পৃথিবীকে জ্ঞান বিজ্ঞানে যাঁরা অগ্রসর করে গেছেন তাঁদের অন্যতম বেতার আবিষ্কারক গুগলিয়েলমো মার্কোনি। বেতারের জনক মার্কোনি নামেই যিনি সমধিক পরিচিত। রেডিও আবিষ্কার করে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন বিজ্ঞানী মার্কোনি। মার্কোনি ছিলেন ইতালীয় উদ্ভাবক এবং প্রকৌশলী যিনি বেতার যন্ত্রের সম্প্রচার পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি একটি ব্যবহারিক রেডিওগ্রাফ পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন। এই উদ্ভাবনকে কেন্দ্র করেই বিশ্বের অসংখ্য ব্যবসায়িক ও প্রাযুক্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। ১৯০৯ সালে কার্ল ফের্ডিনান্ড ব্রাউনের সঙ্গে যৌথ ভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বেতার সম্প্রচার পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপনের জন্যই তাদের এই পুরস্কার দেওয়া হয়। বিশ্বখ্যাত এই বিজ্ঞানী ১৯৩৯ সালের ২০ জুলাই মাত্র ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
গুগলিয়েলমো মার্কোনি বিশ বছর বয়সে মার্কিন বিজ্ঞানী হার্জের একটা প্রবন্ধ থেকে জানতে পারেন যে, সদ্যপ্রয়াত এক বৈজ্ঞানিক এমন একটা বৈদ্যুতিক যন্ত্র বের করতে পেরেছেন, যার সাহায্যে ঘরের এক দিক থেকে প্রেরিত বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বিনা তারে ঘরের অন্য দিকে আগুনের ফুলকি জ্বালিয়ে দেয়। মার্কোনি হার্জের মতো বৈদ্যুতিক যন্ত্র তৈরির চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকলেন। মার্কোনির কাজ শুরু হল লন্ডন জেনারেল পোস্ট অফিসের একটি কক্ষ থেকে পাশের বাড়ির কাছে বার্তা প্রেরণের মধ্য দিয়ে।
একনিষ্ঠ অধ্যাবসায় ও গবেষণায় তিনি এমন একটা যন্ত্র তৈরি করলেন, যার মাধ্যমে এক মাইল দূর পর্যন্ত বিনা তারে সংকেত পাঠানো সম্ভব। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ছিল আটলান্টিকের এ-পার থেকে ৩৩৭৮ কিলোমিটার দূরে ও-পারে বার্তা প্রেরণ। অতঃপর ১৮৯৯ সালে ইংলিশ চ্যানেলের এ-পার থেকে ও-পার পর্যন্ত বিনা তারে সংবাদ আদান-প্রদান করতে সক্ষম হন মার্কোনি। সে কালের বিজ্ঞানীরা অনভিজ্ঞ মার্কোনির এ স্বপ্নের সফলতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন এই ভেবে যে, ভূপৃষ্ঠের বক্রতার জন্য বহু দূরবর্তী অঞ্চলে এ ধরনের বার্তা পাঠানো সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি এ অসম্ভবকে সম্ভব করলেন ১৯০১ সালে এবং আটলান্টিকের এ-পার থেকে ও-পারে বেতারসংকেত পাঠাতে সক্ষম হলেন। তাঁর এ সাফল্য ছিল মানবজাতির জন্য যুগান্তকারী।
১৯০১ সালে গুগলিয়েলমো মার্কোনি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে তারবিহীন সংযোগ (বেতার) স্থাপন করেন। বেতার হল তার ব্যতীত যোগাযোগের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। রেডিও (বেতার), টেলিভিশন (দূরদর্শন), মোবাইল ফোন, ইত্যাদি সহ তারবিহীন যে কোনও যোগাযোগের মূলনীতিই হল বেতার।
১৯০৯ সালে সরকার কর্তৃক তিনি সম্মানিত হন এবং ইতালি সরকার তাঁকে আজীবন সিনেট সদস্য নির্বাচিত করে। ১৯০৯ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে মার্কোনি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন (তিনি কার্ল ব্রাউনের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে এ পুরস্কার পান)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্কোনি ইতালীয় বেতার-সার্ভিসের কমান্ডার নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯২৯ সালে ইতালির তৎকালীন রাজা তাঁকে ‘মারকুইস’ খেতাব দান করেন। অবশ্য মার্কোনির আগেও ম্যাক্সওয়েল, হার্জ, কেলভিন, বাঙালি স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, আলেকজান্ডার পপোভ প্রমুখ বিজ্ঞানী এ বিষয়ে গবেষণা করে গেছেন।
রেডিও সম্পর্কে আরও একটা অজানা তথ্য হল, মার্কোনি রেডিও আবিষ্কার করার আগেই আমাদের দেশের বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু রেডিও আবিষ্কার করেছিলেন কিন্তু তিনি তখন এর স্বীকৃতি নিতে পারেননি। তবে তাঁদের সেই অসমাপ্ত কাজকে সাফল্যের দিকে ধাবিত করে বিজ্ঞানী মার্কোনি অমর হয়ে আছেন। সম্প্রতি জগদীশ চন্দ্র বসু প্রথম বেতার আবিষ্কারক হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন । ইনস্টিটিউট অফ ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারস স্যার জগদীশচন্দ্র বসুকে রেডিও আবিষ্কারক হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে। স্বীকৃতিস্বরূপ জগদীশ বসুর স্মরণে তারা কলকাতায় একটা মাইল ফলক স্থাপন করেছে । প্রসঙ্গত এশিয়ার টোকিও ছাড়া কলকাতাই হল দ্বিতীয় শহর যেখানে এই মাইল ফলক স্থাপন করা হয়েছে । আর মার্কোনির নাতি কয়েক দিন আগে কলকাতায় এসে স্বীকার করে নেন জগদীশচন্দ্র বসুকে রেডিও আবিষ্কারক হিসাবে।
বেতার আবিষ্কারক গুগলিয়েলমো মার্কোনি ১৯৩৯ সালের ২০ জুলাই মাত্র ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র : বিশ্বের সেরা ১০১ বিজ্ঞানীর জীবনী, আ. ন. ম. মিজানুর রহমান পাটওয়ারি, মিজান পাবলিশার্স, ঢাকা
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/11/2020