কিন্তু যাঁরা বিজ্ঞানমনস্কতার মানে বোঝেন, যাঁরা সত্যিই লোককে যুক্তিবাদী হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারেন, আমাদের দেশে তাঁদের ভবিষ্যৎ খুব ভালো নয়। এমন এক জন যুক্তিবাদী প্রবীণ গোবিন্দ পানসারে গত ২০ ফেব্রুয়ারি খুন হয়ে গেলেন আততায়ীর গুলিতে। বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী মানুষটি সারা জীবনে মার্ক্সবাদ ছাড়াও বিশ্বায়ন, সংরক্ষণ, কৃষি ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে কলম ধরেছেন। কিন্তু তাঁর সব চেয়ে বড় কাজ ছত্রপতি শিবাজির নতুন মূল্যায়ন। শিবাজিকে শুধু হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে না দেখে তিনি তাঁকে এক প্রজাদরদি ও ধর্মনিরপেক্ষ সুশাসক রূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এতে শিবাজির গরিমা বেড়েছে, কিন্তু হিন্দু ধর্মোন্মাদদের স্বার্থের পক্ষে সেটা ভালো হয়নি।
এই মৃত্যুর দেড় বছর আগের আর একটি মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিল। ২০১৩’র ২০ অগস্ট, সকাল ৭টা ২০ নাগাদ প্রাতর্ভ্রমণ সেরে ফেরার পথে আততায়ীর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান প্রবীণ মরাঠি চিকিৎসক নরেন্দ্র দাভলকর। আরও এক বার প্রমাণিত হয়, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে আজও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলার মূল্য দিতে হয় জীবন দিয়ে। আদ্যন্ত বিজ্ঞানসচেতন মানুষটির সারা জীবন মানবিকতা ও যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে গেছেন। জাতপাতের অনুশাসন, ধর্মীয় কারণে পশুবলি, নানা ধরনের তন্ত্রমন্ত্র, ঝাড়ফুঁক ও ভেলকির (ব্ল্যাক ম্যাজিক) সাহায্যে রোগ সারাবার চেষ্টা— এই রকম আরও যে-সব বিশ্বাস ও সামাজিক নির্মাণ মানুষের ও পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর, ডাক্তার হিসেবে তার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলাটা উনি কাজেরই একটা অংশ মনে করতেন। তাই ডাক্তারির পাশাপাশি অজস্র বই লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, নিজের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে গড়ে তুলেছেন ‘মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি’। জন্মগত ভাবে হিন্দু মরাঠি ব্রাহ্মণ দাভলকর নিজের একমাত্র ছেলের নাম রেখেছিলেন হামিদ, যিনি এখন ডাক্তার।
তেরো বছর ধরে ডা. দাভলকর মহারাষ্ট্র সরকারকে কুসংস্কার-বিরোধী যে-বিলটা পাশ করবার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, তাতে বিভিন্ন প্রকারের ভাঁওতাবাজির সাহায্যে মানুষকে ঠকানোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ছিল। ডাকিনীবিদ্যার চর্চা, কাউকে ডাইনি সাব্যস্ত করা, অঘোরীবিদ্যা, ওঝাতন্ত্র অর্থাৎ মন্ত্র পড়ে কুকুর বা সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করা, ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ করার দাবি— এই রকম মোট বারোটা বিষয়ের কথা এই বিলে উল্লেখ করা ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই দাভলকর প্রচুর শত্রু বাড়িয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু বিলটা পাশ করাতে পারেননি। বিধানসভায় তিন বার বিলটার প্রস্তাবনা আর ঊনত্রিশ বার সংশোধন সত্ত্বেও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্থার বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত বিলটা পাশ হয়নি। ওঁর মৃত্যুর দু’দিন পর প্রবল জনরোষকে সামলাতে মহারাষ্ট্র সরকার কুসংস্কার-বিরোধী একটা আইন জারি করেন।
দাভলকরের আনা যে বিলটাকে ‘হিন্দু বিরোধী’ ভেবে ধর্মোন্মাদরা ভয় পেয়েছিল, তারা জানতই না যে, ওই বিলটায় ঈশ্বর বা ধর্ম বিষয়ে একটি কথাও ছিল না। ওরা ভেবেছিল, এই বিল পাশ হলে ‘হিন্দু-বিশ্বাস ও ধর্মাচরণের স্বাধীনতা’ খর্ব হবে। কিন্তু মানুষের যে বিশ্বাস অন্য কারুর কোনও রকম ক্ষতি করে না, সেই বিশ্বাস ও আচরণ নিয়ে এই বিলে কিচ্ছু ছিল না। নিজে ধর্মবিশ্বাসী না হয়েও উনি গণেশপুজো বন্ধ করার কথা বলেননি। কিন্তু এই নির্দেশটা আদায় করেছিলেন যে, সমস্ত গণেশমূর্তি হতে হবে মাটির তৈরি আর প্রাকৃতিক রঙে রাঙানো, যাতে সেগুলো বিসর্জনের পর পরিবেশের ক্ষতি করতে না পারে। নিজের কর্মপদ্ধতির মধ্যে ডা. দাভলকর ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণের ক্ষতিকর দিকগুলোকে আলাদা করতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ, ওঁর লড়াইটা ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের নয়, জ্ঞান ও বুদ্ধির সঙ্গে অজ্ঞতার। ওঁর আনা বিলে যে বিষয়গুলোর কথা ছিল, সেগুলো সকলের পক্ষেই ক্ষতিকর। কিন্তু কুসংস্কার ব্যাপারটাই তো এই রকম, নিজের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতাই নষ্ট করে দেয়। কিন্তু বিজ্ঞানচেতনার গোড়ার কথাই যে যুক্তিনিষ্ঠ হওয়া, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সচেতন হওয়া। তার অর্থ যদি গুলি খেয়ে পড়ে থাকা হয়, তবে দেশে বিজ্ঞানচেতনা গড়ে উঠবে কী করে?
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ মার্চ, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/14/2019