অসমীয়া   বাংলা   बोड़ो   डोगरी   ગુજરાતી   ಕನ್ನಡ   كأشُر   कोंकणी   संथाली   মনিপুরি   नेपाली   ଓରିୟା   ਪੰਜਾਬੀ   संस्कृत   தமிழ்  తెలుగు   ردو

কসমিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি

১৯৬০ আমেরিকার বেল ল্যাবোরেটরিজ একটা বিশাল অ্যান্টেনা বানিয়েছিল দূর দূর যায়গায় টেলিফোনের কথা যাতে পৌছনো যায় রেডিও পদ্ধতি ব্যবহার করে।  আর্নো পেঞ্জিয়াস আর রবার্ট উইলসন - দুজনেই তখন গবেষণা করছিলেন মহাবিশ্বের নানান রেডিও সঙ্কেত নিয়ে। একটা বড় টেলিস্কোপ বানাতে পারলে খুব সুবিধা হত, কিন্তু তার জন্যে যে অর্থের প্রয়োজন সেটা পাওয়া যাবে কোত্থেকে? ঐ অ্যান্টেনাটা যদি পাওয়া যায়! কিন্তু মুশকিল হল, ঐ অ্যান্টেনা তখন ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যবসার কাজে। তাহলে? ভাগ্যক্রমে সেই সুযোগ জুটে গেল। এই বিশাল অ্যান্টেনার ব্যবসায়িক প্রয়োজন কমল যখন কৃত্রিম উপগ্রহ টেলস্টার আকাশে ভাসল। দুজন বিজ্ঞানী এবার তাদের কাজে নেমে পড়লেন। কিন্তু টেলিস্কোপ বানিয়ে ব্যবহার করতে গিয়েই একটা বিপত্তি! একটা স্ট্যাটিক নয়েজ (এমনি রেডিওতে অনেক সময় যেরকম শোনা যায়) সারাক্ষণ শোনা যাচ্ছে—মনে হচ্ছে সব দিক থেকেই আসছে! এতো মহা মুশকিল! এটাকে দূর করা যায় কি করে? অ্যান্টেনাটা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখলেন সেখানে পায়রা বাসা বেঁধেছিল এবং ফলে তাদের নোংরা চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। একটা কারণ অন্তত পাওয়া গেল! সেগুলো পরিষ্কার করে আবার কাজ শুরু করলেন তারা। কিন্তু কোথায় কি, সেই আওয়াজের কোনও পরিবর্তন দেখতে পেলেন না! অবশেষে বোঝা গেল, এটাকে দূর করা যাবে না।

কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রকাশ একরকম ক্ষীণ আভা বা বিকিরণের মাধ্যমে, যার বিস্তার মহাবিশ্বের (universe) সর্বপ্রান্তে এবং যার প্রথম প্রকাশ বিগ ব্যাং (Big Bang) বা মহা বিস্ফোরণের মাত্র ৩৮০,০০০ বছর পর। এর আগে নবজাত মহাবিশ্বের তাপমাত্রা এবং ঘনত্ব এতই বেশি ছিল যে পদার্থের সঙ্গে সংঘাতের ফলে আলোর গতিবিধি ছিল অত্যন্ত সীমিত। কালক্রমে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা হ্রাস পেতে শুরু করল এবং আলোর বিচরণ হল অবাধ। এই আদিম আলোকের অন্য নাম কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা পটভূমি। ক্রমশ বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করলেন যে পেঞ্জিয়াস ও উইলসন যা পর্যবেক্ষণ করছিলেন তা আদিম মহাবিশ্বেরই একটা imprint বা ছাপ। এই আবিষ্কারের জন্যই পেঞ্জিয়াস ও উইলসন ১৯৭৯ সালে পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন।

