অসমীয়া   বাংলা   बोड़ो   डोगरी   ગુજરાતી   ಕನ್ನಡ   كأشُر   कोंकणी   संथाली   মনিপুরি   नेपाली   ଓରିୟା   ਪੰਜਾਬੀ   संस्कृत   தமிழ்  తెలుగు   ردو

ডাক্তার মধুসূদন গুপ্ত

ডাক্তার মধুসূদন গুপ্ত

১৮৩৬ সালের ২৮ অক্টোবর। আগের বছর পয়লা জুন প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে।  সারা কলকাতায় সে এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী খবর, এমনকী সারা এশিয়ার চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম সংস্কার ভাঙার  খবর। মেডিক্যাল কলেজের ফটকগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, পাছে এই বিধর্মী কাজ বন্ধ করার জন্য প্রাচীনপন্থীরা কলেজে আক্রমণ চালায়! মেডিক্যাল কলেজের শব রাখার ঘরে ভিড়, উপস্থিত রয়েছেন কলেজের সব ইংরেজ অধ্যাপক ডাক্তাররা, সঙ্গী ছাত্রবন্ধুরা ভিড় করে দাঁড়িয়েছে ঘরের বাইরের দরজায়, ঘরের ঝিলমিলের ফাঁকে ফাঁকে চোখ রেখে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে অনেকে। সারা ক্যাম্পাস ফাঁকা, সবাই শবঘরের কাছে ভিড় করে এসেছে। নির্দিষ্ট সময়ে ডাক্তার গুডিভের সঙ্গে দৃপ্তপদে ঘরে ঢুকলেন একদা সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদ বিভাগের ছাত্র পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত।

বর্তমানে পণ্ডিত গুপ্ত একই সঙ্গে মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ও ছাত্র। ডাক্তারি শাস্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ সার্জারি, যা ভারতে এখনও করানো সম্ভব হয়নি, শব ব্যবচ্ছেদ নিয়ে বর্ণহিন্দুদের গোঁড়া কুসংস্কারের জন্য, সেই কাজটিই আজ করতে এসেছেন পণ্ডিত মধুসূদন, হাতে তাঁর একটি শব ব্যবচ্ছেদ করার তীক্ষ্ণ ছুরি।

তাঁর সঙ্গে  যোগ দেওয়ার জন্য দলে নাম ছিল উমাচরণ শেঠ, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীন চন্দ্র মিত্রের। কিন্তু তাঁরা দরজার  বাইরেই ভিড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ঘরে ঢুকে মধুসূদন বিনা দ্বিধায় এগিয়ে গেলেন শবের দিকে। শবদেহের নির্ভুল জায়গায় ছুরিটি প্রবেশ করালেন তিনি। মুখে কোনও আড়ষ্টতা বা অস্থিরতার চিহ্ন নেই। খুব নিখুঁত ভাবে আর সুন্দর ভাবে বিনা দ্বিধায় সম্পন্ন করলেন ব্যবচ্ছেদের কাজ। ভারতবর্ষের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞানী শুশ্রূতের পরে এই প্রথম হল শবব্যবচ্ছেদ। দীর্ঘকালের কুসংস্কারের আর গোঁড়া পণ্ডিতদের বাধানিষেধের বেড়া ভেঙে দিলেন তিনি এই একটি কাজের মাধ্যমে। নিষেধের জগদ্দল ভার সরিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ভারত এক নতুন যুগে প্রবেশ করল।

মধুসূদন গুপ্ত ছিলেন হুগলি জেলার বৈদ্যবাটি গ্রামের এক বৈদ্য পরিবারের সন্তান। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক এই পরিবারের সমাজে খুব নামডাক ও প্রতিপত্তি ছিল। তাঁর প্রপিতামহ ‘বকশি’ উপাধি পেয়েছিলেন আর পিতামহ ছিলেন হুগলির নবাব পরিবারের গৃহচিকিৎসক। তাঁর জন্ম সম্ভবত ১৮০০ সালে, যে বছর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা হয় কলিকাতায়। ছেলেবেলায় খুব দুরন্ত মধুসূদনের প্রথা বিরোধী কাজকর্মেই উৎসাহ ছিল বেশি। প্রথাগত লেখাপড়ায় তাঁর ছিল একান্ত অনীহা। কোনও উচ্চাশা ছিল না। শোনা যায় লেখাপড়ায় অমনোযোগী কিশোর মধুসূদনকে তাঁর পিতা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

