অসমীয়া   বাংলা   बोड़ो   डोगरी   ગુજરાતી   ಕನ್ನಡ   كأشُر   कोंकणी   संथाली   মনিপুরি   नेपाली   ଓରିୟା   ਪੰਜਾਬੀ   संस्कृत   தமிழ்  తెలుగు   ردو

অনেক ভারত, এক মকর সংক্রান্তি

অনেক ভারত, এক মকর সংক্রান্তি

জহর সরকার
সিইও, প্রসার ভারতী

ভারতে ‘বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য’ নিয়ে আমরা অনেক কথা বলে থাকি, কিন্তু কথাটার সত্য অর্থ উপলব্ধি করতে চাইলে আমাদের কিছু নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। যেমন, এমন নানা উৎসব আছে, যেগুলির ঐতিহাসিক উৎস বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম, অথচ অনেক জায়গাতেই যেগুলি বছরের কোনও একটি সময়েই উদযাপিত হয়ে আসছে। আমরা আমাদের উৎসবগুলির ‘বহুমুখী বৈচিত্র্য’ উপভোগ করি, কিন্তু আমরা আবার একটা অলিখিত বোঝাপড়া করে নিয়েছি যে, কয়েকটি দিনের মধ্যেই আমরা সেই উৎসব করব। বিভিন্ন আঞ্চলিক উৎসবকে সময়ের দিক থেকে একটা শৃঙ্খলায় আনার এই প্রক্রিয়াটি প্রায় দুই সহস্রাব্দের নিরন্তর বিবর্তনের পরিণাম। এ বিষয়ে ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে। হোলি, দেওয়ালি, নবরাত্রি, দুর্গাপুজো থেকে শুরু করে বিভিন্ন সর্বভারতীয় উৎসবে এই প্রক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে।

যেমন মকর সংক্রান্তি। সাধারণত ১৪ জানুয়ারি বা তার এক দিন আগে-পরে এই তিথি আসে। তবে বিভিন্ন অঞ্চলে এই উৎসবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, তার মেয়াদও আলাদা হয়ে থাকে, কোথাও কোথাও চার দিন অবধি উৎসব চলে। বাংলায় পৌষ সংক্রান্তি, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাতে উত্তরায়ণ, অসমে ভোগালি বিহু, পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ ও জম্মুতে লোহরি, কর্নাটকে মকর সংক্রমণ, কাশ্মীরে শায়েন-ক্রাত। উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চল, ওডিশা, মহারাষ্ট্র, গোয়া, অন্ধ্র, তেলঙ্গানা এবং কেরলে মকর সংক্রান্তি নামটিই চলে, যদিও তার পাশাপাশি স্থানীয় নামেরও প্রচলন আছে, যেমন মধ্যপ্রদেশে সুকরাত বা বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের কোনও কোনও এলাকায় খিচড়ি পর্ব। অন্য দেশেও হিন্দুধর্ম প্রভাবিত উৎসবের বহুমুখী ঐক্য আছে, যেমন নেপালে এই সময়ে মাঘে সংক্রান্তি পালিত হয়, তাইল্যান্ডে সোংক্রান, কাম্বোডিয়ায় মোহা সোংক্রান, মায়ানমারে থিংইয়ান, লাওস-এ এর নাম হল পি মা লো।

কিন্তু এই দিনটির মাহাত্ম্যটা কী? রাশিচক্রের বিচারে এই তিথিটিতে সূর্য মকর রাশিতে (ক্যাপ্রিকর্ন) প্রবেশ করে। লক্ষণীয়, এখন এই তিথিটা পড়ছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ১৪ জানুয়ারির আশেপাশে, কিন্তু এক হাজার বছর আগে মকর সংক্রান্তি হত ৩১ ডিসেম্বর নাগাদ, আবার এক হাজার বছর পরে সেটি ফেব্রুয়ারিতে সরে যাবে। এই তিথিতে বাংলা বছরের ‘অশুভ’ পৌষ মাসের অবসান হয়, আবহাওয়ার দিক থেকে দেখলে ধরে নেওয়া হয় যে, এর পর শীতের প্রকোপ কমে আসবে। ভারতের উত্তরের দেশগুলিতে ২২ বা ২৩ ডিসেম্বরের সময়টি খুব আনন্দ-উচ্ছ্বাসে পালিত হয়, কারণ ওই সময়েই সূর্য উত্তরে যাত্রা শুরু করে, যার নাম সূর্যের উত্তরায়ণ, ফলে ঠান্ডা কমতে থাকে। এবং এটাই হল খ্রিস্টপূর্ব যুগের ইয়ুলটাইড উৎসব, পরে ক্রিসমাস যাকে গ্রাস করে নেয়!

