আমরা শুনে আসছি শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। কিন্তু এই ভবিষ্যতকে যদি স্বাস্থ্যকর এবং সুরক্ষিত পরিবেশ না দেওয়া যায়, যদি তারা পড়াশুনার এবং উন্নয়নের পরিবেশ না পায় তাহলে এই ভবিষ্যৎ কখনোই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে এটা দেখা গেছে যে ভারতবর্ষের মোট শিশু সংখ্যার প্রায় ৪০% বিপদজনক অবস্থায় আছে, কোনো না কোনো ভাবে কঠিন পরিস্থিতিকে মোকবিলা করতে বাধ্য হচ্ছে। ভারতবর্ষে শিশুর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৪০ লক্ষ, যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশী। পৃথিবীর সমস্ত শিশুদের মধ্যে ১৯% ভারতবর্ষে বাস করে, সেই বিচারে ভারতবর্ষ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম যুব দেশ ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ভারতীয় সংবিধান মৌলিক অধিকার এবং নির্দেশমূলক নীতির মাধ্যমে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে থাকা শিশুদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিলো। সাম্য ব্যক্তি স্বাধীনতার মাধ্যমে বঞ্চনা থেকে শিশুদের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে সংবিধানের ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ২১, ২৩, ২৪ নং ধারাগুলিতে । (ঙ), ৩৯ (চ), ৪৫, ৪৬, ৪৭ ধারাগুলি নিশ্চিত করেছিলো শিশুর স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ব্যাপারগুলিকে । কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি রাষ্ট্রের প্রয়াস সত্বেও শিশুদের অধিকার সুনিশ্চিত করা যায়নি। ১৯৮৯ সালের রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে, বিশ্বব্যাপী শিশুসুরক্ষা ও শিশু অধিকার আন্দোলন বিশেষ গুরুত্ব পায় । সেখানে শিশুদের যে মৌলিক অধিকার গুলি গৃহীত হয় তার মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং ক্ষতিকর কাজ থেকে সুরক্ষা, যে কোন ধরণের যৌন লাঞ্ছনা এবং অপরাধের লাঞ্ছনা থেকে সুরক্ষা এবং শারারিক এবং মানসিক হিংসা থেকে সুরক্ষা ইত্যাদি । সেই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করা হল যে শিশুদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না । ১৯৯২ সালে ভারতবর্ষ শিশু সুরক্ষার বিশ্বব্যাপী আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৯৮৯ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে গৃহীত শিশুর অধিকারের সনদে স্বাক্ষর করে। এর ফলশ্রুতি হিসেবে প্রণয়ন বা সংশোধন করা হয়েছে শিশুর স্বার্থকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে। এছাড়াও বেশ কিছু নীতি ও কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে ।
এই প্রেক্ষাপটে শিশুর অধিকার এবং কিশোর ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে সারারাজ্য জুড়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রয়োজন সম্পদের বিকাশ, পরিকাঠামো ও সমন্বয়ের উন্নয়ন এবং শিশু সুরক্ষার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ। এছাড়া শিশু সুরক্ষা প্রদানে নিযুক্ত ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার দিকটি সঠিকভাবে জানা এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। শিশু সুরক্ষা যথাবিহিত দিতে গেলে বা সবচেয়ে আবশ্যিক সেটি হল রাজ্যস্তরে বিপদজ্জনকঅবস্থার মধ্যে থাকা শিশুর পরিসংখ্যান। কিন্তু এই পরিসংখ্যান অনেক ক্ষেত্রেই অমিল। পশ্চিমবঙ্গে শিশুর অবস্থান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ২০১১ সালে ০-৬ বছর পর্যন্ত শিশুর সংখ্যা সমগ্র জনগনের ১১.০৭ শতাংশ যেটি ২০০১ সালে ১৪.২৪ শতাংশ ছিল। কিন্তু কয়েকটি জেলা বিশেষ করে উত্তর দিনাজপুর (১৫.৬৬%), মালদা (১৪.৭৬%), মুর্শিদাবাদ (১৩.৭৯%) জেলায় ০-৬ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা যথেষ্টই বেশী। বিপরীত পক্ষে, কলকাতায় শিশুর আনুপাতিক হার খুবই কম (৬.৬৯%)। পশ্চিমবঙ্গে সাধারন ২০০১ সালের তুলনায় (৯৩৪) ২০১১ সালে অনেকটা বাড়লেও (৯৪৭), ০-৬ বছর বয়সী লিঙ্গানুপাত ২০০১ সালের তুলনায় ৯৬০ থেকে কমে ২০১১ সালে ৯৫০ হয়েছে। যে জেলাগুলিতে শিশু লিঙ্গানুপাত উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গেছে সেগুলি হল :