পেঞ্জিয়াস ও উইলসনের এই আবিষ্কার যে একদিন আধুনিক পর্যবেক্ষণ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান শাস্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হয়ে দাঁড়াবে তা আজ বিশ্বাস করা কঠিন। এই প্রবন্ধে আমি সেই কাহিনীরই বিবরণ দেব যা পঞ্চাশ বছর আগে শুরু হয়েছিল পেঞ্জিয়াস ও উইলসনের আবিষ্কার দিয়ে এবং আজ তা কোথায় দাঁড়িয়েছে সেই কথা বলে। সম্প্রতি মহা বিস্ফোরণ , যে সত্যিই ১৩.৮২ বিলিয়ন বছর আগে ঘটেছিল তার সম্ভাব্য ইঙ্গিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর একদল বিজ্ঞানী হয়ত আকর্ষণীয় ভাবে উদ্ঘাটন করেছেন সমবর্তিত আলোর (polarized light) ওঠানামা বা মোচড় লক্ষ করে। কিন্তু এইসব ধারণার বিকাশ অনুধাবন করতে হলে শুরু করতে হবে বাস্তবিকই প্রথম থেকে— মহা বিস্ফোরণের কথা দিয়ে।

বিগ ব্যাং তত্ত্ব

বিগ ব্যাং তত্ত্ব মহাবিশ্বের আধুনিক গাণিতিক তত্ত্বগুলির মধ্যে অন্যতম। এই তত্ত্বের উদ্দেশ্য মহাবিশ্বের সময়গত অগ্রগতিকে গাণিতিক উপায়ে ব্যাখ্যা করা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল একটা প্রচণ্ড শক্তিশালী বিস্ফোরণ দিয়ে, প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে (মহাবিশ্বের বয়স), যখন নবীন মহাবিশ্বের আকার ছিল প্রচণ্ড ঘন একটি পিণ্ডের মত। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে বিগ ব্যাং তত্ত্বে কিন্তু মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থার কোন ইঙ্গিত মেলে না, কিম্বা বিগ ব্যাঙ্গের আগে কি ঘটেছিল, অথবা মহাবিশ্বের বাইরে কোনকিছু আছে কিনা—সে সম্বন্ধেও কোন আলোকপাত এই তত্ত্ব করতে পারে না। বিশেষত:, মহা বিস্ফোরণ যে মহাকাশের একটি বিন্দুতে ক্লাসিক্যাল অর্থে একটা প্রকাণ্ড explosion বা বিস্ফোরণ, সে কথাও ঠিক নয়। বরঞ্চ ভাবা যেতে পারে মহা বিস্ফোরণ এমন একটি ঘটনা যার ফলে মহাবিশ্বের সর্বত্র স্পেইস্ বা স্থানের সমকালীন আবির্ভাব ঘটেছিল। যা সব থেকে আশ্চর্য তা হোল ব্যাপারটা ঘটেছিল প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছর আগে একটি অত্যন্ত ছোট বিন্দুতে।

মহাবিস্ফোরণের পরেই অত্যুষ্ণ এবং অতি নিবিড় মহাবিশ্বের আয়তন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং অল্প কাল পরে তাপমাত্রা হ্রাসের ফলে শক্তির রূপান্তর শুরু হল পারমানবিক কণা তৈরির কাজে—প্রোটন, ইলেকট্রন, ও নিউট্রনের মত সরল পারমাণবিক কণাগুলির সৃষ্টি প্রথম তিন মিনিটের মধ্যই হয়েছিল। কিন্তু প্রথম বিদ্যুৎ নিরপেক্ষ পরমাণুর আবির্ভাব হতে কয়েক সহস্র বছর কেটে গেল। বিগ ব্যাঙ্গের শুরুতে যে পরমাণুগুলি তৈরি হয়েছিল তার অধিকাংশই H (হাইড্রোজেন) এবং He (হিলিয়াম) কিন্তু অল্প পরিমাণে Li (লিথিয়াম) পরমাণুরও আবির্ভাব হয়েছিল সেই সময়। মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে আদিম মৌলিক পদার্থের প্রকাণ্ড মেঘ এই সময় ক্রমশ তারকা রাশি এবং ছায়াপথে পরিণত হল। জটিল মৌলিক পদার্থের আবির্ভাব তারকাগুলির অন্তরগর্ভে কিম্বা সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় হয়েছিল এবং তা বিগ ব্যাঙ্গের বহু কাল পরে।