এর পরবর্তী কিছু দিনের কথা বিশেষ জানা যায় না। তাঁকে আবার দেখা গেল ১৮২৬ সালে ডিসেম্বরে সংস্কৃত কলেজের সদ্যস্থাপিত বৈদ্যক (আয়ুর্বেদ) বিভাগের ছাত্র হিসাবে। সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণ, ন্যায়, কাব্য ,অলঙ্কার, সাহিত্য পাঠের সঙ্গে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও অসামান্য ব্যুৎপত্তি দেখান তিনি। অসামান্য মেধার অধিকারী মধুসূদন গুপ্ত নিজের পারদর্শিতায় অল্প দিনের মধ্যেই ক্লাসের এক জন নামকরা ছাত্র হয়ে উঠলেন। সংস্কৃত কলেজে আয়ুর্বেদিক ক্লাসের প্রশিক্ষণের সময় তিনি (কাঠ বা মোমের তৈরি) মানুষের হাড়গোড় খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন, কখনও নিজেই ছোট ছোট জীবজন্তু ব্যবচ্ছেদ করে অভিজ্ঞতা ও সাহস সঞ্চয় করেছিলেন। এই সময় কলেজে ইংরেজিতে লেখা ডাক্তারি বই আরবি ও সংস্কৃতে অনুবাদ করে ছাত্রদের বোধগম্য করানো হত। এ সব বই-ই তিনি নিজে থেকে পড়ে ফেলেছিলেন।

তাঁর অভিজ্ঞতার বহর ও পারদর্শিতা কলেজ কর্তৃপক্ষের নজর এড়ায়নি। তাঁর পারদর্শিতার জন্য সংস্কৃত কলেজের এই বিভাগের অধ্যাপক ক্ষুদিরাম বিশারদ অসুস্থ হয়ে পড়াতে বৈদ্যক শ্রেণির কৃতী ছাত্র মধুসূদন গুপ্তকে ১৮৩০ সালের মে মাস থেকে সেই পদে নিয়োগ করা হয়, ও অধ্যাপকের কাজের জন্য মাসিক ৩০ টাকা বেতন নির্ধারিত হয়। সহপাঠী ছাত্র মধুসূদনের অধ্যাপকপদ প্রাপ্তিতে ছাত্রদের মধ্যে বিশেষ অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তাঁর পাঠদানের দক্ষতায় সেই অসন্তোষ অচিরেই দূর হয়ে যায়। কারণ তাঁর দক্ষতা।

