মনের রোগ নিয়ে জ্ঞানীগুণিজনেরা উঁচুদরের আলোচনা করেছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের রোগ সম্পর্কে ধারণা কেতাবি তত্ত্বের সঙ্গে অনেক সময়েই মেলে না। আমার কাছে সাধারণ মানুষের ধারণা যে ভাবে ধরা পড়েছে, তারই কিছু বিবরণ এখানে দিচ্ছি।
এমন এক সময় ছিল, এ কথা আপনারা সকলেই জানেন, মনের রোগকে শয়তান বা প্রেতাত্মা প্রভাবিত বলে মনে করা হত। তখন তাদের যে চিকিত্সা হত তাও আমাদের সবার জানা। তবুও পুনরুল্লেখ করছি। তাদের পা বেঁধে মাথা নিচুর দিকে করে ঘরের ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হত এবং মাঝে মাঝে তাদের নগ্ন দেহের উপর আঘাত করে প্রেতাত্মা বা শয়তানকে শাস্তি দেওয়া হত। ফরাসি বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই এই উন্মাদাগারগুলির অধ্যক্ষ, এক চিকিত্সক, প্রথম উন্মাদদের প্রতি এই অমানবিক আচরণের অবসান ঘটান। সেই থেকে ইউরোপেরও প্রায় সব দেশেই বাতুলতা একটি রোগ বলে গণ্য হয়। বিজ্ঞান অনুমোদিত চিকিত্সায় দেহের রোগের মতো মনের রোগেরও উপশম ঘটতে পারে এই বিশ্বাস সকলেই পোষণ করতে লাগলেন। তার পর অনেক দিন কেটে গেছে। চিকিত্সারও অনেক উন্নতি হয়েছে। আশু উপশমের ব্যবস্থা সব ক্ষেত্রে না হোক অনেক ক্ষেত্রে আমাদের করায়ত্ত। কিন্তু জটিল ও গুরুতর মনোরোগ যথা স্কিজোফ্রেনিয়া, ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ সাইকোসিস ইত্যাদির পুনরাক্রমণ রোধ করা যাচ্ছে না।
আমার আলোচনা কিন্তু চিকিত্সা সংক্রান্ত নয়। সাধারণ মানুষ তাদের জ্ঞান, বুদ্ধি ও সংস্কৃতি অনুযায়ী মনোরোগ সম্পর্কে যে ধারণা এই একবিংশ শতকেও পোষণ করছেন, তা-ই নিয়েই দু-চার কথা বলব। মুসলমানদের নমাজ পাঠ সম্পর্কে যিনি পুরোপুরি অনভিজ্ঞ, তিনি কোনও রাস্তা বা কোনও মাঠের এক পাশে এক খানা গামছার ওপরে এক ব্যক্তির নমাজ পাঠের সময়কার অঙ্গভঙ্গি লক্ষ্য করলে নিশ্চয়ই মনে করবেন লোকটি অস্বাভাবিক বা উন্মাদের মতো আচরণ করছে। অন্য গ্রহবাসী কেউ যদি দারুণ শীতের ভোরে গঙ্গাসাগরে স্নানরত বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের দেখেন, তাঁর নিশ্চয়ই মনে হবে এরা অস্বাভাবিক, অবশ্য যদি তাঁর স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক সম্পর্কে ধারণা আমাদের মতো হয়। কিছু দিন আগেও আদিবাসীদের দু-একটা সম্প্রদায় শত্রুর মুণ্ডমালা গলায় ধারণ করে গর্ববোধ করতো, তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে এ ছিল শৌর্যসূচক একটি মহৎ কাজ — আমাদের কাছে যা বর্বরতা অথবা উন্মত্ত হিংসাত্মক আচরণের নিদর্শন।
এই কম্পিউটারের যুগে শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার রোগীর আত্মীয়রাও অনেক সময় বলেন যে, এক বন্ধুর বাড়িতে রাত্রিবেলায় চা খাওয়ার পর থেকে ভদ্রলোকের রোগলক্ষণ দেখা দিয়েছে, চায়ের সঙ্গে তারা কিছু মিশিয়ে দিয়েছিল নিশ্চয়ই। তুকতাক, মারণ উচাটন ইত্যাদি কথাগুলো শুধু যে প্রচলিত তা নয়, অনেকের মধ্যেই এই বিশ্বাসগুলি জাগ্রত এবং মনের রোগের ক্ষেত্রে এর প্রভাব অনেকেই স্বীকার করেন। অবশ্য সম্প্রদায় বিশেষে নিজস্ব ধ্যানধারণা, তাদের বিশ্বাস এবং সংস্কারকে বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করে। চিকিত্সার ক্ষেত্রে সব ডাক্তারই জানেন যে বেশ কিছু রোগী ঝাড়ফুঁক, কালীবাড়ি, পির-ফকির, সাধু-সন্ন্যাসী ইত্যাদির দ্বারা চিকিৎসিত হয়ে তার পর তাঁদের কাছে আসেন। তত দিনে অনেক জটিল হয়ে যায়।
এ থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, দেড়শো বছর আগেকার ধারণা এখনও জনসাধারণের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে আছে। বিজ্ঞানের অধ্যাপকের পুত্রের হাতে যখন অসুখ সারানোর মাদুলি বা তাবিজ দেখতে পাই, আঙুলের হাজার টাকা দামের রত্ন ঝকমক করে, তখন বুঝতে পারি মনোরেগের সংজ্ঞা, তত্ত্ব এবং শ্রেণি বিভাগের মধ্যে কোথাও বোধ হয় গোলমাল আছে যার জন্য মনোরোগ সম্পর্কিত প্রাচীন ধারণায় এখনও জনসাধারণ আচ্ছন্ন।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/14/2019