দাৰ্জিলিং (৯৬৬ থেকে ৯৪৮), জলপাইগুড়ি (৯৬৯ থেকে ৯৪৯), উত্তর দিনাজপুর (৯৬৫ থেকে ৯৪৬), দক্ষিণ দিনাজপুর (৯৬৬ থেকে ৯৪৮), পুরুলিয়া (৯৬৪ থেকে ৯৪৭) । গ্রামীণ জেলাগুলিতে শিশুর লিঙ্গানুপাত কমে যাবার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। শহর কলকাতায় অবশ্য এই অনুপাত সামান্য হলেও বেড়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলে ভর্তি হবার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলেও (৯২.১%), স্কুল ছুট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা এখনও উদ্বেগজনক, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণীতে মেয়েদের (৭৮.৩%) স্কুলছুট হবার পরিসংখ্যান
ছেলেদের থেকে অনেকটাই বেশী। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৮.৫৭ লক্ষ শিশু শ্রমিকের মধ্যে ৯ শতাংশ নানা ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত। কৃষিক্ষেত্রে প্রায় ৭০ শতাংশ শিশু শ্রমিক নিযুক্ত আছে। পথশিশু ও ভিক্ষাবৃত্তিতে নিযুক্ত শিশুর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। কিন্তু এদের বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান নেই। সঠিক অভিভাবকে অভাবে এই ধরনের শিশুরা বিভিন্ন লাঞ্ছনার শিকার হয় এবং নানা অপরাধমূলক কাজে যেমন জুয়া, চুরি, মাদকসেবন প্রভৃতি অসামাজিক কাজে জড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার অভাবে একদিকে যেমন তার দক্ষতার বিকাশ ঘটেনা, জীবিকার উন্নতি হয়না, তেমনভাবে আর একটি অসেচতন দরিদ্র প্রজন্ম তৈরী হয়। বাল্য বিবাহের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান বিশেষ উদ্বেগজনক, প্রায় ৫৪ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায় (সূত্র : জেলাভিত্তিক গৃহ সমীক্ষা, ২০০৮)। যে জেলাগুলিতে বাল্য বিবাহের সমস্যা খুব বেশী সেগুলি হল : মালদা, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বাঁকুড়া, দক্ষিণ দিনাজপুর, পুরুলিয়া, নদীয়া ও কোচ রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে অনেক মেয়েকে পাচার করে কলকাতাস্থিত বেশ্যালয়গুলিতে বিক্রি করে দেওয়া হয় অথবা পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমে উত্তর ও পশ্চিমভারতে পাচার করে দেওয়া হয়। ইউনিসেফ ১৯৯৫ তথ্য অনুযায়ী, এই মেয়েদের প্রায় ২৫ শতাংশ ১৮ বছরের নীচে। ২০০৭ সালে সেভ দ্য চিলড্রেনের এর একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, শুধু কলকাতা শহরেহ ৫০,০০০ এর বেশী শিশু যার অধিকাংশই মেয়ে
গৃহশ্রমে নিযুক্ত রয়েছে। কলকাতায় পাশ্ববর্তী জেলাগুলি যেমন উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে গৃহশ্রমের জন্য অনেক মেয়েকে । পাঠানো হচ্ছে কলকাতা ও ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে। এদের অনেকেই পরবর্তীকালে পাচার হয়ে যায় এবং নানাবিধ যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো, ২০১১ থেকে আমরা দেখি রাজ্যে ১৪৫০টি নিপীড়নমূলক ঘটনার মধ্যে ৬৬০ জনকে পাচার করা হয়েছে, ২৫২ জন ধর্ষণের শিকার, ২৯৮ জন অল্পবয়সী মেয়েকে সংগ্রহ করা হয়েছে বিভিন্ন যৌনাচারের জন্য ও ৭৮ জনকে অন্যান্য অপরাধমূলক কাজের শিকার হতে হয়েছে ।
এই অবস্থার প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহে নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রকের অধীনে সারা দেশব্যাপী শিশু সুরক্ষার বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করার জন্য রাজ্যসরকারগুলির মাধ্যমে সুসংহত শিশু সুরক্ষা প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প চালু হয়েছে এবং এই প্রকল্পের দ্বারা সুরক্ষা সম্পর্কিত সরকারী প্রকল্পগুলিকে এক ছাতার তলায় এনে সারা দেশে পারিবারকে ও সামাজিকন্তরে শিশু সুরক্ষার বিষয়টিকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্পটি ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে এবং জেলাস্তরে শিশু সুরক্ষা প্রদানের জন্য পরিকাঠামো গঠনের কাজ অনেকটাই সম্পন্ন হয়েছে
প্রকল্পটির ব্যপ্তি ও পরিসর উপলব্ধি করে এই পুস্তকটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে এই উদ্দেশ্যে যাতে প্রকল্পটির সকল স্তরের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা এবং আপামর জনসাধারণ প্রকল্পটির উদ্দেশ্যে ও প্রকল্পাধীন পরিষেবাগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যগুলি সঠিকভাবে জানতে পারেন ও প্রকল্পটিকে সঠিকভাবে রূপায়ণ করতে পারেন।
এই অনুবাদ পুস্তিকাটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিশু বিকাশ দপ্তরের উদ্যোগে এবং ইউনিসেফ কলকাতা অফিস ও জয়প্রকাশ ইনস্টিটিউট অফ সোস্যাল চেঞ্জের সহায়তায় রচনা করা হয়েছে।
সুত্রঃ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিশু বিকাশ দপ্তর
সর্বশেষ সংশোধন করা : 3/2/2020