ব্যক্তিগত ভালো থাকার, আর আরামে থাকার রেশ ধরেই বদলেছে জীবন ধারণের মান এবং চাওয়া-পাওয়াও। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। বিশ্বয়িত খোলা বাজার অর্থনীতির প্রসার ইন্ধন জুগিয়েছে সেই অনিশ্চয়তায়। প্রভাব পড়েছে সন্তান লালনেও। সমাজের সর্বস্তরে প্রতিযোগিতা তীব্র আকার নিচ্ছে। একেবারে প্রথম শৈশব থেকেই শিশুকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিযোগিতার। কিন্ডারগার্টেন স্তরে ভর্তির জন্যও ছেলেমেয়েদের নানাবিধ পরীক্ষা-ইন্টারভিউ-এর মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেই যে পরীক্ষার পর্ব শুরু, তার যেন শেষ আর নেই অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা না পাওয়া পর্যন্ত।
অধিকাংশ বাবা-মা (আমরা এখানে আবার বলে নিই, এই বাবা-মা মূলত শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালি বাবা-মা) ছেলেমেয়েদের সাফল্য বলতে বোঝেন প্রথম হওয়া, নিদেন পক্ষে প্রথম তিনে থাকা। তা না হলেই যেন বজ্রপাত হয় তাঁদের মাথায়। ছেলেমেয়েদের ‘ব্যর্থতায়’ মুখ দেখানো ভার হয়ে পড়ে। যে ট্রাইব্রেকার বা পেনাল্টিতে কিক নেওয়ার মতো। গোল করাটাই যেখানে বাধ্যতা। না পারলেই ব্যর্থ। তুমি প্রথম হতে না পারলে, প্রথম কয়েক জনের মধ্যে অন্তত না থাকতে পারলে কী আর করলে! লেখাপড়ায় সাফল্যই কৃতিত্বের একমাত্র মাপকাঠি। পরীক্ষায় কে কত নম্বর পেল তার ভিত্তিতেই স্বীকৃতি জোটে এক জনের। সে কৃতী বলে সমাদৃত হয়। তা সে যতই আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর কিংবা সমাজবিমুখ হোক না কেন।
কৃতিত্বের এই পরীক্ষায় সাফল্যভিত্তিক মাপকাঠিই প্রায় সর্বজনগ্রাহ্যতা পেয়েছে। দক্ষিণ, বাম কিংবা র্যাডিক্যাল যে পন্থার ভাবুক হোন না কেন তেমন তফাত অন্তত এই ক্ষেত্রে চোখে পড়ে না। কৃতী হিসাবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে খেলাধূলা, গান, নাচ প্রভৃতিও। শুধুমাত্র শরীরচর্চা মানসিক বিকাশ কিংবা ভালো লাগার জন্য নয় — এখন খেলাধূলা, গান কিংবা নাচ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, বাবা-মার গৌরবকে বৃদ্ধি করার মাধ্যম হিসাবে বিবেচিত হয়।
তুমি ক্রিকেট খেলতে চাও? তা হলে তোমাকে শচিন কিংবা সৌরভ হওয়ার লক্ষ্যে খেলতে হবে। তুমি গান কর? পারবে টিভি পর্দায় নিয়মিত মুখ হয়ে উঠতে? না হলে কেন সময় নষ্ট কর?—এই মানসিকতাই যেন ক্রমে ক্রমে সংক্রামক আকার নিচ্ছে। বদলে যাচ্ছে আমাদের খেলাধূলা ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলও।
কৃতী গড়ে তোলার এই তাগিদের মূলে যেমন থাকে ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার উৎকণ্ঠা, তেমনই বহু ক্ষেত্রে সন্তানের সাফল্যের মধ্যে দিয়ে বাবা-মা হিসাবে নিজের সাফল্যকে দেখতে চাওয়া। এই দেখতে চাওয়ার মধ্যে অন্যায় হয়তো নেই, অস্বাভাবিকতাও নেই — কিন্তু রয়েছে ক্ষতিকর এক প্রবণতা।
প্রতি ক্ষেত্রে সন্তানের সাফল্য দেখতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে জন্ম দিচ্ছে বহু ক্ষেত্রই তীব্র উৎকণ্ঠা বা উদ্বেগ। এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কারণেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে প্রায় সব বিষয়েই অংশগ্রহণ বাড়ছে বাবা-মার।
সূত্র : পরিকথা ২০০৭
সর্বশেষ সংশোধন করা : 1/28/2020