আমাদের দেশে মকর সংক্রান্তির বিভিন্ন রূপের দিকে একটু ভালো করে তাকানো যাক। তামিলনাড়ুতে মহা ধুমধামে পোঙ্গল উদযাপন করা হয়, আমাদের হিসেবে পৌষ মাসের শেষ দিনে এর শুরু, চলে পরের মাসের (ওঁরা সেই মাসটিকে বলেন ‘থাই’) তৃতীয় দিন অবধি। তেলুগু অঞ্চলেও এই উৎসব চার দিনের, যদিও অন্য বেশির ভাগ অঞ্চলেই তা এক বা দু’দিনের ব্যাপার। পঞ্জাবের লোহরির মতোই তামিলরা প্রথম দিনে কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বালান এবং সেই আগুনে পুরনো কাপড়চোপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র আহুতি দেন: জীর্ণ পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে নতুনের আবাহন। পরের দিন দুধ আর গুড় মিশিয়ে চার মধ্যে নতুন ‘ভাজা’ চাল এবং মুগডাল ফোটানো হয়, যতক্ষণ না সেই দুধ উথলে ওঠে; এবং দুধ উথলে ওঠার জন্য এই দিনটিতে বাড়ির বউকে বকুনি খেতে হয় না, বরং তিনি অভিনন্দিত হন, কারণ দুধ ওথলানোকে শুভলক্ষণ বলে গণ্য করা হয়, তাই সবাই উচ্চকণ্ঠে ‘পোঙ্গালো পোঙ্গল’ বলে হর্ষ প্রকাশ করেন।

একটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো। এই সময় পঞ্জাব থেকে তামিলনাড়ু পর্যন্ত সব জায়গায় উৎসবের সময় গুড় এবং তিলের মিষ্টি থাকবেই থাকবে, কারণ আখ এবং তিলের ফসল এই মরসুমেই ঘরে ওঠে। কিন্তু কেরল বা পশ্চিমবঙ্গের মতো আর্দ্র জলবায়ুর এলাকাগুলিতে এই দু’টি ফসলের কোনওটিই বিশেষ হয় না, তাই সেখানে অন্য অঞ্চলের তুলনায় সংক্রান্তির ধুমধাম কম। সত্যি বলতে কী, অনেক বাঙালিরই পৌষ সংক্রান্তির কথা তখনই মনে পড়ে, যখন তাঁরা দেখেন, প্রতিবেশী নানান রাজ্য থেকে দলে দলে মানুষ গঙ্গাসাগরের পথে চলেছেন। তবে হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরল, দুই রাজ্যেই নারকেলের মিষ্টি সংক্রান্তির সময় (এবং অন্য সময়েও) খুবই জনপ্রিয় — এক ধরনের রাজনীতি এবং তর্কপ্রিয়তা ছাড়াও এই দুই অঞ্চলের মধ্যে মিল আছে বটে। বাংলায় আখের গুড়ের জায়গায় খেজুর গুড়ের বিশেষ প্রচলন এবং সংক্রান্তিতে তাই তিলের নাড়ু ছাড়াও পুলিপিঠে, পাটিসাপটার খুব কদর।

অসমেও এই সময় নতুন ধান ওঠে, তাই উপবাস, ভোজ এবং বহ্ন্যুত্সবের মধ্যে দিয়ে জমে ওঠে ভোগালি বিহু। পঞ্জাব থেকে বিহার পর্যন্ত গোটা উত্তর ভারতে তিল, গুড় এবং দুধের মিষ্টান্নের পাশাপাশি অত্যন্ত জনপ্রিয় হল চাল, ডাল এবং মরসুমি সবজি দিয়ে তৈরি খিচুড়ি। আবার পঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে আছে সুজির হালুয়া, আর তামিলনাড়ুর মতো কিছু রাজ্যে দুধ আর চালের পায়েস এবং মিষ্টি।

