাথরের দেহে। ভাস্কর্য ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য পেন্টিং বা চিত্রকর্ম। বিশাল বিশাল ক্যানভাসে আঁকা এই চিত্রকর্মগুলো দর্শকদের মুগ্ধ করে অনায়াসে। এই চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে ষোড়শ শতকের বিখ্যাত জার্মান শিল্পী রুবেনস-এর আঁকা দু’টি ছবি রয়েছে। এ দু’টি ছবি হল দ্য ম্যারেজ অব সেন্ট ক্যাথেরিন এবং দ্য মার্টারডম অব সেন্ট সেবাস্টিয়ান। ইংরেজ শিল্পী স্যার জোশুয়া রেনল্ড-এরও দু’টি মূল চিত্রকর্ম এখানে রয়েছে। এ দু’টি হল সাপের সঙ্গে যুদ্ধরত শিশু হারকিউলিস আর ভেনাস ও কিউপিড।
তিনতলা ভবনের পুরোটিই অত্যন্ত মূল্যবান মার্বেল পাথরে তৈরি। সে জন্যই এর নামকরণ করা হয়েছে মার্বেল প্যালেস। মার্বেল প্যালেসের সামনে যে বিশাল বাগানটি রয়েছে সেখানেও আছে বিভিন্ন ভাস্কর্য ও ফোয়ারা । বিশেষ করে সিংহের মূর্তিগুলো অত্যন্ত সুন্দর। এই বাগানে এখনও একটি ছোট চিড়িয়াখানা রয়েছে । এই চিড়িয়াখানায় দশর্করা দেখতে পাবেন ময়ূর, পেলিক্যান পাখি, সারস, বিভিন্ন প্রজাতির বক, বিভিন্ন প্রজাতির বুনো হাঁস, হাড়গিলে পাখি, বানর, সজারু, চিতাবাঘ, বনবিড়াল, গন্ধগোকুল ও কয়েক প্রজাতির হরিণ ।যে হেতু রাজার পরিবারের সদস্যরা এখনও এ বাড়িতে বাস করেন তাই দর্শনার্থীরা শুধু ভবনটির একটি অংশেই ঢুকতে পারেন। প্রাসাদের অন্দরমহলে এবং প্রসাদের ভিতরে অবস্থিত জগন্নাথদেবের মন্দিরে ঢোকার অধিকার তাদের নেই।
উত্তর কলকাতার এই মার্বেল প্যালেস এখনও অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর বাবু-সংস্কৃতি ও বিলাস বৈভবের কথা মনে করিয়ে দেয়।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/27/2020