কলকাতা-সহ রাজ্য জুড়ে সোয়াইন ফ্লুয়ের থাবা চওড়া হতেই ওষুধের দোকানে দোকানে এখন মাস্ক কেনার হিড়িক। বাতাসে ভেসে বেড়ানো এইচওয়ান-এনওয়ান ভাইরাসকে যদি কোনও ভাবে ঠেকানো যায়, সে আশায় অনেকেই কিনে ফেলছেন বাজারচলতি মাস্ক। সুতি কিংবা সিন্থেটিক কাপড়ের তৈরি সে সব সার্জিকাল মাস্ক নাকে-মুখে এঁটে রাস্তায় বেরোচ্ছেন শহরবাসী। শহরের বেশ কিছু বেসরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষ আবার পড়ুয়াদের মাস্ক ব্যবহারের নিদান দেওয়ায় মাস্ক কেনা প্রায় হিস্টিরিয়ার পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, এতে কাজের কাজ তেমন কিছু হচ্ছে না। এমনকী এন-৯৫ নামের যে বিশেষ মাস্ক বাজারে মিলছে, তাতেও এইচওয়ান-এনওয়ান ভাইরাস থেকে আমজনতা কতটা রক্ষা পাবেন, তা নিয়েও সন্দিহান চিকিত্সক মহল। বরং সোয়াইন ফ্লু ঠেকাতে এর চেয়ে ঘন-ঘন হাত ধোয়ার পক্ষেই সওয়াল করছেন তাঁরা। তাতে পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত থাকার পাশাপাশি অন্যদের পক্ষেও তা সহায়ক হয়।
স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ নিমাই ভট্টাচার্যের কথায়, ‘যে কোনও কাপড়ের মধ্যে দিয়ে এই ভাইরাস অনায়াসে গলে যায়। ফলে সাধারণ কাপড়ের মাস্ক কোনও কাজে আসে না। এন-৯৫ মাস্ক ৯৫ বা তার বেশি ন্যানোমিটার সাইজের ভাইরাস আটকে দিতে পারে। কিন্তু ভাইরাসের সাইজ তার চেয়েও ছোট হলে আর এই মাস্ক কার্যকর নয়। সোয়াইন ফ্লুয়ের জীবাণুর সাইজ ৮০-১০০ ন্যানোমিটার হয়, তাই এই ভাইরাস দলের একটা অংশও সহজেই এন-৯৫ মাস্ক ভেদ করে নাকে-মুখে ঢুকে যেতে পারে।’ নিমাইবাবুর আরও বক্তব্য, মাস্ক সব সময় প্রয়োজন পড়ে না। সোয়াইন ফ্লুয়ের রোগীর কাছাকাছি থাকলে, তখনই এর প্রয়োজনীয়তা। কারণ রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বাতাসে তাঁর নাক-মুখ থেকে যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলকণা (ড্রপলেটস) বেরোয়, তার সঙ্গে মিশে থাকা ভাইরাস বাতাসে ভেসে ঢুকে আসতে পারে আমার-আপনার শরীরে। তখন মাস্ক ব্যবহার অত্যন্ত উপযোগী। কিন্তু অন্য সময়? ‘বাসে-ট্রামে-অফিসে কোথায় যে কার হাত ঘুরে কোন বস্তুতে লেগে রয়েছে এই ভাইরাস, তা আমরা কেউ জানি না। অথচ দরজার হাতল থেকে টেবিল কিংবা ফাইল --- যে কোনও বস্তুতেই থাকতে পারে ভাইরাস-যুক্ত ড্রপলেটস। অজান্তে সে সবে হাত দিয়ে সেই হাত না ধুয়ে নাকে-মুখে-চোখে লাগালে সেখান থেকেও সংক্রামিত হওয়ার আশঙ্কা রয়ে যায় ষোলো আনা। তাই বার বার হাত ধুতে হবে। এতে শুধু নিজে নয়, অন্যকেও সুরক্ষিত রাখতে পারব’---মন্তব্য প্রাণি ও মত্স্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান সিদ্ধার্থ জোয়ারদারের। তবে সাধারণ হাত ধোয়ায় কোনও লাভ নেই। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, নির্দিষ্ট সময় ধরে রীতিমতো সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। তবেই নিকেষ হবে সোয়াইন ফ্লুয়ের জীবাণু। কিন্তু সব সময় কি ঘড়ি ধরে হাত ধোওয়া সম্ভব? সম্ভব নয় জেনেই ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ গানের টোটকা বাতলাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী বলছেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন কর্মসূচিতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন, জন্মদিনের এই গানের প্রথম স্তবকটা মনে মনে গাইতে যতটা সময় লাগে, ততক্ষণ ধরেই হাত ধুতে থাকুন সাবান দিয়ে। ভাইরাসের নিউক্লিক অ্যাসিড প্রোটিন-শৃঙ্খল ভেঙে দিয়ে ভাইরাসকে মেরে ফেলতে সাবানে যে সময় লাগে, এই গানের সময়টুকু তার জন্য যথেষ্ট।’ মাস্কের পাশাপাশি শহরের নামজাদা কয়েকটি স্কুল আবার হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের পরামর্শও দিতে শুরু করেছে। ক্যালকাটা গার্লস-এর মতো স্কুলের অধ্যক্ষ বলেন, ‘আমরা ছাত্রছাত্রীদের সচেতনতা অবলম্বন করার অনুরোধ করেছি। মাস্ক তো বটেই, হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করতে বলেছি ওদের।’ সাউথ পয়েন্ট স্কুলের তরফে কৃষ্ণ দমানি জানাচ্ছেন, সৌভাগ্যক্রমে তাঁদের কোনও ছাত্রছাত্রী সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত হয়নি এখনও। কিন্তু তা-ও তাঁরা পড়ুয়াদের সচেতন হতে বলেছেন। শুক্রবার মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের তরফে আরজিকর হাসপাতালেও একটি সচেতনতা শিবির আয়োজন করা হয়। সেখানেও জোর দেওয়া হয়েছে হাত ধোয়ার পক্ষেই। হ্যান্ড স্যানিটাইজারে ব্যাকটেরিয়া মরে, ভাইরাস নয়, সে সতর্কবাণীও শোনাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, ভাইরাস মারতে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বিকল্প নেই।
সূত্র : এই সময়, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/4/2020