গোটা ভারতে, এমনকী বাংলা ও কেরলেও ‘গঙ্গাস্নান’-এর মহিমা অপার। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র সুবিধেজনক বিধানও দিয়েছে: কোনও একটা স্থানীয় নদীকে ‘গঙ্গা’ হিসেবে চালিয়ে নেওয়া যায়। গরুবাছুরকেও পুণ্যস্নান করানো হয়, তারা সেটা পছন্দ করুক বা না করুক। কোথাও কোথাও তাদের শিং দু’টো নানা রঙে রাঙিয়ে নেওয়া হয়, কিংবা রকমারি ফিতে, ছোট ছোট ঘণ্টি কিংবা পুঁতি দিয়ে সাজানো হয়। তাদের নিয়ে শোভাযাত্রা করা হয়, কোনও কোনও রাজ্যে গরুর গাড়ির রেসও হয়। তামিলনাড়ু আবার এক কাঠি এগিয়ে: সেখানে ষাঁড়কে বাগে আনার প্রতিযোগিতা হয়, তার নাম জাল্লিকাট্টু। স্পেনের ষাঁড়ের লড়াইয়ের সঙ্গে এর মিল আছে। ক্রুদ্ধ দুর্দান্ত ষাঁড়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মানুষের শক্তি ও দক্ষতার পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু এই লড়াইয়ে মানুষ এবং প্রাণী, দুইয়েরই হতাহত হওয়ার ঘটনা লেগে  থাকে, সেই কারণে সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি এই খেলাটি নিষিদ্ধ করেছে। তবে সামাজিক পরিসরে আইনের শাসন ভারতে প্রায়শই খুব শিথিল।

এই ভাবে মকর সংক্রান্তিতে বিভিন্ন অঞ্চলের রকমারি আচার-অনুষ্ঠান এসে মিশেছে এবং এটি একটি সর্বভারতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। এমনকী গুজরাত বা কর্নাটকে এই সময় ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবও চলে। কিছু কিছু অনুষ্ঠান তো অনেক শতাব্দী ধরে চলে আসছে বলেই মনে হয়, যেমন এই সময়েই ওডিশার ভুঁইয়া জনজাতির মানুষ এবং বাংলার পশ্চিম প্রান্তের মানুষ টুসু উৎসব পালন করেন। মণিপুরে অনেকে তাঁদের পরম ঈশ্বর লিনিং-থোউয়ের কাছে প্রার্থনা করেন, এমনকী সুদূর অরুণাচল প্রদেশে চিন সীমান্তের কাছে ব্রহ্মকুণ্ডে রামায়ণ, মহাভারত ও কালিকাপুরাণের সূত্র ধরে দেবতার আরাধনা করা হয়, এই দিনটিতে সেখানে হাজার হাজার মানুষ আসেন। উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি এলাকায় লোকনৃত্যের আসর বসে। এমনকী এখন সবরিমালার প্রসিদ্ধ হিন্দু মন্দিরে বিরাজিতা এক সময়ের বৌদ্ধ দেব শাস্তা এই দিন লক্ষ লক্ষ ভক্তের পুজো পান, সেই ভক্তেরা বিস্তর কৃচ্ছ্রসাধন করে তাঁর কাছে পৌঁছয়। প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুধর্ম স্থানীয় ধর্মরীতির কাছ থেকে কতটা কী নিয়েছে এবং তারাই বা প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুধর্মের কাছে কতটা কী পেয়েছে, বলা কঠিন। কিন্তু বিভিন্ন রীতি ও আচারকে মিলিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ব্রাহ্মণ্যবাদ যে একটি বড় ভূমিকা নিয়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ জানুয়ারি, ২০১৫।

সর্বশেষ সংশোধন করা : 8/25/2019



© C–DAC.All content appearing on the vikaspedia portal is through collaborative effort of vikaspedia and its partners.We encourage you to use and share the content in a respectful and fair manner. Please leave all source links intact and adhere to applicable copyright and intellectual property guidelines and laws.
English to Hindi Transliterate