কৈশরের অপুষ্টি
- Contents
অপুষ্টি (Malnutrition)
শাব্দিক অর্থে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিকাশ ও সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি (undernutrition) ও বৃদ্ধি (overnutrition) দুটোকেই বুঝালেও পুষ্টির ঘাটতিজনিত অবস্থা বুঝাতেই অপুষ্টি শব্দটি সচরাচর ব্যবহৃত হয়। খাদ্যে এক বা একাধিক বিশেষ করে আমিষ উপাদান এর স্তল্পতা অর্থাৎ সুষম খাদ্য এর দীর্ঘ অভাবই অপুষ্টির অন্যতম কারন। গত কয়েক দশকে খাদ্যশস্য, ডাল, শাকসবজি, ফল, মাছ, মাংস, দুধ ও তেল আহার যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। ফল, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও তেল খাওয়া কমে যাওয়াসহ মোট খাদ্যগ্রহণও হ্রাস পেয়েছে যা গোটা সমাজ ও জাতির জন্য এক বড় সমস্যা। অপুষ্টিতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশু, গর্ভবতী ও দুগ্ধদাত্রী মায়েরা।
শুধু সীমিত ক্রয়ক্ষমতাই অপুষ্টির কারন নয়। খাদ্যগ্রহণের (বয়োবৃদ্ধাবস্থায় ও দীর্ঘ অসুখে অরুচি); গলাধঃকরণের (গলবিল, গলনালীর ক্যানসার), পরিপাকের (পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয় এর রোগ); শোষণের (উদরাময় জাতীয় রোগ) এবং বিপাকের (যকৃৎ এর রোগ, ডায়াবেটিস) সমস্যাদিও অপুষ্টির কারণ হতে পারে। এ ছাড়া পুষ্টি বিষয়ক জ্ঞানের অভাব, খাদ্য সম্পর্কে কুসংস্কার, চিরাচরিত খাদ্যাভ্যাস, অবৈজ্ঞানিকভাবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রান্না, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পক্ষপাতমূলক খাদ্য বণ্টন, খাদ্যে ব্যাপক ভেজাল, মাতৃদুগ্ধদান বিরতির রেওয়াজ, পেটে কৃমি এবং অন্যান্য কিছু কারণে পুষ্টিগত জাতীয় মানের যথেষ্ট অবনতি ঘটেছে। জনসংখ্যার প্রায় ৬৯% ভুগে আয়োডিনের অভাবে এবং ৯% এ দৃশ্যমান হয় গলগন্ড। প্রায় ৫ লক্ষ লোকের রয়েছে আয়োডিনের অভাবজনিত মানসিক জড়তা। এ ছাড়া আয়রণ ও ফলিক এসিড এর অভাবে রক্তশূন্যতা ভিটামিন ‘বি-২’ এর অভাবে মুখ ও জিহ্বায় ঘা।
খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্যহেতু ঊিশেষ করে গরিবের প্রোটিন ডাল জাতিয় খাদ্যগ্রহণ যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে আর একারণে অপুষ্টির ব্যাপকতা বৃদ্ধিরই আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে প্রায়শ মাত্রাতিরিক্ত ভোজন, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে শারীরিক শ্রমের স্তল্পতা, ফাষ্ট ফুড নামদারী জাঙ্ক ফুডের (junk food) প্রচলন ও অন্যান্য কারণে অনেকেই ওজনাধিক্য (overweight) এবং স্থূলতা (obesity) সমস্যায় ভোগেন।
খাদ্যে, প্রধানত ধান ও গম উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠলেও মা-বাবার ক্রয় ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার দরুন উপযুক্ত খাদ্য ওই শিশুদের নাগালে পৌঁছায় না। অধিকন্তু, সুষম বৃদ্ধির জন্য কেবল ভাত প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগাতে পারে না। এজন্য দরকার মাছ, মাংস দুধ ও ডিমের মতো প্রোটিন এবং ভিটামিন ও খনিজ লবণসমৃদ্ধ ফলমূল ও শাকসবজি। শিশুদের খাদ্যাভাবের বহুদৃষ্ট প্রকাশ হলো প্রোটিন শক্তির অর্থাৎ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য ও শক্তিসমৃদ্ধ দানাশস্যের অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা কোয়াশিওরকর ও অস্থিচর্মসার ম্যারাসমাস।
শিশুমৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কারণ মারাত্মক অপুষ্টি। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেশি। ‘এ’ ভিটামিনের অভাবজনিত শিশুদের রাতকানা রোগ এবং চোখের কর্ণিয়া নরম ও অসবচ্ছ হয়ে অনধত্ব বাংলাদেশে খুবই বেশি। ‘এ’ ভিটামিনের অভাবে প্রতি বছর শিশু অন্ধ হচ্ছে। শিশুদেরও আয়োডিনের অভাবজনিত বৈকল্য আছে। এছাড়া রয়েছে ‘ডি’ ভিটামিনের অভাবে রিকেটস। শিশুর খাবারে ভাগবসানো পেটের কৃমি ও অপুষ্টির আরেকটি কারণ। মূলত দারিদ্র্য ও অজ্ঞতাজনিত কুখাদ্যাভ্যাসের দরুন ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার না খাওয়ায় গ্রামাঞ্চলের শিশুদের একটি বড় অংশেরই অপুষ্টিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
সংখ্যাটি আতঙ্কজনক, কিন্তু সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান চরম দারিদ্র্য ও তার করুণ রূপ হিসেবে নিলে একে বাস্তবতা থেকে দূরে বলে ভাবা যাবে না। অবাধ বাজার ব্যবস্থায় উত্তরণকালীন পর্বে দরিদ্র জনগণের স্বাস্থ্যের ওপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবিলার জন্য বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় সরকার অনেকগুলি পুষ্টি প্রকল্প গ্রহণ করলেও পুষ্টিসমস্যার সুরাহা হয় নি।
অপুষ্টির কারণে ব্যাহত হচ্ছে শিশুর বিকাশ
অপুষ্টির কারণে শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে শিশুদের। স্বাস্থ্যখাতে অগ্রগতি হলেও পুষ্টি পূরণের ক্ষেত্রে এখনও দেশ অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পুষ্টির অভাবে শূন্য থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের মধ্যে শতকরা ৩৮ দশমিক ৭ ভাগ ছোট আকৃতির, ৩৫ দশমিক ১ ভাগ কম ওজনের এবং ১৬ দশমিক ৩ ভাগ শিশুর আকৃতি ছোট হচ্ছে।
সম্প্রতি এক বৈঠকে পুষ্টি ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা পুষ্টিক্ষেত্রে দেশের সার্বিক এ চিত্র তুলে ধরতে এসব পরিসংখ্যান জানানো হয়। পরিসংখ্যানে জানা যায়, পুষ্টির অভাবে শিশুরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস ও অপুষ্টিতে ভোগার আশঙ্কায় বেশি থাকে। রক্তস্বল্পতাসহ নানা রোগেও আক্রান্ত হয়ে থাকে।
পুষ্টি ও প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপুষ্টির শিকার মা ও শিশুর সংখ্যা আগের তুলনায় কমলেও তা খুব বেশি ইতিবাচক নয়। পুষ্টির চাহিদা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ভাতের ওপর চাপ কমবে এবং শিশুদের মেধার বিকাশ ঘটবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপুষ্টির প্রধান কারণ জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, পুষ্টি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও জনসচেতনতার অভাব। দরিদ্র পরিবারে খাদ্যের সহজলভ্যতা না থাকার সঙ্গে সঙ্গে স্বচ্ছল ও অবস্থাপন্ন পরিবারেও শিশুদের অপুষ্টির শিকার হতে দেখা যাচ্ছে। পুষ্টিকর খাবার না দিয়ে শিশুদের আবদার মেটাতে পানীয়, জুস ও চিপস দিচ্ছে। জাঙ্ক ফুডের কারণেও শিশুদের শরীরে ক্ষতি হচ্ছে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বা কম খেতে দেয়াও অপুষ্টির কারণ। বয়স অনুপাতে কতোটুকু খাবার, কী খাবার, কতক্ষণ পর খাবে, তা অনেক মা-বাবা বুঝতে পারেন না। অপুষ্টি দূর করতে শিশুর সুষম খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এটা শুধু শিশুই নয়, কিশোর-কিশোরীসহ সব বয়সের মানুষের জন্যও প্রযোজ্য।
