উত্কণ্ঠিত বা আতঙ্কিত অবস্থার রোগীর সংখ্যা সব চেয়ে বেশি। আবার এই রোগীদের পুরোপুরি নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা অন্য রোগীদের তুলনায় অনেক বেশি, কিন্তু যদি এই উত্কণ্ঠী বা উদ্বেগ অবসেশনে পরিণত হয় তা হলে চিকিত্সার সময়ও বেড়ে যায় এবং এ সব ক্ষেত্রে পূর্ণ নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। Obsessional fear বা আবেশ আতঙ্ক সম্পর্কে আমরা পরে আলোচনায় আসছি। ভয়ের রোগীদের কতক গুলি উপসর্গ থাকে। বুক ধড়ফড়ানি (palpitation), নিশ্বাসের কষ্ট (breathlessness), মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা, হজমের গোলমাল, অনিদ্রা, বারবার মলমূত্র ত্যাগের তাগিদ, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, গলা শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ বা রোগ লক্ষণের কথা প্রায় সকলেই পেশ করেন এবং বেশ কিছু সংখ্যকের মধ্যে মৃত্যুভয়ের উপসর্গ দেখা যায়। এদের অনেকেই শারীরিক উপসর্গের জন্য পারিবারিক চিকিত্সক বা বিশেষজ্ঞ দ্বারা পূর্বেই চিকিৎসিত হয়েছেন। দেড় দু বছর নানা রকম ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও যখন উপসর্গের উপশম ঘটে না তখনই তাঁরা পারিবারিক চিকিত্সকের পরামর্শে অথবা নিজে থেকেই মনোরোগ চিকিত্সকের শরণাপন্ন হন।
এক ভদ্রলোক —বছর তিরিশেক বয়স, কঙ্কালসার চেহারা, মুখেচোখে উত্কণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট — এসে জানালেন যে বছর চার-পাঁচ ধরে তাঁর হজম হচ্ছে না, খেতে পারছেন না। তিনি সরকারি দফতরে কেরানিগিরি করেন। বাড়িতে পিতা এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ছাড়া আর কেউ নেই। মাঝখানে মাসছয়েক তিনি সাময়িক ভাবে বদলি হয়ে অন্য জায়গায় কাজ করেছেন। সেই সময় হজমের ওষুধ ইত্যাদি না খেয়েও তিনি মোটামুটি ভালো ছিলেন। ওজনও প্রায় দেড় কিলো বেড়েছিল। তিনি কলকাতায় ফিরে আসার পর থেকে আবার একই অবস্থা হয়েছে। ওষুধে ঘেন্না ধরে গেছে ইত্যাদি। চিকিত্সকরা তাঁর উপসর্গের উত্সর সন্ধান না করে উপসর্গ প্রশমনের ব্যবস্থা করে গেছেন। কাজেই প্রথম দিকে কিছু ফল হয়নি। তাঁর জীবন কাহিনি থেকে জানতে পারা গেল যে তাঁর ওই সব শারীরিক উপসর্গের —যাকে ইংরাজিতে psychosomatic disorder বলা হয় — কারণ ভয়। তাঁর দাদা বদরাগী এবং মদ্যপ। বৃদ্ধি পিতার কাছে মাঝে মাঝে মদের টাকার জন্য হাত পাতত এবং তিনি টাকা দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তর্জন গর্জন, অশ্রাব্য গালিগালাজ করে তাঁকে অসম্মানিত করত। এই রকম এক রাতে রোগী বাবার চিত্কারে ভয় পেয়ে বাবার ঘরে ছুটে যান এবং দাদাকে বাধা দেন। শক্তি এবং সাহস তাঁর অনেক বেশি ছিল; ভাইকে তিনি তক্ষুনি দু-চার ঘা দিয়ে অভিনন্দিত করেন। দাদার এই তর্জনগর্জন প্রায়ই সাড়ে ন’টা দশটায় হত। রোগী ভয় পেয়ে নটার আগেই খাওয়াদাওয়া সেরে দরজা-জানলা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করতেন। তখন থেকেই তাঁর শারীরিক উপসর্গগুলির সূত্রপাত। বদলি হয়ে কাজ করার সময় ভয়ের উত্সটি তাঁর কাছে ছিল না, তাই তিনি অনেকখানি সুস্থ ছিলেন। আমার এবং তাঁর সৌভাগ্য ক্রমে, চিকিত্সা শুরু হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর দাদা কলকাতা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এই রকম অনেক কাহিনিই মনোরোগ চিকিত্সকরা সরবরাহ করতে পারেন। এই উত্কণ্ঠাপীড়িত রোগীদের মানসিক উপসর্গের মধ্যে মৃত্যুভয় ছাড়া উন্মাদ হওয়ার ভয়ও দেখা দিতে পারে। কান্নাকাটি বিলাপ তাদের নিত্যনৈমিত্তিক চিকিত্সক সম্ভাষণ। ভয়ের সঠিক কারণ নির্ধারণ করতে পারলে এদের রোগমুক্তি সহজ হয়ে যায়। আগেই বলেছি সব মনের অসুখের মধ্যে এই রোগেরই প্রাদুর্ভাব বেশি এবং এই ধরনের রোগীরা আরোগ্যলাভ করেন তাড়াতাড়ি। কিন্তু উৎকণ্ঠাতাড়িত অবস্থায় বেশি দিন থাকলে এই উত্কণ্ঠা ক্রমশ অবসেশনে পরিণত হতে পারে। কোনও বিশেষ অবস্থায়, কোনও বিশেষ কারণে অত্যধিক ভয় পাওয়া রোগীর স্বভাবধর্ম হয়ে ওঠে। কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ উত্কণ্ঠাআচ্ছন্ন এই অবস্থাকে ফোবিক রিঅ্যাকশন (phobic reaction) নামে অবিহিত করেছেন এবং বিশেষ বিশেষ ভয়ের বিভিন্ন নাম দিয়েছেন যেমন claustrophobia, agarophobia ইত্যাদি।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/27/2020