বলা বাহুল্য, বিগ ব্যাং তত্ত্ব ছাড়াও মহাবিশ্বের অন্যান্য গাণিতিক তত্ত্ব এক সময় জনপ্রিয় ছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্টেডি স্টেট (Steady State) তত্ত্ব। স্টেডি স্টেট তত্ত্বের প্রবক্তা জেমস জিন্স (১৯২০ সালে)। ১৯৪৮ সালে হারমান বন্ডি, থমাস্ গোল্ড, এবং ফ্রেড হয়েল্ তত্ত্বটিকে বহুলাংশে পরিমার্জনা করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্বের কোন শুরু বা শেষ নেই।

[স্টেডি স্টেট তত্ত্ব মতে মহাবিশ্ব ক্রমাগত ভাবেই সম্প্রসারিত হতে পারে কিন্তু মহাবিশ্বে পদার্থর গড় ঘনত্ব (গ্র্যান্ড স্কেলে) সর্বত্রই এক থাকতে হবে। গড় ঘনত্বের একটা নিত্য মান বজায় রাখতে গেলে মহাবিশ্বের অভ্যন্তরে সর্বদাই নূতন নূতন তারকা ও ছায়াপথের সৃষ্টি হওয়া দরকার। কিন্তু পুরাতন তারকা ও ছায়াপথগুলির দূরত্ব এবং অপসরণের বেগ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে দৃষ্টিপথের অন্তরালে ক্রমাগত ভাবেই চলে যায়। সুতরাং নূতন নক্ষত্র এবং ছায়াপথের সৃষ্টির হার পুরাতনগুলির অপসরণের হারের সমান হতেই হবে। স্টেডি স্টেট তত্ত্ব অনুযায়ী নূতন ও পুরাতন ছায়াপথগুলি মহাবিশ্বের সর্বত্র সমানভাবে বিতরিত হয়ে আছে।]

১৯৫০ ও ১৯৬০র দশকে স্টেডি স্টেট তত্ত্বের অনেক সমর্থক ছিল। কিন্তু এর জনপ্রিয়তা ক্রমেই হ্রাস পেতে শুরু করল। তার মূল কারণ, স্টেডি স্টেট তত্ত্বে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ডের কোন ব্যাখ্যা নেই।

অন্যদিকে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের পরীক্ষামূলক প্রমাণ প্রশ্নাতীত ভাবে পাওয়া যাওয়ার সাথে সাথে অধিকাংশ বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতে শুরু করলেন যে মহাবিশ্বের আরম্ভ থেকে ১৫ বিলিয়ন বছরের বিবর্তনের সঠিক বিবরণ বিগ ব্যাং তত্ত্বই দিতে পারে। সেই প্রমাণ বিশ্লেষণ করার আগে বিগ ব্যাং মডেলের মূল কাঠামো, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের একটা খুব সংক্ষিপ্ত আলোচনা পরবর্তী অনুচ্ছেদে দেওয়া হল।

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব আধুনিক জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান একটি অপরিহার্য অঙ্গ। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ মূলত: মহাকর্ষের একটি তত্ত্ব এবং বিগ ব্যাং সৃষ্টিতত্ত্বের অন্যতম কাঠামো। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল আইনস্টাইনের ক্ষেত্র সমীকরণগুলির ব্যবহার। সমীকরণগুলি সমাধান করলে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রর প্রভাবে একটি নক্ষত্রপুঞ্জ কিম্বা ছায়াপথের গতিপথ কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তার নিদর্শন মেলে। প্রথমেই বলা দরকার আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব সাধারণ পাঠকদের বোঝার পক্ষে জটিল। কারণ মহাজাগতিক বিবর্তনের আইন গণিতের ভাষাতেই লেখা এবং আইনস্টাইনের স্থান কালের জ্যামিতিক ব্যাখ্যা ওঁর সমীকরণগুলির মধ্যে লুকনো। তার মানে কি মহাবিশ্বের বিবর্তনের কাহিনী সাধারণ পাঠকদের নাগালের বাইরেই থেকে যাবে? তা একেবারেই নয়। তত্ত্বটি বোঝার জন্য অত্যাধুনিক গণিতের প্রয়োজন নেই, কিন্তু সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পূর্বাভাস পাঠককে বুঝতে হবে। পরবর্তী অনুচ্ছেদে সেই পূর্বাভাসের তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।

