আসলে গৃহিণী তখন এক পায়ের উপর বসিয়া দ্বিতীয় পায়ের হাঁটু চিবুক পর্যন্ত উত্থিত করিয়া কাঁচা তেঁতুল, কাঁচা লঙ্কা এবং চিংড়িমাছের ঝালচচ্চড়ি দিয়া অত্যন্ত মনোযোগের সহিত পান্তাভাত খাইতেছিলেন।
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা )
লঙ্কা ছাড়া আবার আমাদের রান্না হয় নাকি ? কিন্তু রান্নায় লঙ্কা বেশি পড়লে হু-হা করতে থাকি। আবার ক্যাপসিকামে যখন কামড় দিই তখন তো ঝাল লাগে না। দু’টোই তো লঙ্কা! তার মানে সব লঙ্কা সমান ঝাল হয় না। এই ব্যাপারটা আমাকে অনেক দিন ধরে ভাবাচ্ছে। তাই জগন্নাথদার কাছে চলে গেলাম। জগন্নাথদা হল অনেকটা ফেলুদার সেই সিধুজ্যাঠার মতো। সবই জানে প্রায়। “প্রায়” বললাম কারণ আর যাই জানুক রান্না করতে একেবারেই জানে না। তবে রান্না করতে না জানলেও রান্নার রসায়ন বিলক্ষণ জানে।
জগন্নাথদা প্রথমেই একটা কাগজে সুন্দর থার্মোমিটারের মতো বস্তু এঁকে ফেলল (নীচের ছবি)। “বুঝলি তো, একে বলে স্কভিল স্কেল (মাপনী)।” জগন্নাথদার গলায় তখন আমাকে জ্ঞান দেওয়ার সুর।
“সেটা আবার কী ?” যথারীতি আমার অজ্ঞানতার প্রকাশ।
জগন্নাথদার মুখ চলতে থাকে। “উইলবার স্কভিল বলে এক মার্কিন বিজ্ঞানী ১৯১২ সালে এক পরীক্ষা করেন যার মাধ্যমে লঙ্কার ঝাল মাপা যায়। সেটাই এখন স্কভিল স্কেল বলে পরিচিত।” এর পর জগন্নাথদার কথা চলতে থাকল আর মাঝে মাঝে আমার “হুম, আচ্ছা”। তবে মোটামুটি যা বুঝলাম তা হল লঙ্কায় ক্যাপসাইসিন কতটা আছে তার ওপর নির্ভর করে কোন লঙ্কা কত ঝাল হবে। আর সেটার ওপর নির্ভর করেই তৈরি হয়েছে এই স্কভিল মাপনি। ক্যাপসাইসিন আর তার বিজারিত (বিজারিত কারণ দু’টো হাইড্রোজেন বেশি আছে, ইংরাজিতে বলে রিডিউসড) ভাই ডাইহাইড্রোক্যাপসাইসিন হল লঙ্কার যৌগপদার্থগুলোর মধ্যে প্রধান উপাদান (ওপরের ছবি দেখো)। ওপরের ছবিতে স্কভিল মাপনীতে কয়েকটা লঙ্কার নাম দেওয়া হল যেগুলো প্রচণ্ড ঝাল বলে কুখ্যাত। ক্যারোলিনা রিপার এখনও পর্যন্ত (জুলাই, ২০১৪) সব চেয়ে বেশি ঝাল লঙ্কা বলে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা করে নিয়েছে। কাছাকাছি থাকবে নাগা ভাইপার। ক্যারোলিনা রিপার আর নাগা ভাইপার দু’টি সংকর প্রজাতির। নাগা ভাইপার ইংল্যান্ডে তৈরি হলেও আসলে ভারতেরই নাগা মরিচ, ভোট জলকিয়া, ইত্যাদি নানা রকম লঙ্কার সংকর প্রজাতি। ভোট জলকিয়া নিজেও কম যায় না। আদতে ভুটানের হলেও ভারতের অসম ও অন্যান্য উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোতে ভোট জলকিয়া পাওয়া যায়। এ ছাড়া অন্ধ্রের গুন্টুর থেকে গুন্টুর লঙ্কাও আছে এই মাপনীর বেশ ওপরের দিকেই।
এর পরেই জগন্নাথদা একটা মোক্ষম প্রশ্ন করে বসল, “বল তো, ঝাল লেগে জিভ জ্বলতে শুরু করলে জল খেলেও খুব একটা লাভ হয় না কেন ?”
আসলে এটা আমারও প্রশ্ন। কাজেই জগন্নাথদাকে বললাম, “তুমিই বল।” “লঙ্কার মধ্যে থাকা ভিলেনের সঙ্গে তোকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। একটু লক্ষ করে দেখ যে ক্যাপসাইসিনের রাসায়নিক গঠন কোন দিকে ইঙ্গিত করছে।” বুঝলাম জগন্নাথদা আমার পেট থেকে উত্তরটা বের করে আনতে চান। এখন ব্যাঙ্কে চাকরি করি বটে, কিন্তু কলেজে রসায়ন পড়ার ফলে আন্দাজ করে ধরে ফেললাম ব্যাপারটা।
“ক্যাপসাইসিনে নাইট্রোজেন, অক্সিজেনের মতো ইলেক্ট্রোনেগেটিভ পরমাণুর অনুপাত কার্বন আর হাইড্রোজেনের থেকে অনেকটাই কম হওয়ায় জলের পক্ষে তাকে ধুয়ে সাফ করা সম্ভব নয়। জলের সঙ্গে তো তিনি মিশতেই চান না।” মনে হল যেন মুখ থেকে দৈববাণী হচ্ছে। বেশ তৃপ্ত হলাম। এর পরেই আমার মস্তিষ্কের বাতি জ্বলে উঠল। বললাম, “তা হলে জগন্নাথদা, রান্নার তেল খেলে তো কাজ হওয়ার কথা, তাই তো ? তেল তো বলতে গেলে শুধুই কার্বন আর হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি।”
“তোর চিন্তাভাবনা ঠিক দিকেই এগোচ্ছে বটে কিন্তু আমরা তো আর ঢক ঢক করে তেল খেতে পারব না। তাই দুধ খেয়ে সমস্যার সমাধান করা যেতেই পারে। কার্যত, অনেক বাড়িতেই মা-মাসিরা কিন্তু এই টোটকা অনেক প্রজন্ম ধরে চালিয়ে যাচ্ছেন। দুধের মধ্যে থাকে কেসিন বলে এক প্রোটিন আছে যা জলের সঙ্গে মেশে না। তাই ক্যাপসাইসিনকে ধুয়ে সাফ করতে এর থেকে ভালো আর কী হতে পারে ? এক কাপ ঠান্ডা দুধ খেয়ে নিলে ঝাল লাগার কষ্টটা অনেকটাই চলে যাবে।” জগন্নাথদার পরামর্শ লিখে নিলাম নোট খাতাতে। তোমরাও লিখে রেখো কিন্তু, ঝাল লাগলে কাজে দেবে।
ছবি : উইকিপিডিয়া।
সূত্র: bigyan.org.in
সর্বশেষ সংশোধন করা : 3/27/2020