পূর্বোত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্যে তাঁর সাম্প্রতিক সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঈশাণ কোণের সার্বিক উন্নতির উপরে জোর দিয়েছেন। দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প -- একটি অসমের দুধনই থেকে মেঘালয়ের পশ্চিম গারো পার্বত্য জেলার মেন্ডিপাথার পর্যন্ত প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন ও অপরটি ত্রিপুরার পলাটানায় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কমিশন ও ত্রিপুরা বিদ্যুৎ নিগমের যৌথ প্রচেষ্টায় নির্মিত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প -- উদ্বোধন করলেন। নয় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত এই প্রকল্পটি পূর্বোত্তর ভারতের বৃহত্তম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। ‘পূবে তাকাও’ নীতির উত্তরণ হয়েছে পূবে কাজ করো নীতিতে। প্রকল্পগুলির ভূমিকা ও প্রভাব যে এতে সুদূরপ্রসারী হবে তা বলাই বাহুল্য। প্রান্ত অঞ্চলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের মানসিক, আত্মিক ও প্রগতির যে যোগসাধন, তা সম্ভব হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সকলকে নিয়ে বহুমাত্রিক ও বহু-সংস্কৃতি বিশিষ্ট জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলনের নানামুখী প্রয়াসকে স্বীকার করেই।
‘নানা ভাষা নানা মত, নানা পরিধানের’ এই যে সাতনরি হার, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৈচিত্র নিয়ে যে সার্বিক উন্নয়নের কর্মধারা, তার মূলে রয়েছে ভারতীয় সংবিধানের সুদৃঢ় ভিত্তি। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান লাগু হল। বহু রাজনীতিবিদ, আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও বিশিষ্ট পণ্ডিতদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, বিশ্লেষণ ও আলোচনার ফলশ্রুতিতে এর উদ্ভব। এর মূল স্তম্ভ দু’টি -- সার্বিক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো।
ভারতের সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘ইউনিয়ন অফ স্টেটস’। কেন্দ্রে সরকার ২৯টি রাজ্য সরকার ও কয়েকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নিয়ে শাসনব্যবস্থার মূল কাঠামো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার থেকে এটি পৃথক। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার শাসনতন্ত্র থেকেও অনেক অমিল রয়েছে। ভারতে বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পটভূমি -- কখনও কখনও তা একে অপরের বিরুদ্ধ -- সব নিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সঠিক ধরে রাখার জন্য সংবিধান প্রণেতারা অনেক চিন্তাভাবনা করেছেন। সুপ্রাচীন ইতিহাস ও নানা সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ও অমিত বৈচিত্র থেকে দু’টি পরস্পর-বিরোধী শক্তির বিষয়ে পণ্ডিতরা একান্ত সংবেদনশীল। একটি কেন্দ্রাতিগ অন্যটি কেন্দ্রাভিমুখ। এই দু’টি বিপরীতমুখী শক্তির মধ্যে সমন্বয় সাধন একান্ত জরুরি।
কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতা বিভাজন নিয়ে সংবিধান প্রণেতারা একটি গাইড লাইন তৈরি করলেও সঙ্ঘাত বাঁধে খুঁটিনাটি প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নে। ওসই বিরোধগুলিকে গৌণ করে সমঝোতার প্রশ্নটিকে প্রাধান্য ইদেয় ভারতের গণতন্ত্র এগিয়ে চলেছে।