অতি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দূরবীক্ষণ যন্ত্র এবং কৃত্রিম উপগ্রহগুলি বিজ্ঞানের কাজে লাগানোর সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা প্রভূত পরিমাণের উচ্চ মানের পর্যবেক্ষণের তথ্য একত্র করতে শুরু করলেন। এ কথা মনে রাখতে হবে যে মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণীয় বস্তুগুলি (নক্ষত্রপুঞ্জ এবং ছায়াপথ) প্রায় সর্বদাই আমাদের পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ আলোক বর্ষ দূরে অবস্থিত। ওইসব বস্তু চর্চার একমাত্র উপায় হল ওদের থেকে নির্গত কিম্বা প্রতিফলিত হওয়া আলোক রশ্মির বিশ্লেষণের মাধ্যমে । উপরন্তু, যে আলোকরশ্মি আজ মর্তে কিম্বা কক্ষপথে স্থাপিত বিভিন্ন দূরবীক্ষণ যন্ত্রগুলি নিরীক্ষা করছে তা হয়ত লক্ষ লক্ষ বছর আগে নির্গত হয়েছিল কোন একটি নক্ষত্রপুঞ্জ কিম্বা ছায়াপথ থেকে। ফলে স্থান-কাল কাঠামোর (নীচে দেখুন) প্রকৃত স্বরূপ না জানলে পর্যবেক্ষণের তথ্য অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আইনস্টাইন এর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের সার্থকতা সেখানেই—পর্যবেক্ষণের তথ্য অনুধাবনের জন্য যে বুনিয়াদ প্রয়োজন জ্যোতিঃপদার্থবিদদের তা অত্যন্ত সুষ্ঠু ভাবে প্রদান করেছে এই তত্ত্ব।

পরের অনুচ্ছেদটি সম্ভবত এই নিবন্ধের সবচেয়ে কঠিন অংশ। পাঠককে আশ্বস্ত করার জন্য এটুকু বলতে পারি যে এই অনুচ্ছেদটি ধৈর্য ধরে পড়তে পারলে বিষয়বস্তু অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। প্রথম প্রচেষ্টায় সবকিছু উপলব্ধি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু সঙ্গে থাকলে বৈজ্ঞানিকরা কিভাবে মহাবিশ্বের বিবর্তনের নীতিগুলি অল্প অল্প করে উদ্ঘাটন করেছিলেন, তা নিশ্চয় জানতে পারবেন। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পথ অধিকাংশ ক্ষেত্রে মসৃণ হয় না। অনেক সময় ব্যর্থ প্রয়াসের মধ্যই সাফল্যের চাবিকাঠি লুকানো থাকে। সেই সব কাহিনীই এ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু।

সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব

আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ বিংশ শতাব্দী পদার্থবিদ্যার এক প্রধান স্তম্ভ। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত এই তত্ত্বে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের (gravitational field) প্রভাবকে স্থান-কালের (space-time) বক্রতা বা ন্যুব্জটা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হল—স্থান ও কালকে সম্মেলিত ভাবে একটি নূতন গাণিতিক পারমিতির মাধ্যমে ব্যক্ত করা হল। প্রসঙ্গত, যদিও স্থান-কাল-এর এই বিনিয়োগ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বেই প্রথম, কিন্তু এটি নিয়ে আগে ভাবনা চিন্তা করেছিলেন হারমান মিন্কাওস্কি।

[আপেক্ষিকতাবাদের সমীকরণগুলি ব্যবহার করে কোনো ঘটনা সঠিকভাবে বর্ণনা করতে হলে ঘটনাটির স্থান ও কাল বা সময়—উভয়ের স্থানাঙ্ককেই গাণিতিকভাবে সংযুক্ত করা আবশ্যক। স্থান-কাল একটি ৪-মাত্রিক বস্তু কারণ স্থান ত্রিমাত্রিক এবং সময়ের মাত্রা ১। স্থান-কাল একটি 'কন্টিনুয়াম' বলেই বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যেহেতু স্থান বা কালের মান কোন স্থানাঙ্কেই অনুপস্থিত নয়, এবং উভয়কেই অনির্দিষ্ট বার ধরে বিভাজিত করা যেতে পারে। পদার্থবিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের মহাবিশ্ব একটি 4 মাত্রিক স্থান-কালের সন্ততিতর উপরে ভাসছে এবং সমস্ত ঘটনা, স্থান, আর ইতিহাসের মুহূর্ত, ক্রিয়া, ইত্যাদির বর্ণনা করা যায় স্থান-কালের মধ্যে ওগুলির অবস্থান মারফত।]

