সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর (১৯ অক্টোবর, ১৯১০ - ২১ আগস্ট, ১৯৯৫) ভারতে জন্মগ্রহণকারী এক জন মার্কিন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী। তিনি এক তামিল পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তারার বিবর্তন এবং জীবনচক্র সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক আবিষ্কারের জন্য তাঁকে উইলিয়াম আলফ্রেড ফাউলারের সঙ্গে যৌথ ভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। তারার বিবর্তন বিষয়ে তাঁর আবিষ্কৃত বিষয়টির নাম চন্দ্রশেখর সীমা।
১৯২৮ সালে চন্দ্রশেখর ব্রিটেনের স্বনামধন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের অধীনে অধ্যয়নের জন্য কেমব্রিজে আসেন। ভারত থেকে ইংল্যান্ড আসার পথে জাহাজে বসে তিনি গাণিতিক ভাবে চিন্তা করতে থাকেন, একটি তারার ভর সর্বোচ্চ কত হলে সব জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার পর তার মহাকর্ষীয় সংকোচন ঠেকানোর মতো বল সৃষ্টি হতে পারে। তিনি দেখেন জ্বালানিবিহীন তারাটি সংকুচিত হতে হতে যখন অনেক ছোট হয়ে যাবে তখন এর কণাগুলো পরস্পরের অতি সন্নিকটে আসবে এবং একটি অপজাত অবস্থার সৃষ্টি হবে। পাউলির বর্জন নীতি অনুসারে একই অরবিটালের দু’টি ইলেকট্রনের স্পিন ভিন্ন হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে যে হেতু পারমানবিক গঠন নেই, তাই অতি সন্নিকটে অবস্থিত অপজাত কণাই ইলেকট্রনের কাজটি করবে, অর্থাৎ তাদের গতিবেগ (স্পিনের বদলে) হতে হবে অনেক ভিন্ন। এর ফলে কণাগুলো একে অন্যের কাছ থেকে প্রবল বেগে দূরে সরে যাবে যা তারাকে প্রসারিত করার জন্য একটি বহির্মুখি বল প্রয়োগ করবে। এ ভাবে মহাকর্ষীয় সংকোচন ও অপজাত চাপের মধ্যে যে সাম্যাবস্থার সৃষ্টি হবে তার কারণে শ্বেত বামন তারার জন্ম হবে। অবশ্য চন্দ্র বুঝতে পেরেছিলেন, বর্জন নীতি একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্তই সাম্যাবস্থা রক্ষার মতো অপজাত চাপ সরবরাহ করতে পারে। সাধারণ আপেক্ষিকতা আলোর বেগকে সর্বোচ্চ বলে সব কণার বেগ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিল। তাই দেখা গেল, এক সময় বর্জন নীতির কারণে সৃষ্ট অপজাত চাপ মহাকর্ষীয় সংকোচন বলের কাছে হার মানবে। চন্দ্র হিসাব করে দেখেন, যে তারার ভর সূর্যের ভরের ১.৪ গুণের চেয়ে বেশি তার মহাকর্ষীয় সংকোচন বল অপজাত চাপের থেকে বেশি হবে এবং তারাটিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এই সীমাটিকে চন্দ্রশেখর সীমা বলা হয়।
চন্দ্রশেখর সীমা হল স্থিতিশীল শীতল শ্বেত বামন তারকার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ভর। ভর এর চাইতে বেশি হলে তারকাটি চুপসে কৃষ্ণবিবরে পরিণত হবে।
১৯৩১ সালে ভারতীয় জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর দেখান যে, একটি শ্বেত বামন তারকার জন্য এই ভরের মান ১.৪১ সৌরভরের সমান। এবং এই পর্যায়ে তারাটি ঘূর্ণায়মান হবে। তাঁর নামানুসারে এই সীমার নামকরণ করা হয়েছে। তবে দ্রুত এবং বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন ঘূর্ণন হার বিশিষ্ট তারার জন্য ডুরিসেন (১৯৭৫) দেখান যে, এই ভরের মান ৩ সৌরভরের সমান হতে পারে। শ্বেত বামন তারার ভর বেশি হলে মহাকর্ষ একে সংকুচিত করে ফেলতে চায়। ফলে এর অন্তর্গত ইলেকট্রনগুলি উচ্চতর শক্তিদশায় পৌছে এবং এদের গতিবেগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপও বাড়তে থাকে। পদার্থের এ ধরনের পরিস্থিতিকে বলে অপজাত অবস্থা (degenerate matter)। মহাকর্ষের ক্রমবর্ধমান চাপে একই কোয়ান্টাম দশায় একাধিক ইলেকট্রন থাকার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু ইলেকট্রন হল ফার্মিয়ন। এরা ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলে। এরা পলির বর্জন নীতি অনুমোদন করে। পলির বর্জন নীতি অনুযায়ী একই কোয়ান্টাম দশায় একাধিক ইলেকট্রন থাকতে পারে না। তাই একাধিক ইলেকট্রনকে একই কোয়ান্টাম দশায় আসতে বাধ্য করা হলে এরা এক রকমের চাপ দেয় যা ফার্মি-চাপ বা অপজাত চাপ নামে পরিচিত। এই চাপের উপস্থিতিতে তারাটি অন্তর্মুখী মহাকর্ষ বলকে কোনও ক্রমে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় এবং শ্বেত বামনে পরিণত হয়। চন্দ্রশেখর গাণিতিক ভাবে দেখান যে, সর্বোচ্চ যে ভর থাকলে তারাটি এই অবস্থায় পৌছতে পারে তা ১.৪১ সৌরভরের সমান। এরচেয়ে বেশি ভরবিশিষ্ট তারার পরিণতি কৃষ্ণবিবর।
সূত্র : বিশ্বের সেরা ১০১ বিজ্ঞানীর জীবনী, আ. ন. ম. মিজানুর রহমান পাটওয়ারি, মিজান পাবলিশার্স, ঢাকা
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/26/2020