তারা আরো বলেন, রক্তস্বল্পতা, ঠোঁটের কোণায় ঘা, পেটের অসুখ, চোখের নানা সমস্যা, চর্মরোগ, আমাশয়, চুলপড়া, পেটে কৃমি, শারীরিক গঠন সঠিক না হওয়া ও স্নাযুতন্ত্রে বিকাশ ব্যাহত ইত্যাদি অপুষ্টির কারণে হয়ে থাকে। অনেকে মনে করেন, বেশি দুধ ও মাংস খেলে স্বাস্থ্য ভাল হয়। কিন্তু তা নয়, শিশুসহ প্রতিটি মানুষের বয়স অনুপাতে মিশ্র খাবার অর্থাৎ সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। সে জন্য মাংস ও দুধের সঙ্গে মাছ, ডিম, ডাল, ভাত, সবজি, ফলমূল খেতে হবে।
যেহেতু নারী ও ছোট শিশুরা বেশি অপুষ্টির শিকার হয়, সেহেতু মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জলাভূমির টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে, ছোট জাতের মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মাছের সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধি, এবং পুষ্টিমান বাড়াতে এ গবেষণায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতা, পুষ্টিশিক্ষা এবং শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠতে সহায়তা করতে মা-বাবা’র সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এ জন্য হাসপাতাল ও গণমাধ্যমের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। দৈনন্দিন খাবারে যথেষ্ট অণুপুষ্টি না পেলে শিশুরা অপুষ্টির শিকার হয়। ফলে তাদের পক্ষে স্কুলে শেখা এবং পরবর্তীতে কর্মজীবনেও ভাল করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের ক্ষতি অপূরণীয়। অপুষ্টির শিকার যারা তাদেরসহ অন্যান্যদের এ বিষয়ে আরো অধিক মনোযোগি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
চিকিৎসকদের মতে, অপুষ্টি একটি মারাত্মক জনসমস্যা। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কোন খাবারে কি পরিমাণ পুষ্টি রয়েছে সে সম্পর্কে অভিভাবকদের সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। সমাজে কিছু সমস্যা রয়েছে, যা শিশু অপুষ্টির কারণ, তা হলো মাতৃদুগ্ধের বিকল্প খাদ্যের ব্যবহার। নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমেও বিকল্প এ মাতৃদুগ্ধ মা’র হাতে পৌঁছে থাকে।
২০১১-১২ সালে জাতীয় পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে জাতীয় অনুপুষ্টি সমীক্ষা হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, ৯ থেকে ১৪ বছরের কিশোরী মেয়েরা আয়রন (লৌহ জাতীয়) খাবার প্রয়োজনের তুলনায় ২০ শতাংশ কম খায়। শতকরা ১০ ভাগ মাছ ও মাংস খেতে পায়। এ সমস্যা কিশোর-কিশোরী উভয়ের
অপুষ্টিজনিত সমস্যা