নিউটনীয় তত্ত্বে দুইটি বস্তুর মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব একটি বল বা force-এর মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। একটি বস্তু আরেকটি বস্তুকে কি ভাবে আকর্ষণ করবে সেটা নির্ভর করবে বস্তু দুটির ভর (mass) অর্থাৎ পদার্থের পরিমাণ এবং একটি ধ্রুবক-এর ওপর। এই আকর্ষণের ভিত্তিতে গ্রহ নক্ষত্র কী ভাবে কক্ষ পথে ঘুরবে তা মোটামুটি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছিল। এতে স্থান-কালের কোনও প্রভাব ছিল না। কিন্তু সেই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণও ছিল না। আসলে মহাকাশীয় বস্তুর উপস্থিতির জন্য স্থান-কালের জ্যামিতিক পরিবর্তন হয় এবং এর বুনন বা কাঠামোকে বিকৃত করে। ফলে স্থান-কাল কাঠামোর মধ্যে যে শিখর এবং উপত্যকাগুলি সৃষ্টি হয়, সেগুলি বস্তুর গতিপথকে কখনো সরল রেখায় অথবা কখনো বক্র পথে পরিচালিত করে। আইনস্টাইনের চিত্রে নিউটনের এই বল-এর পরিবর্তে স্থান-কাল কাঠামোর কুঞ্চন বা বিকৃতির কথা বলা হয়েছে। সূর্যর চারিদিকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণের পথ নির্ধারণ করে স্থান-কালের কুঞ্চন বা বিকৃতি। জিনিসটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গোলমেলে – চট করে বোঝা সম্ভব নয়। তবে একটি বিশেষ উপমার সাহায্যে কল্পনা করলে ব্যাপারটা বোঝা অনেকটাই সহজ হয়ে পড়ে। মনে করুন একটি trampolineএর কেন্দ্রে একটি ভারি বস্তু স্থাপন করলে কি হবে। বস্তুটির ভারে ফ্যাব্রিকের মধ্যে টোল (কুঞ্চন বা বিকৃতি) পড়বে। প্রান্তের কাছে ছেড়ে দেওয়া একটি মার্বেলটি trampolineএ রাখা বস্তুটির দিকে সর্পিল গতিতে অগ্রসর হবে—ঠিক যে ভাবে মহাকাশের আবর্তনরত প্রস্থরখন্ডগুলি মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে গ্রহের দিকে প্রক্ষিপ্ত হয়।

সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের বিখ্যাত সমীকরণগুলি সূত্রবদ্ধ করতে আইনস্টাইনের দীর্ঘ দশ বছর লেগেছিল। ১৯১৭ সালে আইনস্টাইন ওগুলি ব্যবহার করেন স্ট্যাটিক বা অপরিবর্তনশীল মহাবিশ্বকে মডেল করার কাজে। ঐ সময় বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে মহাবিশ্ব অপরিবর্তনশীল (static) এবং চিরন্তন (Steady State চিত্র)। মহাবিশ্বের এই চরিত্র অনুকরণ করতে গিয়ে আইনস্টাইন তার সমীকরণগুলির মধ্যে একটি ধ্রুবক ব্যবহার করেতে বাধ্য হয়েছিলেন, যার নাম মহাজাগতিক ধ্রুবক (gravitational constant)। এই ধ্রুবকের কিন্তু সহজ বাংলায় “বাইরে থেকে আমদানি” (introduced by hand)। এর ফলে, মাধ্যাকর্ষণের অন্তর্মুখী প্রভাবের বিরুদ্ধে যেন একটা বহির্মুখী বলের প্রবর্তন হল।

