ভয়ানক পরিণতির দিকে এগোতে চলেছে মানুষ। আশঙ্কাজনক ভাবে কমে আসছে আমাদের শোনার ক্ষমতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) সম্প্রতি যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তার ভিত্তিতে বলা যায় পৃথিবীর অন্তত ১১০ কোটি মানুষের বধির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পৃথিবীর কল্পনা করা রীতিমতো কষ্টকর। যে পৃথিবীতে ভোরে সূর্য ওঠে ঠিকই, কিন্তু শোনা যায় না পাখির ডাক। পর্যটন কেন্দ্রে ভিড় জমান টুরিস্টরা কিন্তু শোনা যায় না ঝর্ণার কল কল শব্দ। যে পৃথিবীতে রবিশঙ্করের সেতার শুনে কেউ ‘বাহ বাহ’ করে ওঠেন না। সমজদার নেই বেঠোফেন, মোত্সার্ট-সৃষ্ট সুরের। কল্কে পান না লতা মঙ্গেশকর বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়রা। কী ভাবছেন? কল্পবিজ্ঞানের গল্প? না কি ভয়ানক কোনও দুঃস্বপ্ন? না, এর কোনওটাই নয়। তাই নিশ্চিন্ত হওয়ার কোনও কারণ নেই। রুপোলি পর্দায় এমন কোনও ছবি আসার কথা এখনও জানা যায়নি। আর কয়েক মিনিট উসখুস করার পর হঠাৎ ভয়ে ঘেমে স্নান করে ধড়মড় করে উঠে বসে ‘কী সাংঘাতিক স্বপ্ন’ বলে ফের ঘুমিয়ে পড়ারও কারণ নেই। এখনও সজাগ না হলে এই তালিকায় আপনার নামও উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা ষোল আনা। বাসের রুটটা জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিলেন সহযাত্রীকে। উত্তর না পেয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন , বছর ২০-২২-এর তরুণটির কানে ইয়ারপ্লাগ লাগানো। হাতে ধরা একটি স্মার্টফোনের শেষ প্রান্তে গিয়ে অদৃশ্য হয়েছে গ্লাগটি। গানের তালে তালে মাথা দুলছে তরুণটির। এমন দৃশ্যে এখন আর আমরা অবাক হই না। বিশ্ব সংসারের প্রতি সব আগ্রহ শেষ করে দিয়ে তরুণ প্রজন্মের এ ভাবে একেবারে একান্ত ভাবে নিজের জগতে ডুবে যাওয়ার প্রবণতাই মানবসমাজের ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনছে বলে জানিয়েছেন হু-র গবেষকরা। ১২-৩৫ বছরের মধ্যেকার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ শতাংশের শোনার ক্ষমতা ভয়াবহ ভাবে কমে গিয়েছে বলে জানাচ্ছে হু। মার্চের ৩ তারিখ, ‘আন্তর্জাতিক ইয়ার কেয়ার ডে’র এক দিন আগে যে রিপোর্ট হু প্রকাশ করেছে তাতে জানা গিয়েছে, স্মার্টফোন বা আইফোনে উচ্চগ্রামে বাজতে থাকা গান ইয়ারগ্লাগের মাধ্যমে ক্রমাগত শুনতে থাকার অনিবার্য পরিণতি অকাল বধিরতা। গবেষকরা বলছেন, ৮৫ ডেসিবেল শব্দ এক নাগাড়ে আট ঘণ্টা বা ১০০ ডেসিবেল শব্দ ক্রমাগত ১৫ মিনিট শুনলে শ্রবণযন্ত্রের ভয়াবহ ক্ষতি হয়। অত্যাধুনিক ফোনগুলি থেকে এমনই জোরে গান শুনতে অভ্যস্ত নতুন প্রজন্ম। এখানেই শেষ নয়। হু-র অভিযোগের তালিকায় রয়েছে নাইটক্লাব ও বিভিন্ন বারের শব্দ উত্পাদক বিশাল পাওয়ারহাউস বা অন্য অতিকায় স্পিকারগুলিও। এই ক্লাব ও বারগুলিতে তুলনামূলক ভাবে অনেক ছোট এবং শব্দ নিরোধক ঘরে প্রবল আওয়াজে গান ও বাজনা শোনানো হয়। তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের শ্রবণযন্ত্র এর ফলেও ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হু-র পক্ষ থেকে এতিয়েন ক্রুগ জানিয়েছেন, ‘প্রতি দিন আরও বেশি বেশি করে তরুণ-তরুণী এই পথে এগোচ্ছেন এবং নিজের শ্রবণযন্ত্রটিকে বেশি করে ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। এমনিতেই কয়েকশো বছর আগে, বজ্র-বিদ্যুতের আওয়াজকেই চূড়ান্ত বলে মনে করা হত। কিন্তু, যন্ত্রসভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কৃত্রিম শব্দের প্রাবল্য বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। ভিড় রাস্তায় গাড়ি -ঘোড়ার আওয়াজে প্রতি দিন কয়েক ঘণ্টা কাটাতে হয় যাঁদের, তাঁদের কানের অবস্থাও বেশি দিন ভালো থাকবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন হু -র বিজ্ঞানীরা। তাই, যন্ত্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রকৃতির আশ্রয় নেওয়ার উপদেশ দিচ্ছেন হু -র গবেষকরা।
সূত্র: এই সময়, ২ মার্চ ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 3/2/2020