নিখোঁজ শিশু বলতে আমরা বুঝি – ১৮ বছরের কম বয়সের একজন মানুষ যার মা-বাবা, অভিভাবক, আইনগত অভিভাবক বা তার ভাল-মন্দ নিয়ে জড়িত লোকেরা তার বর্তমান হদিস, অবস্থান বা ঠিকানা সম্পর্কে অবগত নন। এই নিখোঁজ হওয়া বা অদৃশ্য হওয়ার পেছনে যে কোনও কারণ বা ঘটনাই থাক না কেন, শিশুটিকে নিখোঁজ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং তার যত্ন ও সুরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে বলে গণ্য করা হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার প্রকৃত অবস্থান এবং সুরক্ষা/কুশল-মঙ্গল সুনিশ্চিত করা হচ্ছে।
একটি ১০ বছরের মেয়ে – পূজা। সে তার মা-বাবার সঙ্গে থাকত। তার বাবা ক্ষেত মজুর এবং মা ঘরে কাজ করে। একদিন পূজার মোবাইল ফোনে অচেনা নম্বর থেকে একটি ফোন আসে। তার কয়েকদিন পর আবার মিসড কল। উৎসুক হয়ে পূজা সেই নম্বরে আবার ফোন করে। সেই ফোনগুলি যে ছেলেটি করত, ক্রমে তার সঙ্গে পূজার একটি সম্পর্ক গড়ে উঠল। ছেলেটি তার ভাল ব্যবহারে পূজার মনে স্থায়ী জায়গা করে নিল এবং এই ঘটনার কথা মেয়েটি তার মা-বাবার কাছে গোপন করে রাখল।
একদিন ছেলেটি পূজার সঙ্গে দেখা করতে চাইল। পূজা ও রাজি হয়ে গেল স্কুলের পর দেখা করতে। সে ভেবেছিল যে তাড়াতাড়ি দেখা করেই বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু ছেলেটি দেখা করতে এল তার বন্ধুদের নিয়ে । তারা পূজাকে কিছু খেতে দিল, যা খেয়ে সে অজ্ঞান হয়ে গেল। জ্ঞান ফিরলে, পূজা নিজেকে আবিষ্কার করল মুম্বাই শহরের এক নিষিদ্ধপল্লীতে। এই ধরনের ঘটনা আমাদের আশে পাশে প্রায় ঘটছে। নিখোঁজ হওয়া এবং পাচার হওয়া দুটি পরস্পরিক সম্পর্কিত ঘটনা — যার একটি থেকে অন্যটির উৎপত্তি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অনুমান করেছেন যে প্ৰায় ৪৪,০০০ নিখোঁজ হয়ে গেছে ১৯৯৬ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে। ভারতে প্রতি ৮ মিনিটে একটি শিশু নিখোঁজ হয় (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো, ২০১১)। এই তথ্যগুলি হিমশৈলের চূড়া বলেই বিবেচিত হবে – কারণ অংসখ্য ঘটনাই কোথাও নথিভুক্ত হয় না ।
পশ্চিমবঙ্গে ইন্টারনেট ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে নিখোঁজ শিশুদের অনুসরণ ট্র্যাকিং ব্যবস্থার প্রচলন।
সুসংহত শিশু সুরক্ষা প্রকল্পের প্রচলন।
জোগান |
চাহিদা |
দরিদ্র |
রোজগার ও জীবিকার চাহিদা |
রোজকারের সুযোগের অভাব |
বাড়ীর কাজের জন্য কম মজুরির লোকের চাহিদা |
এলাকা ভিত্তিক উন্নয়নের বৈষম্য |
শিল্পায়ন |
পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় |
ভ্রমণ শিল্পের প্রসার |
রাজনৈতিক সংঘর্ষ / প্রাকৃতিক দুর্যোগ |
বাণিজ্যিক দেহ ব্যবসার প্রসার |
মেয়েদের প্রতি বৈষম্য |
বড় শহরের চাকচিক্যের প্রতি টান |
বিশ্বায়ন |
যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নতি |
শিশুদের নিখোঁজ হওয়ার খবর সব থেকে বেশি জানা যায় যে সব জেলায়।*
দার্জিলিং (উত্তর), মুর্শিদাবাদ(মধ্য), দক্ষিণ ২৪ পরগণা(দক্ষিণ)
কোচবিহার(উত্তর), দক্ষিন দিনাজপুর (মধ্য), নদীয়া (দক্ষিণ)
জলপাইগুড়ি(উত্তর), মালদা এবং উত্তর দিনাজপুর(মধ্য), উত্তর ২৪ পরগণা (দক্ষিণ)
নিখোঁজ শিশু সংক্রান্ত ঘটনায় মেনে চলতে হয় কিছু আইনি পদ্ধতি। তার কয়েকটি —
নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রক ন্যাশনাল ইনফরমেটিক সেন্টারের কারিগরী সহযোগিতায় দেশের মধ্যে নিখোঁজ ও ঝুঁকিপ্রবণ শিশুদের অনুসরণ বা ট্র্যাক করার জন্য একটি তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছেন। এই ব্যবস্থাটি কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রূপায়িত সুসংহত শিশু সুরক্ষা প্রকল্পের একটি বিভাগ যার মূল লক্ষ্য হল প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যে সব শিশুরা বসবাস করে, তাদের অবস্থার উন্নতি ঘটানো।