[মহাজাগতিক ধ্রুবকের ইতিহাস আইনস্টাইনের অত্যুজ্জ্বল প্রতিভার আর একটি নিদর্শন। আইনস্টাইন ধ্রুবকটিকে উদ্ভব করেছিলেন স্থান-কাল ফ্যাব্রিকের প্রসারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, যখন ওঁর ক্ষেত্র সমীকরণগুলি গাণিতিক ভাবে মহাবিশ্বকে অপরিবর্তনশীল থাকতে দিচ্ছিল না। পরে যখন আবিষ্কৃত হল মহাবিশ্ব প্রকৃতপক্ষে স্থির বা স্ট্যাটিক নয়, কিন্তু ক্রমাগত ভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে, তখন অপ্রয়োজনীয় মনে করে আইনস্টাইন মহাজাগতিক ধ্রুবকটিকে পরিত্যাগ করেন। মজা হল, এটিকে সম্প্রতি পুনরুত্থাপন করা হয়েছে কারণ জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এখন ডার্ক এনার্জি নামক একটি অজানা শক্তির পরিচয় পেয়েছেন (ভবিষ্যতে ডার্ক এনার্জি সম্পর্কে আরও পরিবেশিত হবে) যার প্রভাবে মহাবিশ্ব শুধু প্রসারিত হচ্ছে না, সম্প্রসারণের মাত্রা ত্বরান্বিত হারে বেড়ে চলেছে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণকে মডেল করার জন্য ধ্রুবকটিকে পুনরায় সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের ক্ষেত্র সমীকরণগুলির মধ্যে যোগ করতে হয়েছে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের পেছনে যেন একটি বিকর্ষণ শক্তির প্রভাব আছে যা মহাবিশ্বর স্ফীতির মতো ( এই স্ফীতি তত্ত্ব ভবিষ্যতে আরও বিশদ ভাবে বর্ণিত হবে), স্থান বা স্পেসের নিজস্ব একটি ধর্ম। বিকর্ষণ শক্তি যতই প্রবল হয়, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হারও ততটাই শক্তিশালী আকার ধারণ করে। সন্দেহ করা হচ্ছে ডার্ক এনার্জি অনুধাবন করার পেছনে মহাজাগতিক ধ্রুবকের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। ভুল করেছেন ভেবেও আবার সঠিক প্রমাণিত হলেন আইনস্টাইন!]

১৯২২ সালে রুশ পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতবিদ আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান মহাবিশ্বর বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে দুটি সহজ-সরল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অনুমান করেছিলেন। ফ্রিডম্যান ধরে নিয়েছিলেন যে আমরা যে দিকেই দৃষ্টিপাত করি না কেন মহাবিশ্বকে একই রকম দেখাবে। অন্য কোন অবস্থান থেকেও যদি পর্যবেক্ষণ করা হয়, মহাবিশ্বকে একই রকম দেখাবে। এই নীতির নাম মহাজাগতিক নীতি (Cosmological Principle)। ফ্রিডম্যান শুধু এ দুটি অনুমানের উপর ভিত্তি করে আইনস্টাইনের সমীকরণগুলির একগুচ্ছ বিশেষ উল্লেখযোগ্য সমাধান প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন (উইলিয়াম দি সিটার স্বাধীনভাবে একই সমাধানে পৌঁছিয়েছিলেন)। ওঁর সমাধানেই প্রথম দেখা গেল কালের সাথে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের একটা সহজাত প্রবণতা রয়েছে। মহাবিশ্বের আদিতে যে একটা সিঙ্গুলারিটি (singularity) বা মহাকর্ষীয় ব্যতিক্রমী বিন্দু থাকতে পারে, ফ্রিডম্যানের একটি সমাধানে তার প্রথম হদিশ মিলল—সিঙ্গুলারিটি মানে এমন একটি স্থানকে বুঝায় যেখানে মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র পরিমাপ করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্যারামিটার অসীম হয়ে গিয়েছে। সিঙ্গুলারিটি নিতান্ত ভাবেই একটি গাণিতিক ধারণা। কিন্তু সিঙ্গুলারিটির নিদর্শন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে বহু জায়গাতে আছে। ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রেও মহাকর্ষীয় সিঙ্গুলারিটি থাকতে পারে—সেখানে স্থান-কালের বক্রতা অসীম বলে মনে করা হয়।

