কালচে রঙের কিছুটা বড় মাপের তন্বী বোলতা, ভীষণ ব্যস্ত ভাবে যাতায়াত করছে ঘরের ভেতরে। তার টারগেট হল আমাদের লফটে রাখা একটা খালি বাক্স। একটু ভালো করে দেখলেই বোলতা রমণীর মুখে ধরে থাকা মাটির দানা দেখা যাবে। বোলতাটি কুমোরে পোকা বা potter wasp। কিছু কুমোরে পোকা মাটি দিয়ে ভরে দেয় প্লাগ পয়েন্টের গর্ত, আবার কেউ কেউ দেওয়ালের খাঁজে, টেবিলের তলায়, ফেলে রাখা কাগজপত্র বা বাক্স ইত্যাদির গায়ে তৈরি করে ছোট্ট সুন্দর বাসা। আমদের লফটে একটা পুরনো ব্যাগ অনেক দিন রাখা ছিল এক সময়, কারণ তার বিভিন্ন খাঁজে ছিল ডজনখানেক কুমোরে পোকার বাসা। এই বাক্সটার দেওয়ালে ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে বাসার আধখানা, একটা ক্ষুদে বাটির মতো।
জীবজগতে বাসা তৈরি করা হয় প্রধানত সন্তান পালনের জন্য। বাসা তৈরিতে সব চেয়ে এগিয়ে রয়েছে পাখিরা। ডিম পাড়ার সময় হলে পাখি দম্পতিরা ব্যস্ত হয়ে ওঠে আগামী প্রজন্মকে নিশ্চিন্ত আশ্রয় গড়ে দেওয়ার চেষ্টায়। বাসার কথা ভাবলে আর যাদের কথা মনে পড়ে, তারা হল মৌমাছি, পিঁপড়ে, আর উইপোকারা। এদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হলেও বোলতারা সচরাচর ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। অথচ তারা কিন্তু মৌমাছি বা পিঁপড়েদের থেকে খুব পিছিয়ে নেই। যে সব বোলতা সামাজিক তাদের কথা ছেড়ে দিলেও এই কুমোরে পোকারা মাতৃত্বের এক সুন্দর নিদর্শন।
মা বোলতাকে কেউ শিখিয়ে দেয় না কী করে বাসা তৈরি করতে হয়। সব কিছুই programmed হয়ে থাকে gene-এ। প্রকৃতিতে এদের বিবর্তন এমন ভাবেই ঘটেছে যে মা-বোলতা ‘জানে’ তার কী কাজ। বাসা বানাবার উপযুক্ত মাটি খুঁজে এনে তাকে লালা দিয়ে ভিজিয়ে নরম করে একটু একটু করে গড়ে তুলতে হবে ঘটের মতো ছোট্ট বাসা। বাসা যখন প্রায় তৈরি, তখন খুঁজতে হবে নধর কোনও গুটিপোকা (caterpillar)। এই পোকাকে সে হুল ফুটিয়ে অসাড় করে ভরে দেবে বাসার মধ্যে, তার গায়ে নিজের ডিম পেড়ে আরও মাটি এনে বাসার মুখ বন্ধ করে দেবে। অসাড় গুটিপোকা বেঁচে থাকবে কিন্তু পালাতে পারবে না। কোনও কোনও কুমোরে পোকা একাধিক গুটিপোকা এনে বাসাকে বোঝাই করে, কেউ একই বাসায় অনেক ডিম পাড়ে, কেউ আবার আলাদা আলাদা বাসা তৈরি করে প্রতিটা ডিমের জন্য। বাসার মুখ বন্ধ করে দিয়ে উড়ে যায় বোলতা-মা।
তারপর ? সন্তানদের জন্য রসদ জোগাড় করে, তাদের সুরক্ষিত করে কাহিল হয়ে পড়া মা মারা যায়। ডিম ফুটে বের হয় ছোট্ট লার্ভা-ছানারা। প্রজাপতিদের মতো এদেরও ডিম ফুটে বের হয় গুটিপোকা, যাদের কাজ শুধু খাওয়া আর বেড়ে ওঠা। বাড়তে বাড়তে যখন বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়, তখন এক সময় নিজেরাই বুনে নেয় গুটি, তার ভেতরে নানা রকম শারীরিক পরিবর্তনের (মেটামরফোসিস) পর বেরিয়ে আসে প্রাপ্তবয়স্ক পোকারা। বোলতা-মা’র জুগিয়ে যাওয়া রসদ খেয়ে বেড়ে ওঠে লার্ভারা, সময়মতো তৈরি করে গুটি। শেষে মাটির দুর্গ ভেঙে বেরিয়ে আসে বোলতা স্ত্রী-পুরুষেরা। বেরিয়েই তারা খুঁজে নেয় একে অন্যকে, গন্ধ দিয়ে, মিলিত হয়। প্রকৃতিতে এদের জীবনযাত্রা খুবই হিসেবি , অপচয় খুব কম – পুরুষদের প্রয়োজন ফুরোলে তাদের জীবনও শেষ হয়ে যায়। দিনের আলোয়, খোলা হাওয়ায় উড়ে বেড়াবার সময় তাদের খুবই সীমিত। সদ্য আলো দেখা মা-বোলতাদের সামনে তখন অনেক কাজ – নিজের সন্তানদের ভবিষ্যত গড়ে দিয়ে যেতে হবে তাকে, যেমন তার জন্য দিয়েছিল তার মা।
ছবি : নাতাশা মাহত্রে
সূত্র: অনিন্দিতা ভদ্র, আইআইএসইআর, কলকাতা, bigyan.org.in
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/20/2020