আমরা সমাজবদ্ধ জীব। আমাদের নিরাপত্তা সামাজিক পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। সমাজে যখন প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, স্বার্থ সংক্রান্ত সংঘাত বেশি থাকে তখন স্বভাবতই সমাজবদ্ধ মানুষের মনে ভয়, ভাবনা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত নানান দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। এ ছাড়া যদি ধর্মোন্মাদনা, জাত্যভিমান, ভাষাভিত্তিক আন্দোলন কোনও সময় তীব্র আকার ধারণ করে তখন যে সব এলাকায় আলোড়ন চলে সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (ধর্মীয়, জাতীয় ও ভাষাভিত্তিক) খুবই সন্ত্রস্ত হয়ে দিন কাটায়। আমাদের দেশে স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যখন মন্দিরের কাছে গরু জবাই করা হত বা মসজিদের সামনে হিন্দুদের বাজনা-বাদ্য সহকারে মিছিল বের হত, তা আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ ঘটনা হলেও স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভীতত্রস্ত করে তুলত। এই সামাজিক তথ্যগুলো মনে রাখলে ভয়ের কারণ বিশ্লেষণ সহজ হবে। এ ছাড়া রোগীর জীবনের অন্যান্য ঘটনা থাকে। একেবারে ব্যক্তিগত কারণ থেকে ভয়ের উদ্ভব হতে পারে। এক জন এসে বললেন তিনি ভিড়ের ট্রেনে বা দ্রুতগামী ট্রেনে, বাসে, বিশেষ করে ভিড়ের বাসে, উঠতে পারেন না। অফিসের বাসেও অফিসে যেতে অক্ষম, তাই সাইকেলের বন্দোবস্ত করেছেন। এ রকম চলছে ১৬/১৭ বছর ধরে। এ ছাড়া কোনও বদ্ধ জায়গায়, যেমন সিনেমা হলে, তিনি ঢুকতে পারেন না ও থাকতে পারেন না। তাঁর বিবাহ হয়েছে প্রায় ১৪ বছর। এর মধ্যে এক দিনও তিনি সিনেমা দেখেননি এবং এই কারণে তাঁর স্ত্রীও সিনেমা দশর্ন থেকে বঞ্চিত। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেল, পিতার মৃত্যুর পর তিনি যখন মাতামহের আশ্রয়ে নিরাপত্তা খুঁজছিলেন সেই সময় তাঁর মাতামহ এক বাস দুর্ঘটনায় মারা যান। এর কিছু দিনের মধ্যেই মাতামহীর কলকাতায় পা পিছলে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয়। এই দু’টি ঘটনা তাঁকে বিশেষ ভাবে বিচলিত করে এবং এই সময় থেকেই তিনি ভয়াক্রান্ত।
একজন ৩০/৩২ বছরের যুবক কোনও সঙ্গী ছাড়া বাড়ি থেকে অফিস — যা মাত্র কয়েক মিনিটের পথ — যেতে পারত না। অফিসে যাওয়ার সময় তার কোনও এক জন সঙ্গী লাগতই। ছেলেটি স্কুল–কলেজের পরীক্ষায় ভালো ফল করেছিল। শৈশবে পিতৃহীন হওয়ার পর থেকেই আর্থিক নিরাপত্তার অভাবে তার আবছা আতঙ্ক সব সময়ই বিদ্যমান ছিল। সে ওই বয়সেই ধর্মচর্চা করতে এবং স্থানীয় এক জন খুবই নামকরা গুরুর শিষ্য হয়েছিল। তারই নামজপ করার জন্য তার হাতে একটা থলির মধ্যে রুদ্রাক্ষের মালা থাকত। সে প্রায় ঘণ্টাদুয়েক দিনে পূজার্চনা করত। যুক্তিবিদ্যা এবং বিজ্ঞানসম্পর্কিত পড়াশোনা তার কম ছিল না। তা সত্ত্বেও সে মনে করত রাস্তায় একলা বেরোলে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে পারে। এই ভয়েই সে সঙ্গী ছাড়া কখনও বাড়ির বাইরে যেত না। যুক্তি দিয়ে এই দুই রোগী বুঝতে পারত যে তাদের
ভয়ের কোনও নির্দিষ্ট কারণ নেই। তবুও ভয়ের হাত থেকে তারা মুক্তি পেত না।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/27/2020