[ফ্রিডমান বুঝেছিলেন যে আইনস্টাইনের সমীকরণগুলির সমাধানের জন্য ওঁকে মহাবিশ্বের পদার্থের বিতরণের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে একটা ধারণা বা অনুমান খাঁড়া করতে হবে। উনি সবচেয়ে সহজ পথটিই বেছে নিয়েছিলেন। উনি অনুমান করলেন, খুব বড় স্কেলে দিয়ে মাপলে দেখা যাবে মহাবিশ্বের কোন বিশেষ দিকের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নেই। মহাবিশ্বের অবয়ব যেন সব জায়গা এবং সব দিক থেকেই এক। অন্য ভাবে বললে দাঁড়ায়, ব্রহ্মাণ্ডে পদার্থের বিতরণ সমসত্ত্ব এবং সমসারক, যদি পরিমাপের স্কেলটি পর্যাপ্ত ভাবে বড় হয়। এই নীতিটি পরবর্তী কালে মহাজাগতিক নীতি (Cosmological Principle) বলে চিহ্নিত হয়েছে।]

ফ্রিডমানের সমাধান অনুযায়ী মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ রোধ হওয়া নির্ভর করে ওর গড় শক্তি-ঘনত্বর (mean energy density) উপর। এই শক্তি-ঘনত্বর মান একটি নির্দিষ্ট মানের কম হলে বিগ ব্যাং প্রদত্ত প্রাথমিক ভরবেগ মহাবিশ্বকে ওর নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব থেকে মুক্ত করে। এই পরিস্থিতিতে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হয় চিরস্থায়ী।

মহাবিশ্বের জ্যামিতি বা আকার নির্ভর করে ওর গড় শক্তি-ঘনত্বর মানের উপর। মহাবিশ্বের আকারের বক্রতা বা ন্যুব্জতা তিন রকমের হতে পারে—ধনাত্মক, ঋণাত্মক, ও শূন্য। এই আকার চিত্র ১এ দেখান হল মহাজাগতিক পরামিতি (cosmological parameter) Ω0-র সাহায্যে। Ω0 হোল দুটি রাশির অনুপাত—গড় শক্তি-ঘনত্ব (ρ0 ) এবং ক্রিটিকাল শক্তি-ঘনত্ব, (ρc ): Ω0 = ρ0 / ρc

মহাশূন্যের এক কিউবিক মিটারে দশটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ঘনত্বের যা মান, ρc রাশিটির মান তারই সমতুল্য। এই মান যদি খুবই অল্প মনে হয় তো মনে রাখতে হবে যে মহাবিশ্বের বেশীর ভাগই শূন্যতায় ভরা। বলা বাহুল্য, আধুনিক সৃষ্টিতত্বের বিকাশে মহাজাগতিক পরামিতি Ω0-র অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পরীক্ষার সাহায্যে এই রাশিটি পরিমাপযোগ্য। তাছাড়াও এর মান মহাবিশ্বের সামগ্রিক জ্যামিতিকে (আকৃতিকে) নিয়ন্ত্রণ করে। নীচের টেবিলে সেই তথ্যই পরিবেশিত হল।

টেবিল ১: মহাজাগতিক মডেল

জ্যামিতি

Ω0

মহাবিশ্বের পরিণতি

সমতল

=১

মুক্ত: ρ0 = ρc হলে মহাবিশ্বের বক্রতা বা ন্যুব্জতা শূন্য অনুপস্থিত। এক্ষেত্রে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ চিরস্থায়ী ।

অধিবৃত্তিক

<১

মুক্ত: ρ0 < ρc হলে মহাবিশ্বের বক্রতা বা ন্যুব্জতা ঋণাত্মক। এক্ষেত্রে মহাবিশ্বের ঘনত্ব ওর সম্প্রসারণ রোধ করার পক্ষে যথেষ্ট বেশী নয়।