১৮৩২ সালের প্রথমেই সংস্কৃত কলেজের লাগোয়া এক তলা একটি বাড়িতে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়, স্থানীয়দের চিকিৎসা আর ওষুধপত্র দানের জন্য। সংস্কৃত কলেজের মেডিক্যাল লেকচারার জে গ্রান্ট সাহেব ও ডাঃ টাইটলার এই নতুন কলেজবাড়িতে এসে ক্লাস নিতেন ও চিকিৎসা বিষয়ে বিশেষত অ্যানাটমি আর মেডিসিনের তত্ত্ব এবং প্রয়োগ বিষয়ে সারগর্ভ  বক্তৃতা দিতেন। মধুসূদন নিয়মিত মনোযোগ দিয়ে সেই বক্তৃতা শুনতেন। ফলে পাণ্ডিত্যে তিনি সহপাঠীদের থেকে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ১৮৩৫ সালে স্ংস্কৃত কলেজের বৈদ্যক বিভাগ বন্ধ হয়ে যায় আর ছাত্ররা সব মেডিক্যাল কলেজের ক্লাসে যোগ দেয়। আর ছাত্র মধুসূদনও ১৮৩৫ সালের ১৭ মার্চ থেকে মেডিক্যাল কলেজের ডেমনস্ট্রেটরের কাজে নিযুক্ত হন ও সহকারী অধ্যাপকের পদে কাজ করতে থাকেন। কিন্তু এক জন সহপাঠীর কাছে পাঠ নিতে ছাত্ররা আপত্তি করে। তাদের আপত্তির কারণ ছিল মধুসূদন তখনও ডাক্তারি পাশ করেননি, তিনি সামান্য কবিরাজ মাত্র। এই আপত্তি জোরালো হলে কলেজের কাজে অসুবিধা দেখা দেবে, কেননা কবিরাজ হলেও তিনি ডাক্তারি বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষ। তাই ছাত্রদের অসন্তোষ প্রশমনের জন্য কলেজের কর্তৃপক্ষ পাশ করা ডাক্তারের ডিগ্রি নেওয়ার জন্য তাঁকে ডাক্তারি পরীক্ষার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে বলেন। তিনি রাজি হয়ে যান ও ডাক্তারি পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে কবিরাজ থেকে ডাক্তারে পরিণত হন।

আসলে ছয় বছর সংস্কৃত কলেজে ও ইংরাজির ক্লাস করার আগে থেকেই তিনি দেশীয় পদ্ধতিতে রোগনির্ণয়, নিদান দিতে শিখেছিলেন ‘কেবলরাম কবিরাজ’ নামে এক জন অভিজ্ঞ দেশীয় কবিরাজের কাছে। সে সময়ে তিনি কবিরাজ-গুরুর নির্দেশে গ্রামে গ্রামে রোগী দেখতেও যেতেন। তা ছাড়া ইংরেজ শিক্ষকদের বক্তৃতাগুলি নিষ্ঠার সঙ্গে শুনেছেন পাঁচ বছর ধরে। সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শেষের দু’টি বছর তাঁকে সাহেব ডাক্তাররা সহকারী করে নিয়েছিলেন। তখন তাঁর কাজ ছিল নিজে বক্তৃতা শোনার সাথে সাথে, দেশীয় ছাত্রদের ইংরেজি শব্দগুলিকে সংস্কৃতে ও বাংলায় তর্জমা করে দেওয়া। কেবলরাম কবিরাজের সহযোগী হিসাবে কাজ করার সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরেছেন, আর সেখানকার মানুষের অসুবিধা রোগের কারণ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। কলকাতায় বিখ্যাত সার্জন জেমস রেনাল্ড মার্টিন যখন দেশের মানুষদের স্বাস্থ্য আর ম্যালেরিয়া জ্বরের প্রকোপ বন্ধ করতে তৎপর হয়েছিলেন এবং কলিকাতার সমস্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে ১৯৩৫ সালে এক সাধারণ মিটিং ডাকেন আর ‘জেনারেল কমিটি অফ দ্য ফিভার হসপিটাল অ্যান্ড মিউনিসিপ্যাল ইমপ্রুভমেন্ট’-এর প্রতিষ্ঠা করেন, তখন প্রথমেই যোগ্য ব্যক্তি হিসাবে মধুসূদন গুপ্তকে তলব করেন ও তাঁর পরামর্শে কমিটির কাজকর্ম শুরু হয়। এই মিটিঙেই তাঁর সকল অভিজ্ঞতার কথা জানা যায় ও তাঁর মূল্যবান পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। তাঁর  পরামর্শ মোতাবেক গড়ে ওঠে ‘হিন্দু ধাত্রী’ কর্মচারীদল গঠনের পরিকল্পনা যাতে বহু হিন্দু মেয়ের কর্মসংস্থান হয়, রাস্তাঘাট পরিষ্কারের নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হয়, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, নিকাশি ব্যবস্থার সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। (তিনি বিভিন্ন বাজার এলাকার আবর্জনা ভর্তি অবস্থা, ঘনবসতি এলাকার মানুষের নানা অসুবিধার কথা প্রত্যক্ষ দর্শনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ব্যক্ত করেছিলেন কমিটির সদস্যদের সামনে)।