"অপুষ্টিজনিত সমস্যা কনটেন্টটিতে রাতকানা রোগের লক্ষণ,কারণ ও প্রতিকার , মুখে বা ঠোঁটের কোণায় ঘা রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার/প্রতিরোধ, রক্তস্বল্পতার লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার/প্রতিরোধ, হাড্ডিসারের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার/প্রতিরোধ, গা ফোলা রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার/প্রতিরোধ, ম্যারাসমিক-কোয়াশিয়রকর রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার/প্রতিরোধ, আয়োডিনের অভাব জনিত রোগ, স্কার্ভির লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার/প্রতিরোধ, রিকেটস্ রোগের লক্ষণ, কারণ প্রতিকার/প্রতিরোধ সর্ম্পকে বর্ণনা করা হয়েছে।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিশুই অপুষ্টিতে ভোগে। অপুষ্টি হলো প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব। অপুষ্টিজনিত কারণে শিশুরা বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে এমনকি অপরিণত বয়সে মারাও যেতে পারে। পুষ্টিহীণতার কারণে সাধারণত শিশুরা রাতকানা, রক্ত স্বল্পতা বা এনিমিয়া, হাড্ডিসার বা ম্যারাসমাস এবং গা ফোলা বা কোয়াশিওরকর রোগে ভোগে। এ রোগগুলো খুবই মারাত্মক।
রাতকানা
লক্ষণ
- চোখের সাদা অংশের রং পরিবর্তন হয়ে বাদামি হয়ে যায়
- চোখের জল কমে গিয়ে সাদা অংশ শুষ্ক হয়ে যায়
- চোখ লাল হয়ে যায়
- অল্প আলোতে চোখে ঝাপসা বা কম দেখে
- উজ্জল আলোর দিকে সরাসরি তাকাতে পারে না
- চোখে ফুলি পড়ে (বিটট স্পট)
- চোখের মণিতে ঘা হয়ে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়
কারণ
- ভিটামিন-এ’র অভাব
- শিশুকে মায়ের দুধ না খাওয়ানো
- বাড়তি খাবারে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাদ্য কম বা না থাকলে
- শিশুর স্বাভাবিক খাবারে ভিটামিন-এ জাতীয় খাদ্য কম থাকলে কিংবা ডায়রিয়া বা হাম হলে
প্রতিকার
- এক থেকে পাঁচ বছর বয়সের শিশুদেরকে প্রতি বছরে ৬ মাস অন্তর অন্তর ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো
- প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন-কলিজা, মাছের তেল, ডিম, মাখন এবং গাঢ় রঙ্গিন শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া
- শাক-সবজি রান্নায় অবশ্যই পরিমিত তেল ব্যবহার করা
- শালদুধ সহ যতদিন সম্ভব বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো
- লক্ষণ দেখা গেলেই চিকিৎসা করা
মুখে বা ঠোঁটের কোণায় ঘা
লক্ষণ
- ঠোঁট লাল হয়ে ফেটে যায়/ কোনাগুলি ফেঁটে যায়
- মুখের বা ঠোঁটের দুই কোণায় ঘা হয়/সাদা হয়ে যায়
- কস পড়ে ও হা করতে কষ্ট হয়
- জিহ্বায় ঘা হয়, লাল হয়ে ফুলে যায় ও ব্যথা হয় এবং খেতে অসুবিধা হয়
কারণ
- খাবারে ভিটামিন-বি২ বা রাইবোফ্লাভিনের অভাব অথবা লোহার অভাব
- দুধ, ডিম, ডাল, কলিজা, সিদ্ধ চাউল এবং শাক-সবজি প্রয়োজনীয় পরিমাণে না খাওয়া
প্রতিরোধ/ প্রতিকার
- প্রচুর পরিমাণে দুধ, ডিম, ডাল এবং শাকসবজি খেতে হবে
- মুখে বেশি ঘা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিটামিন খেতে হবে/আয়রণ খেতে হবে
রক্তস্বল্পতা
লক্ষণ
- মুখমন্ডল ফ্যাকাশে বা সাদা হয়ে যায়
- শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সহজেই নানা রোগে আক্রান্ত হয়
- বুক ধড়ফড় করে
- রক্তের অক্সিজেন পরিবহন ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে শ্বাস প্রশ্বাস এবং নাড়ীর গতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী হয়