গোলাকার

>১

বন্ধ: ρ0 > ρc হলে মহাবিশ্বের বক্রতা বা ন্যুব্জতা ধনাত্মক। এক্ষেত্রে মহাবিশ্বের ঘনত্ব এতই প্রবল যে এক সময় ওর সম্প্রসারণ বন্ধ হয়ে সংকোচন শুরু হবে। মহাবিশ্ব শেষ পর্যন্ত একটা চরম সঙ্কোচন (Big-Crunch) এর সম্মুখীন হবে। চরম সঙ্কোচন বিগ ব্যাং-এর বিপরীত প্রক্রিয়া।

সুতরাং, ফ্রিডম্যানের সমাধানে দুটি যাচাইযোগ্য পূর্বাভাস পাওয়া গেল (১) মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সম্ভাবনা (২) মহাবিশ্বের জ্যামিতি, যা মহাজাগতিক পরামিতি Ω0-র সাহায্যে পরীক্ষামূলক ভাবে নির্ণয় করা যায়। উপরন্তু, ফ্রিডম্যানের একটি সমাধানে মহাবিশ্বের শুরু যে বিগ ব্যাং বিস্ফোরণ দিয়ে আরম্ভ সেই আভাসও পাওয়া গেল।

আইনস্টাইন কিন্তু প্রথমে ফ্রিডম্যানের মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের ব্যাখ্যা অনুমোদন করেন নি, কিন্তু পরবর্তী কালে উপলব্ধি করলেন যে ফ্রিডম্যানের গণনাই নির্ভুল। দুর্ভাগ্যবশত ফ্রিডম্যান এই মহামানবের অনুমোদন বেশীদিন ভোগ করতে পারেন নি। অকালে মারা যান তিনি। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়সে বছর হয়েছিল মাত্র ৩৭ বছর। ওঁর একমাত্র পুত্র সন্তান তখনও ভূমিষ্ঠ হয় নি।

অসময়ে মৃত্যুর কারণে যুগান্তকারী কাজ সত্ত্বেও ফ্রিডম্যান পশ্চিমে কার্যত অপরিচিত ছিলেন। বলতে বাধা নেই আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যানই সৃষ্টিতত্ত্বের ভুলে যাওয়া নায়ক।

অবশেষে ১৯২৯ সালে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মহাবিশ্বর সম্প্রসারণ প্রমাণ করলেন এডুইন হাবল্ । এরপর কৃত্রিম উপগ্রহের (satellites) গায়ে সংবেদনশীল ডিটেক্টর বসিয়ে মহাজাগতিক পরামিতিটিকেও (Ω0) মাপতে সক্ষম হলেন বিজ্ঞানীরা। অবশেষে তিল তিল করে ওঁরা মহাবিশ্বের বিবর্তনের একটা পূর্ণ চিত্র অঙ্কন করতে সক্ষম হলেন। আর এটা সম্ভব হল নানা আন্তর্জাতিক গবেষণাগারগুলির সহযোগিতায় মূল্যবান পরীক্ষামূলক তথ্যের আমদানির  ফলে। কিন্তু এসব কাহিনী পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলিতে বিশদ ভাবে বর্ণিত হয়েছে।

১৯২৭ সালে, ফ্রিডমানের কাজের কথা না জেনে, বেলজিয়ান জ্যোতিঃপদার্থবিদ্ এবং ধর্মযাজক, জর্জ লেমাত্রা, একই সমাধানে পৌঁছিয়েছিলেন । ভাবতে অদ্ভুত লাগে, লেমাত্রার চিত্রে মহাবিশ্বের শুরুতে ছিল একটি আদি সুপার অণু (primeval super-atom) যার খণ্ডন থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তি।লেমাত্রার মহাবিশ্বের মডেলই আধুনিক বিগ ব্যাং মডলের পূর্বসূরি।

তথ্য সংকলন : বিকাসপিডিয়া টীম

সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/14/2020



© C–DAC.All content appearing on the vikaspedia portal is through collaborative effort of vikaspedia and its partners.We encourage you to use and share the content in a respectful and fair manner. Please leave all source links intact and adhere to applicable copyright and intellectual property guidelines and laws.
English to Hindi Transliterate