পশ্চিমবঙ্গে এই পোর্টালটির সফল পরীক্ষার পর, সারা দেশে এটি ২০১২-১৩ সাল থেকে রূপায়িত হয়। এই পোর্টালটির মধ্যে (যার পোশাকি নাম ট্র্যাক চাইল্ড) যে কোনও মুহুর্তে নিখোঁজ ও খুঁজে পাওয়া শিশু সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য ধরা থাকে এবং সামগ্রিকভাবে চাইল্ড কেয়ার ইনস্টিটিউটগুলিতে (CCI) বসবাসকারী শিশুদের উন্নয়নের তথ্যও দিতে পারে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিখোঁজ শিশুদের বিষয়ে কতকগুলি নির্দেশ/সুপারিশ করেছেন। সেগুলি হল –
পশ্চিমবঙ্গ The West Bengal JJ Rules, 2007, Rule অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় একটি করে স্পেশাল জুভেনাইল পুলিশ ইউনিট থাকা আবশ্যক। এছাড়াও উক্ত আইন মোতাবেক প্রতিটি থানায় একজন নির্দিষ্ট চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অফিসার বা শিশু কল্যাণ আধিকারিক কর্তব্যরত থাকবেন। তাঁর দায়িত্ব থাকবে কোনও শিশুর যত্ন ও সুরক্ষার প্রয়োজন বা আইনের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত শিশুদের কেস গুলিকে পরিচালনা করবে। স্পেশাল জুভেনাইল পুলিশ নিখোঁজ শিশুকেউদ্ধার করবে,তারাই শিশুটির নুন্যতম খাদ্য, পোশাক, ওষুধ, ইত্যাদির চাহিদা মেটাবে এবং তার সঙ্গে শিশু বান্ধব ব্যবহার করবে।
ইন্সপেক্টর জেনারেল (রাজ্যে জুভেনাইল সংক্রান্ত সব বিষয়ে দায়িত্ব প্রাপ্ত)।
জেলার পুলিশ সুপার বা মহানগরীর ক্ষেত্রে পুলিশ কমিশনার।
জুভেনাইল বা চাইল্ড প্রোটেকশন অফিসার।
কোনও কন্যা শিশু (জুভেনাইল) কে পুলিশ হেফাজতে কখনই রাখা যাবে না কিংবা সূর্যাস্ত-সূর্যোদয়ের মধ্যের সময়ে তাকে থানার ভেতরে রাখা যাবে না। যদি অত্যন্ত জরুরি অবস্থায় কোনও কন্যা শিশু (জুভেনাইল)-কে থানায় রাখতে হয়, তাহলে তাকে কোনও মহিলা আধিকারিকের দেখাশোনায় রাখতে হবে।
ফৌজদারি দণ্ডবিধির ধারা ২৭৩ অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্কের এবং জুভেনাইলদের একত্রে শুনানি আয়োজন করা যাবে না। সেই কারণে পুলিশ কোনও আইনভঙ্গের জন্য প্রাপ্তবয়স্কের সঙ্গে কোনও জুভেনাইলের নামে চার্জশিট দাখিল করতে পারবে না। (জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট ২০০০-এরা ধারা ১৮)।
তথ্য যাচাই করার সময় কোনও জুভেনাইলের সম্পর্কে রূপ দাখিল না করা। কোন সময়ে জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্টের আওতায় বিবেচনাধীন থাকার কারণে জুভেনাইলের সম্পর্কে বরূপ রিপোর্ট দাখিল না করা বা সেই কারণে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকা (জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট ২০০০-এর ধারা ১৯) ।
পরিচয় প্রকাশের নিষেধাজ্ঞা আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত কোনও শিশুর নাম এবং পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। (জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট ২০০০-এর ধারা ২১)।
হাতকড়া বা শেকল ব্যবহার করা যাবে না। কোন শিশু বা জুভেনাইলকে হাতকড়া বা শেকল পরানো যাবে না, তাদের থানার লকাপেও রাখা যাবে না।
শিশুর কাছ থেকে কোনও তথ্য আদায়ের জন্য কোনও রকমের অত্যাচার বা হয়রানি করা যাবে না।
জুভেনাইল বা অপ্রাপ্তবয়স্ক বয়সে সংগঠিত কোনও অপরাধের দায় প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় কোনও অপরাধের জন্য গ্রেফতারের সময় তার বিরুদ্ধে ধরা হবে না।
লেখকঃ নৈঋতা বন্দ্যোপাধ্যায় কো-অর্ডিনেটর, চাইল্ড প্রোটেকশন রিসোর্স সেন্টার, সিনি
* The Hidden Trap: A mapping study on missing children in 10 districts of West Bengal: Study by CINI
তথ্য সংকলনঃ পঞ্চায়েতী রাজ, মে ২০১৬ সংখ্যা
সর্বশেষ সংশোধন করা : 3/31/2020