- বসা থেকে উঠলে মাথা ঘুরায় এবং বমি ভাব হয়
- জিহবা মসৃণ এবং সাদা হয়ে যায়
- হাতের তালু ও নখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়
- রক্তের ঘনত্ব কমে যাওয়ার ফলে পায়ে ও শরীরে জল আসতে পারে
- শীত ভাব হয়
কারণ
- খাবারে প্রধানত লৌহের ঘাটতি হলে
- খাবারে আমিষের ঘাটতি হলে
- খাবারে ভিটামিন-সি এর ঘাটতি হলে
- কৃমিতে আক্রান্ত হলে
- দুর্ঘটনায় অত্যধিক রক্তক্ষরণ হলে
- বাচ্চা প্রসবের পর ঠিকমত লৌহ সমৃদ্ধ খাবার না খেলে
প্রতিরোধ / প্রতিকার
- প্রচুর পরিমাণ লৌহসমৃদ্ধ ও আমিষ জাতীয় খাদ্য যেমন:গাঢ় সবুজ শাকসব্জী, কাঁচাকলা, ডাল, মাছ,মাংস, কলিজা, ডিম ইত্যাদি খেতে হবে
- ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফল যেমন: পেঁপে, কলা, পেয়ারা ইত্যাদি খেতে হবে
- শিশুকে শালদুধ সহ মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে
- শিশুর বয়স ৬ মাস পূর্ণ হলে মায়ের দুধের পাশাপাশি সুষম খাবার খাওয়াতে হবে
- কৃমি থাকলে চিকিৎসা করাতে হবে
- মারাত্মক অবস্থায় লৌহ ও আমিষ সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ মতো আয়রণ ট্যাবলেট খেতে হবে
হাড্ডিসার / ম্যারাসমাস
এ রোগটি শিশুদের আমিষ/শর্করা বা শক্তিদায়ক জাতীয় খাবারের মারাত্মক অভাবে হয়ে থাকে।
লক্ষণ
- শিশু স্বভাবিক ওজনের চেয়ে কম ওজন হয়ে থাকে
- শরীরের মাংসপেশী শুকিয়ে কঙ্কালসার হয়ে যায়
- পেট বড় হয়ে যায়
- চুলগুলি লালচে হয়
- বাহুর মাংস ও শরীরের অন্যান্য মাংস পেশি দুর্বল হয়ে থাকে
- শিশুর মেজাজ খিটখিটে হয়
- শিশুর ক্ষুধা বেশি হয়, শুধু খেতে চায়
কারণ
- আমিষ, শর্করা জাতীয় খাবারের মারাত্মক অভাব হলে
- শিশু ঘন ঘন ডায়রিয়া আক্রান্ত হলে
- বাড়তি খাবার না খাওয়ালে
- নানা রকম কুসংস্কারের ফলে শিশুকে সঠিক খাদ্য ঠিকমত না খাওয়ালে
প্রতিরোধ/ প্রতিকার
- জন্মের পর শালদুধ ও পূর্ণ ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে এবং পূর্ণ ৬ মাস বয়সের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি সঠিক উপায়ে শিশুকে পরিপূরক খাবার খাওয়ানো
- মাতৃগর্ভে শিশুর অপুষ্টি প্রতিরোধে গর্ভবতী মহিলাদের বাড়তি সুষম খাবার গ্রহণ করা
- প্রচুর পরিমাণে অধিক শক্তিদায়ক এবং আমিষ জাতীয় খাদ্য উপযোগী করে বারে বারে খাওয়ানো
- ডায়রিয়া বা কৃমি বা অন্যান্য সংক্রামক রোগ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শমত খাবার স্যালাইন বা অন্যান্য ওষুধও খাওয়ানো
- মারাত্মক অবস্থায় শিশুকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করানো
গা ফোলা (শরীরে জল আসা)
লক্ষণ
- শিশুর সমস্ত শরীর বিশেষত হাত, পা এবং মুখমন্ডলে জল জমা হয়ে ফুলে যায়
- মুখমন্ডল দেখতে গোলাকার এবং ফ্যাকাশে দেখায়
- মাথার চুল খুব পাতলা ও বাদামি হয়ে যায় এবং চুল উঠে যায়
- স্থানে স্থানে লালচে চর্মরোগের সৃষ্টি হয়
- যকৃত বা কলিজা কিছুটা বড় হয়ে যায়
- শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়
- শিশুর প্রায়ই ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হয়
কারণ
- আমিষ জাতীয় খাদ্যের মারাত্মক ঘাটতি হলে