তাঁর সকল কার্যকলাপ, জ্ঞান আর পরীক্ষায় চূড়ান্ত সফলতার অভিজ্ঞান হিসাবে  ১৮৪০ সালের ২৬ নভেম্বর মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর ডাক্তারির চূড়ান্ত পরীক্ষার উত্তরপত্রটির ব্যাপারে এই মর্মে একটি শংসাপত্র দেন যে, “বৈদ্যবাটীর মধুসূদন গুপ্তর উত্তরপত্রটি যত্ন করে পরীক্ষা করে বুঝেছি যে শারীরসংস্থান, শারীরবৃত্ত, রসায়ন ,মেটিরিয়া মেডিকা ইত্যাদিতে তাঁর অসামান্য জ্ঞান আর ঔষধ, শল্যচিকিৎসা ও তার ব্যবহারিক প্রয়োগক্ষমতা বিষয়ে তাঁর দক্ষতা সংশয়াতীত।”

মেডিক্যাল কলেজে একটি হিন্দুস্থানি বিভাগ ছিল। ১৮৪৩-৪৪ সালে এই বিভাগটি ঢেলে সাজা হয়, ও সেটির সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিযুক্ত করা হয় মধুসূদন গুপ্তকে। এর পরে ১৮৫২ সালে বাংলা  বিভাগ খোলা হলে তার দায়িত্বও তাঁকে দেওয়া হয়। ১৮৫৬ সালে  মৃত্যু পর্যন্ত তিনি (২২ বছর) মেডিক্যাল কলেজের এই পদে বহাল ছিলেন।

শুধুমাত্র শিক্ষাদানের কাজ ছাড়াও তাঁর দু’টি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল ‘লন্ডন ফার্মাকোপিয়া’ (১৮৪৯ সালে)  আর ‘অ্যানাটমি’ (১৮৫৩ সালে) নামে বই দু’টির ইংরাজি থেকে বাংলা অনুবাদ করা। এই সময়েই ১৮৪৯ সালের ২৭শে জুন তিনি ‘ফার্স্ট ক্লাস সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন’ পদে উন্নীত হন। সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময়ই তিনি হুপারের লেখা “Anatomist’s Vade Mecum”  নামে  বইটির সংস্কৃত অনুবাদ করে ১০০০ টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন।

কলকাতার জনস্বাস্থ্য, পানীয় জলের স্বচ্ছতা,  পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা, টিকাকরণের ব্যবস্থা প্রভৃতি জনসমস্যা  বিষয়ে তাঁর বিশেষ নজর ছিল। কমিটিতে সে বিষয়ে তিনি মূল্যবান পরামর্শও দিয়েছিলেন।

নিজে ছিলেন ডায়াবেটিক রোগী। কিন্তু বারণ না শুনে জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েও অনবরত শবব্যবচ্ছেদ করতেন অন্যদের এ কাজে সাহস জোগাতে। জীবাণু সংক্রমণে ডায়াবেটিক সেপ্টিসিমিয়াতে আক্রান্ত হয়ে ১৮৫৬ সালের ১৫ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।

আজ মেডিক্যাল কলেজ কত উন্নত হয়েছে, দেশ এগিয়েছে, কিন্তু ভারতীয় সার্জারির ইতিহাসের দ্বার খুলে দেওয়ার এই পথপ্রদর্শকের কথা কি সে ভাবে মনে রেখেছি আমরা ?

লেখক : উমা ভট্টাচার্য, প্রাক্তন শিক্ষিকা

সূত্র: bigyan.org.in

সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/28/2020



© C–DAC.All content appearing on the vikaspedia portal is through collaborative effort of vikaspedia and its partners.We encourage you to use and share the content in a respectful and fair manner. Please leave all source links intact and adhere to applicable copyright and intellectual property guidelines and laws.
English to Hindi Transliterate