শিশুদের জন্য বিভিন্ন খাতে এ-বছর কোথায় কত বরাদ্দ হয়েছে, তা যদি আলাদা আলাদা করে দেখা যায়, তা হলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হতে পারে। আলোচনার সুবিধের জন্য আমরা যে চারটি পৃথক ক্ষেত্রে গোটা ব্যাপারটিকে ভাগ করে নিতে পারি সেগুলি হল শিক্ষা, প্রাথমিক উন্নয়ন ও বিকাশ, স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা। শিশুশিক্ষা বলতে মোটামুটি ভাবে ধরা হয় মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনায় সরকারি খরচ (যে টাকাটা মূলত আসে সর্বশিক্ষা অভিযান, মিড-ডে মিল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খাতে)৷ সামগ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশ বলতে বোঝায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা ও পুষ্টির সংস্থান। এ ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ থাকে মূলত আইসিডিএস (ইনটেনসিভ চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট স্কিম) পরিষেবা খাতে, উন্নয়নী পরিভাষায় যার পোশাকি নাম ‘ইন্টারভেনশনস রিলেটেড টু আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড এডুকেশন’, সংক্ষেপে ইসিসিই। শিশুস্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বলতে বোঝায় শিশুমৃত্যু রোধে সরকারি আর্থিক সংস্থান, যার মধ্যে পড়ে হাসপাতাল ও গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিও-নেটাল কেয়ার ও চাইল্ড হেলথ-কেয়ার পরিষেবার মান উন্নয়ন এবং পালস পোলিও-সহ অন্যান্য ইমিউনাইজেশন প্রকল্প রূপায়ণ। আর শিশু সুরক্ষা বলতে ব্যাপক অর্থে বোঝানো হয় শিশুশ্রম-বাল্যবিবাহ-শিশুপাচার-শিশুনিগ্রহ প্রভৃতি প্রতিরোধে সরকারের আর্থিক সংস্থান। এ ক্ষেত্রে টাকাটা ধার্য হয় মূলত আইসিপিএস (ইনটেনসিভ চাইল্ড প্রোটেকশন স্কিম) প্রকল্পের আওতায় ও নানা গোত্রের সরকারি হোম পরিচালনায়। যদি এই চারটি খাতে ব্যয়বরাদ্দের তুলনামূলক চিত্রটা দেখা যায়, সেখানেও মস্ত অসামঞ্জস্য। বাজেট প্রস্তাবের ২২ নম্বর স্টেটমেন্ট অনুযায়ী, শিশুদের জন্য মোট বরাদ্দের (৫৭,৯১৯ কোটি টাকা) ৭৯ শতাংশই ধরা হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে, যেখানে ইসিসিই-খাতে ধার্য হয়েছে মোটে ১৫.২ শতাংশ। বাকি যে দু’টি ক্ষেত্র, অর্থাৎ স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা, তাদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সুরক্ষায় বরাদ্দ ৩.৯ ও স্বাস্থ্যে মোটে ১.৮ শতাংশ! শিশুদের জন্য মোট বরাদ্দের ৭৯ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় পাঁচ ভাগের চার ভাগ, খরচ করা হবে শিক্ষায় --- আপাতদৃষ্টিতে যা খুবই উত্সাহব্যঞ্জক। কিন্তু প্রশ্ন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও প্রাথমিক বিকাশ কী দোষ করল ? আনুপাতিক বণ্টনের এই একপেশে বৈষম্যের মধ্যে দিয়ে প্রকারান্তরে কি এমনই বার্তা দেওয়া হল যে, এই ক্ষেত্রগুলিতে আমরা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট এগিয়ে গিয়েছি, আপাতত এগুলি নিয়ে আর কিছু না-ভাবলেও চলে ? অথচ স্বাস্থ্যে ও সুরক্ষায় বাস্তব ছবি তো তা বলছে না। সমস্ত সরকারি নথি ও তথ্যপঞ্জিতেই দেখা যাচ্ছে শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহ ও নানা ধরনের অপরাধ ক্রমবর্ধমান, শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের হার আগের তুলনায় সামান্য কমলেও এখনও পরিস্থিতি যথেষ্টই উদ্বেগজনক (তা না হলে শিশুশ্রম-নিরোধক আইন সংশোধনের দরকারই পড়ত না, অথচ বাস্তবে সংশোধনী বিলটি সংসদে পাশ হওয়ার অপেক্ষায়)। আর স্বাস্থ্যে? দু’বছরও হয়নি, সংসদে দাঁড়িয়ে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ স্বীকার করে নিয়েছিলেন, দেশের সামনে অন্যতম বড় বিপদ শিশু-অপুষ্টি। সরকার জানিয়েছিল মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে দেশ সব চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে শিশুস্বাস্থ্যেই। গত দু’বছরে সেখানে এমন কী উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটল যে, সে ছবি পাল্টে গেল রাতারাতি! যদি অগ্রগতিই হবে, তা হলে এখনও কেন বিভিন্ন শিশু হাসপাতালে নিও-নেটাল কেয়ার ইউনিটগুলির হাঁড়ির হাল? কেন প্রায়ই খবরের শিরোনামে উঠে আসে হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর মিছিল ? এ প্রসঙ্গে অবশ্য উল্লেখ্য, শিশুদের জন্য বাজেট সংস্থানে সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য বরাবরই দুয়োরানির আসন পেয়ে এসেছে। গত পাঁচটি বাজেটের কোনওটিতেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ চার শতাংশের সীমা ছাড়ায়নি। সুরক্ষাও বরাবরই থেকেছে এক শতাংশের নীচে বা আশপাশে। ব্যতিক্রম কেবলমাত্র ২০১৪-র বাজেট। সে বার সুরক্ষায় জুটেছিল ৩.২ শতাংশ, এ বার তা বেড়ে হয়েছে ৩.৯। কিন্তু আগে কখনও হয়নি বলে এ বারও হবে না, যুক্তি হিসেবে এ নিতান্তই দুর্বল।
বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। যদি প্রকল্প ধরে-ধরে দেখি, বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। প্রথম এবং প্রধান ধাক্কা কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রকের মোট বাজেটে কোপ, একলপ্তে ৫৫ শতাংশ বরাদ্দ হ্রাস। সর্ব শিক্ষা অভিযান-এ বরাদ্দ হ্রাস ২১ শতাংশ, মিড-ডে মিল প্রকল্পে ৩০ শতাংশ। শিক্ষা-বিষয়ক অন্যান্য প্রকল্পে হ্রাস ২৫ শতাংশ , যদিও মাদ্রাসা ও সংখ্যালঘুদের জন্য শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ৩৬.৫৫ শতাংশ। কিন্তু সব চেয়ে বড় ধাক্কাটা অন্যত্র। দেশ জুড়ে ব্লক-স্তরে যে ছ’ হাজার বিদ্যালয়কে মডেল স্কুল হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, সেই খাতে একেবারে ৯৯.২ শতাংশ বাজেট কমিয়ে দিয়ে কার্যত গোটা পরিকল্পনাটিকেই হিমঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আরও আছে। সারা দেশে যেখানে ২.৩ কোটি শিশু অপুষ্টির শিকার, সেখানে আইসিডিএস-এর মতো একটি ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্পে বরাদ্দ অর্ধেকেরও বেশি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত বারের তুলনায় এই প্রকল্পে বরাদ্দ হ্রাস ৫৪.১৯ শতাংশ। অথচ মাত্রই কয়েক মাস আগে সারা দেশে বিশাল সংখ্যক নতুন আইসিডিএস কেন্দ্র গড়ে তোলার ঘোষণা করেছিল নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক।
ফলে স্বাভাবিক কারণেই প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে, বাজেটে তার জন্য যথাযথ অর্থের সংস্থান রাখা হবে। কিন্তু বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের পর সে ঘোষণাও কার্যত বিশ বাঁও জলে।
সূত্র : এই সময়, ১২ মার্চ, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/25/2020