- অন্ত্রের প্রদাহ, হাম প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হলে
প্রতিরোধ / প্রতিকার
- জন্মের পর শালদুধ ও পূর্ণ ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে এবং পূর্ণ ৬ মাস বয়সের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি সঠিক উপায়ে শিশুকে পরিপূরক খাবার খাওয়ানো
- উৎকৃষ্ট আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন-দুধ, মাছ- মাংস, মাখন, ঘি, দুধের সর ইত্যাদি অধিক পরিমাণে উপযোগী করে খাওয়ানো
- মাতৃগর্ভে শিশুর অপুষ্টি প্রতিরোধে গর্ভবতী মহিলাদের বাড়তি সুষম খাবার গ্রহণ করা
- শিশুর ডায়রিয়া হলে খাওয়ার স্যালাইন এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে ওষুধ খাওয়ানো। তাছাড়া ডায়রিয়াকালীন সময়ে মায়ের দুধ ও অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার খাওয়াতে হবে।
- মারাত্মক অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি করে জরুরি চিকিৎসা করা
ম্যারাসমিক-কোয়াশিয়রকর
লক্ষণ
- মুখমন্ডল শুকিয়ে বানরের মতো হয়ে যায় এবং হাত পায়ে জল বা রস জমা হয়ে ফুলে যায়
- দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়
- রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়
- প্রায়ই ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হয় এবং মলে খুব দুর্গন্ধ হয়
কারণ
- শিশুদের খাবারে দীর্ঘদিন শক্তিদায়ক ও আমিষ জাতীয় খাদ্যের অভাব হলে
- ঘন ঘন ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হলে
- শিশু পরিমিত পরিমাণে মায়ের দুধ না পেলে
প্রতিরোধ / প্রতিকার
- প্রচুর পরিমাণে শক্তিদায়ক এবং আমিষ জাতীয় খাদ্য উপযোগী করে খাওয়াতে হবে
- জন্ম থেকে ২ বছর পর্যন্ত অবশ্যই শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে
- শিশুর ৬ মাস বয়স থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য যথেষ্ট পরিমাণে উপযোগী করে খাওয়াতে হবে
- প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শমত চিকিৎসা করাতে হবে
আয়োডিনের অভাব জনিত রোগ
আয়োডিনের অভাব জনিত কারণে সৃষ্ট অপুষ্টি একটি মারাত্মক সমস্যা। আয়োডিনের অভাব অনেক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ। আয়োডিনের অভাবে যেসব রোগ হয়, তাকে আয়োডিনের অভাবজনিত বিকলতা বলা হয়।
নিচে জীবন চক্রের বিভিন্ন সময়ে আয়োডিনের অভাবজনিত সমস্যা উল্লেখ করা হলঃ
- ভ্রূণকাল: মৃত শিশু, জন্মগত ত্রুটি, মানসিক প্রতিবন্ধকতা
- নবজাতক: হাইপোথাইরয়েডিজম, মানসিক প্রতিবন্ধকতা [ক্রেটিন (Cretin) ]
- শৈশব ও কৈশোরত্তোর কাল: গলগন্ড, দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত, হাবা-গোবা, ট্যারা, কালা, বামনতা
- প্রাপ্তবয়স্ক: গলগন্ড, মিক্সিডিমা
প্রতিকার
- আয়োডিনযুক্ত লবণ
- শাকসবজি, ফলমূল
- সামুদ্রিক মাছ বেশী করে খেতে হবে।
প্রতিরোধ
- আয়োডিন দেহে বেশী পরিমাণে সংরক্ষণ করা যায় না। তাই প্রতিদিন স্বল্প মাত্রায় আয়োডিন খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করা উচিত।
- প্রয়োজনীয় আয়োডিন পাওয়ার সহজতম উপায় খাদ্য তালিকায় আয়োডিনযুক্ত লবণ অন্তর্ভূক্ত করা। বাজারে যাতে আয়োডিন বিহীন ভোজ্য লবণ কেনা না হয় এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
