(২ মে ১৯২১ – ২৩ এপ্রিল ১৯৯২)
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ১৮ বৈশাখ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। এঁর পিতামহ ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (লেখক, চিত্রকর, ভারতীয় মুদ্রণশিল্পের পথিকৃত)। পিতার নাম সুকুমার রায় (প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক), মায়ের নাম সুপ্রভা দেবী। এঁদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার মসুয়া গ্রামে।
প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন তাঁর মায়ের কাছে। ৮ বৎসর বয়সে (১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ) বালিগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে তিনি ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ প্রেসিডেন্সি কলেজে। এই কলেজে প্রথম দু’ বছর বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। শেষ বছরে বিষয় পাল্টে তিনি অর্থনীতি পড়েন। ফলে তাঁর লেখাপড়ার সময় দীর্ঘতর হয়ে উঠে। এই সময়ে ইনি পাশ্চাত্য চিরায়ত চলচ্চিত্র এবং সঙ্গীত নিয়ে এতটাই আগ্রহী হয়ে উঠেন যে, তাঁর মূল পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে। শেষ পর্যন্ত তিনি ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিএ (অনার্স) পাশ করেন।
মায়ের উৎসাহে সত্যজিৎ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে যান এবং সেখানকার কলাভবনে ভর্তি হন। এই সূত্রে তিনি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছে শিক্ষালাভের সুযোগ পান। নিয়মানুযায়ী বিশ্বভারতীতে সত্যজিতের পাঁচ বছর পড়াশোনা করার কথা থাকলেও তার আগেই তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ডি জে কেমার নামক ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থায় 'জুনিয়র ভিজুয়ালাইজার' পদে যোগদান করেন। এখানে তিনি বেতন পেতেন ৮০ টাকা। ইনি প্রথম বিজ্ঞাপনে ভারতীয় ধাঁচের ক্যালিওগ্রাফিক উপাদান ব্যবহার করা শুরু করেন। একই সঙ্গে তিনি অক্ষরশৈলীতে বিশেষ আগ্রাহী হয়ে উঠেন। তাঁর নকশা করা দুটি ফন্ট 'Ray Roman' এবং 'Ray Bizarre' ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করেছিল।
এই সময় থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে চলচ্চিত্র দেখা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতায় অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের সাথে যোগাযোগ করে নতুন মার্কিন চলচ্চিত্রগুলোর বিষয়ে খবর নিতেন। বিশেষ করে নরম্যান ক্লেয়ার নামের রয়্যাল এয়ারফোর্সের এক কর্মচারী এ বিষয়ে তাঁকে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে কলকাতার প্রেক্ষাগৃহগুলোতে হলিউডে নির্মিত প্রচুর ছবি দেখানো হতো। এই সূত্রে হলিউডের চলচ্চিত্রগুলো কলকাতার চলচ্চিত্র প্রেমিকদের কাছে প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ এবং বংশী চন্দ্রগুপ্ত কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই সোসাইটিতে চলচ্চিত্র দেখানো হতো এবং এই বিষয়ে পরে ঘরোয়াভাবে আলোচনার ব্যবস্থা করা হতো। উল্লেখ্য এই সমিতি প্রথম প্রদর্শন করেছিল ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি নির্বাক চলচ্চিত্র। পরিচালক ছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার সেরগেই আইজেনস্টাইন।
সত্যজিৎ সাধারণ মানুষের কাছে ততটা পরিচিত হয়ে না উঠলেও, কলকাতার চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর নামটি বেশ সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল। এই কারণেই ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে যখন ফরাসি চলচ্চিত্রকার জঁ রেনোর তাঁর দ্য রিভার ছবি নির্মাণের জন্য কলকাতায় আসেন, তখন সত্যজিৎকে তাঁর ছবির চিত্রগ্রহণের উপযোগী স্থান খোঁজার ক্ষেত্রে সাহায্যকারী হিসাবে খুঁজে নিয়েছিলেন। এটাই ছিল আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত কোনও প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয়। এই সময়ই তিনি রেনোর'র কাছে পথের পাঁচালী-র চলচ্চিত্রায়ণ নিয়ে আলাপ করেন। রেনোর এই বিষয়ে বিশেষ ভাবে তাঁকে উৎসাহিত করেন। এবং অনেকে মনে করেন, বাস্তবধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের মৌলিক উপাদনগুলো সম্পর্কে রেনরো-র কাছ থেকে তিনি বিশেষ ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সত্যজিৎ তাঁর দূরসম্পর্কের বোন ও বহু দিনের বান্ধবী বিজয়া দাসকে বিয়ে করেন। রেনোর তাঁর ছবিতে সত্যজিতের বন্ধু বংশী চন্দ্রগুপ্তকে শিল্প নির্দেশক এবং সহযোগী হিসাবে নেন হরিসাধন দাসগুপ্তকে। এই ছবিতে সুব্রত মিত্রও ছিলেন। পরে ইনি সত্যজিৎ-এর ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসাবে কাজ করেছেন। এই ছবিতে কাজ করার জন্য সত্যজিতের ইচ্ছা ছিল, কিন্তু তিনি তখনও বিজ্ঞাপন সংস্থায় শিল্প নির্দেশক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। এই সংস্থা সত্যজিৎকে তাদের লন্ডনস্থ প্রধান অফিসে কাজ করার জন্য পাঠান।
লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি প্রায় শ'খানেক চলচ্চিত্র দেখেন। এর ভিতরে ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে (ইতালীয় Ladri di biciclette ইংরেজি Bicycle Thieves (সাইকেল চোর) দেখেন। এই ছবিটি তাঁকে পথের পাঁচালী তৈরিতে বিশেষ ভাবে উৎসাহিত করেছিল।
এই ছবি তৈরির জন্য পথের পাঁচালীর লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধবা স্ত্রী রমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অনুমতি নেন। তিনি তাঁর জমানো টাকা, বিমা কোম্পানি থেকে গৃহীত ঋণ এবং কতিপয় বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনের সহায়তায় ১৯৫২ সালের শেষ দিকে দৃশ্যগ্রহণ শুরু করেন। আর্থিক অসুবিধার কারণে, থেমে থেমে এই ছবি তৈরি করতে তাঁর প্রায় দীর্ঘ তিন বছর লেগে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১৯৫৫ সালে ছবিটি নির্মাণ সম্পন্ন হয় ও সেই বছরের ২৬ আগস্ট তারিখে ছবিটি মুক্তি পায়। মুক্তি পাওয়ার পর পরই ছবিটি দর্শক-সমালোচক সবার অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করে। ছবিটি বহু দিন ধরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এবং ভারতের বাইরে প্রদর্শিত হয়।
এই ছবির সাফল্যের পর তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করেন অপরাজিত । এই ছবি তাঁকে আন্তর্জাতিক মহলে উচ্চাসনে পৌঁছে দেয়। এই ছবির জন্য তিনি ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার লাভ করেন। 'অপু-ত্রয়ী' শেষ করার আগে সত্যজিৎ আরও দু’টি চলচ্চিত্র নির্মাণ সমাপ্ত করেন। প্রথমটি ছিল ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত পরশপাথর, আর পরেরটি ছিল জলসাঘর (১৯৫৮)। এর পর 'অপু-ত্রয়ী'-এর শেষ অপুর সংসার তৈরি করেন ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে।
আন্তর্জাতিক ভাবে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবেই সর্বাধিক পরিচিত। কারণ, তাঁর সৃষ্ট ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক ভাবে প্রচারিত হয়েছে সব চেয়ে বেশি। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছিল, এদের মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া "শ্রেষ্ঠ মানব দলিল" (Best Human Document) পুরস্কারটি। পথের পাঁচালি, অপরাজিত ও অপুর সংসার – এই তিনটি চলচ্চিত্রকে একত্রে 'অপু-ত্রয়ী' বলা হয়। এটি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বা ম্যাগনাম ওপাস হিসাবে বহুল স্বীকৃত।
১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ঘরে বাইরে ছবির কাজ করার সময় সত্যজিতের হার্ট অ্যাটাক হয় এবং এ ঘটনার পর অবশিষ্ট নয় বছরে তাঁর কাজের পরিমাণ ছিল অত্যন্ত সীমিত। স্বাস্থ্যগত কারণে ঘরে বাইরে নির্মাণের সময় তাঁর ছেলে সন্দীপ রায়ের সহায়তা নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১৯৮৪ সালে ছবিটি সমাপ্ত করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে সত্যজিৎ তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। শারীরিক অসুস্থতার পরেও সত্যজিৎ তিনটি ছবি করেছিলেন। এই ছবি তিনটি হলো - গণশত্রু (১৮৮৯), শাখা প্রশাখা (১৯৯০), আগন্তুক (১৯৯০)।
১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল হৃদরোগ প্রকট আকার ধারণ করলে সত্যজিৎ হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত্যুর কিছু সপ্তাহ আগে অত্যন্ত অসুস্থ ও শয্যাশায়ী অবস্থায় তিনি তাঁর জীবনের শেষ পুরস্কার সম্মানসূচক অস্কার গ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ মৃত্যুবরণ করেন।
সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবদ্দশায় প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। তিনিই দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাঁকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। প্রথম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে অক্সফোর্ডের ডিলিট পেয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার তাঁকে সে দেশের বিশেষ সম্মনসূচক পুরস্কার লেজিওঁ দ’নরে ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে পান ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বে অ্যাকাডেমি তাকে আজীবন সম্মাননাস্বরূপ অ্যাকাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার প্রদান করে। মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বেই ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করেন দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন। সেই বছরেই মৃত্যুর পরে তাঁকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রয়াত পরিচালকের পক্ষে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন শর্মিলা ঠাকুর।
শুধু চলচ্চিত্রকার নন, সত্যজিৎ ছিলেন সুলেখক এবং সুসাহিত্যিক। তাঁর ফেলুদা ও শঙ্কু অমর সৃষ্টি। তাঁর সাহিত্যকীর্তির কথা রয়েছে বিকাশপিডিয়ায় ‘বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের জীবনী’-তে।
সূত্র: onushilon.org
সর্বশেষ সংশোধন করা : 1/28/2020
তিন তিন বার মনোনয়ন পেলেও কোনও ভারতীয় ছবি অস্কার ...