সংবিধানের একাদশ ও দ্বাদশ খণ্ডে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে আইন প্রণয়ন ও প্রশাসনিক ক্ষমতা নির্দিষ্ট করা আছে। সপ্তম তফসিলে এ ব্যাপারে একটি তালিকা অন্তর্ভুক্ত করা আছে। তিনটি সূচি রয়েছে। প্রথমটিতে যে বিষয়গুলি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে, সেগুলি দেওয়া আছে। দ্বিতীয় সূচিতে রাজ্য সরকারগুলি যে যে বিষয়ে আইন প্রণয়ন ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে তা বর্ণিত আছে। তৃতীয় সূচিটি যৌথ সূচি বা কনকারেন্ট লিস্ট। এতে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলি যৌথ ভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। মনে রাখতে হবে যে, কেন্দ্রীয় আইনের সঙ্গে কোনও রাজ্য বিধানসভা প্রণীত আইন বিরুদ্ধ হলে কেন্দ্রীয় আইনই বলবৎ থাকবে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আর্থিক ক্ষমতা ও কর রাজস্ব বিভাজন সম্পর্কিত। অর্থ কমিশন এ ব্যাপারে যথাযথ সূত্র প্রণয়ন করে। সেই অনুসারে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যে অর্থ বণ্টনের সুপারিশ করে।
সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন যে ধারাবাহিক ভাবে হয়ে আসছে, তাতে প্রথম দিকে একটি দলের প্রাধান্য থাকলেও পরে দেশে বিভিন্ন রাজ্যে নানা দল ক্ষমতায় আসে। অনেক আঞ্চলিক দলের উদ্ভব হয় এবং এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, কেন্দ্রে ও রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন দল কোয়ালিশন (জোট) বা সম্মিলিত ফ্রন্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে ক্ষমতায় আসে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নানা ধরনের দ্বন্দ্ব ও অনেক সময় সরব বিপত্তির উদ্ভব হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে টানাপোড়েন, মনোমালিন্য, মতবিরোধ ও তার ফলশ্রুতিতে সামগ্রিক ব্যবস্থার উপর চাপ পড়ে যা প্রায়শই অশুভ ও অহিতকর প্রবণতার জন্ম দেয়। সাম্প্রতিক অতীতে বিভিন্ন দলের সহযোগিতায় গড়া জোট সরকারগুলির কার্যধারায় অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। চেপে বসেছে রাজনৈতিক বিতর্ক ও অস্থিরতার আবহ।
স্পষ্টত, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একক প্রাধান্য বা মনোলিথ ভাঙল। প্রথমে কেরালা ও তার পর ১৯৬৭ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের পর কংগ্রেস-বিরোধী দল অনেক রাজ্যে ক্ষমতায় আসে। তারা কংগ্রেস-বিরোধী কর্মসূচি নিয়ে রাজনৈতিক ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছিল। তাই এক দল, এক কর্মসূচি, এক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের অবসান হয়ে গেল। ভারতীয় সংবিধানের মধ্যে থেকেই রাজ্যগুলি নানা দাবিদাওয়া, অধিক আর্থিক ক্ষমতা, কর রাজস্বের ক্ষেত্রে রাজ্যের অধিকতর অংশীদারিত্বের কথা বলা শুরু করে। এর ফলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি সূচিত হল। ভারতীয় সংবিধান প্রণেতারা মোটামুটি ভাবে তিনটি স্তম্ভের উপর যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দাঁড় করিয়েছিলেন। অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন কেন্দ্রীয় সরকার, নমনীয়তা ও রাজ্যগুলির সঙ্গে সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ,অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের অভিজ্ঞতা ও ভারতের পূর্ববর্তী রাজত্বগুলির উত্থান-পতনের ইতিহাস – এ সবই তাঁদের মাথায় ছিল। ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পুরনো রীতিনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে একটি যথোপযুক্ত ব্যবস্থা প্রণয়ন করে সংবিধান-সভায় পাশ করানো হয়েছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং আর্থ-সামাজিক স্তরে ভিন্ন ভিন্ন মানে থাকা প্রান্তিক ও অনুন্নত শ্রেণির জনগণের আর্থিক মুক্তি ও উন্নয়নের কথা সচেতন ভাবে মনে রাখা হয়েছিল।