স্কার্ভি
লক্ষণ
- দাঁতের মাড়ি লাল হয়ে ফুলে যায়
- সামান্য আঘাতে দাঁতের গোড়া দিয়ে রক্ত ঝরে
- দাঁতের গোড়া মাড়ি থেকে আলগা হয়ে যায় ফলে দাঁত নড়ে
- মাড়িতে ঘা ও পুঁজ হয়
- চামড়ার নীচে রক্তক্ষরণ দেখা দেয়
কারণ
দীর্ঘদিন যাবৎ খাবারে ভিটামিন-সি এর ঘাটতি থাকলে।
প্রতিরোধ / প্রতিকার
- প্রতিদিন পরিমাণ মত ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে (লেবু, কমলালেবু, পেয়ারা ইত্যাদি)
- প্রয়োজনে ভিটামিন-সি ট্যাবলেট খেতে হবে
শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে শিশুকে নিয়মিতভাবে ভিটামিন ‘সি’ খাওয়াতে হবে, যা শিশুকে খোস পাঁচড়া ইত্যাদি চর্মরোগ থেকে রক্ষা করে।
রিকেটস্
লক্ষণ
- শিশু সময় মতো বসতে, উঠতে, দাঁড়াতে, হামাগুড়ি দিতে পারে না
- সময় মতো হাঁটতে পারে না
- শিশুর দাঁত উঠতে দেরি হয়
- শিশুর হাত ও পায়ের হাঁড় বাঁকা হয়ে যায়
কারণ
ভিটামিন-ডি এর অভাব হলে এবং ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে ক্যালসিয়াম শরীরে শোষিত না হলে।
প্রতিরোধ/ প্রতিকার
- প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাদ্য এবং সাথে সাথে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য খেতে হবে
- তাছাড়া শিশুর শরীরে ভিটামিন-ডি তৈরী করার জন্যে দৈনিক কিছু সময়ের জন্য শিশুকে খালি গায়ে রৌদ্রে রাখতে হবে
সচরাচর জিজ্ঞাসা
প্রশ্ন.১.রাতকানা থেকে প্রতিকার পেতে হলে কি ধরণের খাবার খেতে হবে?
উত্তর.প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন-কলিজা, মাছের তেল, ডিম, মাখন এবং গাঢ় রঙ্গিন শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে । শাক-সবজি রান্নায় অবশ্যই পরিমিত তেল ব্যবহার করতে হবে ।
প্রশ্ন.২.মুখে বা ঠোঁটের কোনায় ঘা কেন হয়?
উত্তর. খাবারে ভিটামিন-বি২ বা রাইবোফ্লাভিনের ঘাটতি হলে এবং দুধ, ডিম, ডাল, কলিজা, সিদ্ধ চাউল এবং শাক-সবজি প্রয়োজনীয় পরিমানে না খেলে মুখে বা ঠোঁটের কোনায় ঘা হয়।
প্রশ্ন.৩.রক্তস্বল্পতা কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
উত্তর.প্রচুর পরিমাণ লৌহসমৃদ্ধ ও আমিষ জাতীয় খাদ্য এবং ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফল খেতে হবে, কৃমি থাকলে চিকিৎসা করাতে হবে, মারাত্মক অবস্থায় লৌহ ও আমিষ সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ মতো আয়রণ ট্যাবলেট খেতে হবে।
প্রশ্ন.৪.স্কার্ভি রোগের লক্ষণ কোন গুলো?
উত্তর.
- দাঁতের মাড়ি লাল হয়ে ফুলে যায়
- সামান্য আঘাতে দাঁতের গোড়া দিয়ে রক্ত ঝরে
- দাঁতের গোড়া মাড়ি থেকে আলগা হয়ে যায় ফলে দাঁত নড়ে
- মাড়িতে ঘা ও পুঁজ হয়
- চামড়ার নীচে রক্তক্ষরণ দেখা দেয়
প্রশ্ন.৫.রিকেটস রোগ কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
উত্তর.প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাদ্য এবং সাথে সাথে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য খেতে হবে,তাছাড়া শিশুর শরীরে ভিটামিন-ডি তৈরী করার জন্যে প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য খালি গায়ে শিশুকে রৌদ্রে রাখতে হবে।
সূত্র: বিকাশপিডিয়া টীম