বয়স মাত্র চোদ্দো বছর। কিন্তু তাতে কী! হৃদয় জুড়ে অজস্র সমস্যার জাল ছড়িয়ে ছিল সেই কিশোরীর। বাঁকুড়া জেলার ধরমপুরের মেয়েটিকে দেখে একাধিক হাসপাতালই জানিয়েছিল বাঁচানো মুশকিল। যদিও বা বাঁচে, তা হলে ভালভ প্রতিস্থাপন ছাড়া পথ নেই।
শেষ অবধি দুর্গাপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে সুহানা খাতুন নামে ওই কিশোরীর অ্যাওর্টিক ভালভ মেরামত করে এবং মহাধমনী কেটে বাদ দিয়ে সেখানে একটি টিউব বসিয়ে তার হৃৎপিণ্ডকে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরানো হয়েছে। আপাতত মেয়েটি সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত বলে চিকিৎসকদের দাবি। কী সমস্যা ছিল কিশোরীর হৃদযন্ত্রে? চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, বাঁ দিকের নিলয় (ভেন্ট্রিকল) এবং মহাধমনীর (অ্যাওর্টা) সংযোগস্থলে যে ভালভ (অ্যাওর্টিক ভালভ) থাকে, তার গুরুতর সমস্যা তো ছিলই। মেয়েটির মহাধমনীটিও অস্বাভাবিক ফুলে ছিল। ছিল জন্মগত আরও অনেক ত্রুটি। কিন্তু ভালভ প্রতিস্থাপন মানে তো ধাতব ভালভ। বিশেষজ্ঞদের মতে, যাঁদের দেহে ধাতব ভালভ বসানো হয়, তাঁদের মধ্যে ৫০ শতাংশ মানুষই ১০ বছরের বেশি বাঁচেন না। কারণ প্রতিস্থাপনের নানা জটিলতা থাকে। কমবয়সিদের ক্ষেত্রে ধাতব ভালভ বসালে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রেও নানা বিধিনিষেধ তৈরি হয়। রক্ত পাতলা হওয়ার ওষুধ বরাবর খেয়ে যেতে হয়, যার আবার ডোজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কম খেলে রক্ত পাতলা হবে না। আবার অন্যথায় বেশি পাতলা হয়ে থ্রম্বোসিস-এর জেরে মৃত্যুও হতে পারে।
সুহানার ক্ষেত্রে তা হলে অসাধ্যসাধন কী করে করলেন ডাক্তাররা? দুর্গাপুরের মিশন হাসপাতালের চেয়ারম্যান কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সত্যজিৎ বসু বলেন, “ডান দিকের নিলয় থেকে যে রক্ত ফুসফুসে যায়, সেখানে পালমোনারি ভালভ থাকে। সেই ভালভ এবং পালমোনারি আর্টারির সংযোগস্থলটিকে অ্যাওর্টিক ভালভ-এর অবস্থানে বসানো হয়েছে। আর পালমোনারি ভালভের জায়গায় একটি পাতলা পর্দা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালমোনারি ভালভের কাজ করবে। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলে পালমোনারি অটোগ্রাফট।”
এ ছাড়া মেয়েটির অন্য সমস্যাও ছিল। সে সব মেটাতে আগে অন্য একটি অস্ত্রোপচারও করতে হয়েছে। সেটা কী? সত্যজিৎবাবু জানান, মেয়েটির মহাধমনী বেলুনের মতো ফুলে ছিল। “দেহের সব রক্ত বার করে দেহকে রক্তশূন্য করে মহাধমনীটি কেটে বাদ দিয়েছি আমরা। সেই জায়গায় একটি টিউব (ড্যাকরন টিউব) বসানো হয়েছে।” এই দুটি অস্ত্রোপচার একই সঙ্গে করাটা যথেষ্ট বিরল বলে দাবি সত্যজিৎবাবুর।
অস্ত্রোপচারের পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা সুহানাকে ভেন্টিলেটরে রাখতে হয়েছিল। আপাতত তার জীবনের আর কোনও ঝুঁকি নেই বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। ভবিষ্যতে সে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে, বিয়ে বা সন্তানধারণেও সমস্যা থাকবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা।
শিশু হৃদরোগীদের নতুন জীবন দিতে সরকারের যে শিশুসাথী প্রকল্প রয়েছে, তারই আওতায় অস্ত্রোপচার হয়েছে সুহানার। ফলে পুরোটাই হয়েছে নিখরচায়। সুহানার বাবা আজিম খান বলছিলেন, জন্মের পর থেকেই রুগ্ণ ছিল মেয়েটা। বুক ধড়ফড় করত। দম আটকে আসত। নীল হয়ে যেত কখনও কখনও। “অনেকেই বলেছিলেন, অস্ত্রোপচার করলেও মেয়েটাকে বাঁচানো যাবে না। এখানকার ডাক্তারবাবুরাই প্রথম আশার আলো দেখিয়েছিলেন।”
এই অস্ত্রোপচারকে স্বাগত জানিয়েছেন অন্য চিকিৎসকরাও। কার্ডিওলজিস্ট সুসান মুখোপাধ্যায় বলেন, “অল্পবয়সিদের মধ্যে একই সঙ্গে এই দু’রকম সমস্যা একসঙ্গে দেখা যায় না। রোগটা ধরাই পড়ে দেরিতে। একই সঙ্গে দুটি অস্ত্রোপচার করে মেয়েটিকে যে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো গিয়েছে, এটা যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য বিষয়।”
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১ জানুয়ারি ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/14/2020