বেশ কয়েকটি এককেন্দ্রিকতার বৈশিষ্ট্য যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলি হল -- একক নাগরিকত্ব। অধিকতর ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় সরকার, যা সংবিধানের বিশেষ বিশেষ অনুচ্ছেদ-প্রদত্ত বিধান অনুসারে রাজ্যগুলির উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। কেন্দ্রীয় সূচি ও রাজ্য সূচির অতিরিক্ত বিষয়গুলিতে কেন্দ্রের ক্ষমতাই চূড়ান্ত। একক সংবিধান কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাজ্যগুলির সীমা ও নাম পরিবর্তনের ব্যাপারে কেন্দ্রের অনুমতি ও ক্ষমতাপ্রয়োগ বাধ্যতামূলক। বিচারব্যবস্থাও একক। দেশের শীর্ষ আদালত সুপ্রিম কোর্টের অধীনে হাইকোর্ট-সহ বিচারব্যবস্থা পরিচালিত। জরুরি অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব বাড়ে। রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে রাজ্যপাল নিয়োগ কেন্দ্রীয় সরকার ও রাষ্ট্রপতির অধীন।
সর্বভারতীয় প্রশাসনিক সেবার ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা অধিক। কর রাজস্ব থেকে উদ্ভুত আয়ের বণ্টন ও উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদনের ব্যাপারে অনেক সময় নির্দিষ্ট বিধান অনুসারে রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রের উপর নির্ভর করতে হয়। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও কোনও কোনও বিষয়ে রাজ্যগুলির আইনসভাগুলি স্বাধীন ভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারে না। খসড়া বিল এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের উপর নির্ভরশীল।
ভারতীয় সংবিধানের এই যে সব বৈশিষ্ট্য সংবিধান প্রণেতারা অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তার প্রেক্ষাপটটিও লক্ষনীয়। স্বাধীনতার সময় ব্রিটিশ ভারত, যা মূলত এককেন্দ্রিক বা ইউনিটারি ও প্রায় ৫৮০টি দেশীয় রাজ্য নিয়ে দেশটির বিস্তার। এর ফলে সংবিধানকে কোনও কোনও ক্ষেত্রে নমনীয় এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে সুদৃঢ় রাখা হয়েছে, দেশের অখণ্ডতা ও সুশাসন করার কথা মাথায় রেখেই। কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তি নিহিত রয়েছে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ও আর্থিক ক্ষমতার মধ্যে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। যদি সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তা-ও করা যায় বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে। সংবিধানের ৩৬৮ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সংসদের দুই সভাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের সমর্থনে ও সংসদে উপস্থিত ভোটদাতা সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে পাশ করা যায়। রাজনৈতিক ও আইনসভার আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে ক্ষমতাসীন দল এই ভাবে বা কখনও যৌথ অধিবেশন ডেকে সংবিধান সংশোধন করে জনসাধারণের উন্নয়নে আইন প্রণয়নের পথ সুগম করে। ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি ও অতীত ইতিহাসের বিচারে এই সব বিশেষ ব্যবস্থা রাখার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। অতীতে দেখা গেছে, শক্তিশালী কেন্দ্র না থাকলে বা কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের দুর্বলতার সুযোগে অনেক বিভেদকামী বা ক্ষুদ্র ও গোষ্ঠীস্বার্থ সমন্বিত শক্তির উদয় হয়। নানা ধরনের উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসবাদী শক্তি দেশের অখণ্ডতা ও সার্ভভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টায় রত থেকে শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
সংবিধান প্রণেতারা এই সব বিষয় বিবেচনা করেই দেশের শান্তিপূর্ণ অগ্রগতির পথ সুগম করতে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা ব্যাপকতর করেছেন। সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কোঅপারেটিভ ফেডারেলিজমের ধাঁচে ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা আবর্তিত হয়ে চলেছে ছ’ দশকের বেশি সময় ধরে। এর থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতার বিভাজন, আর্থিক ও কর রাজস্বের ব্যবস্থা, প্রশাসনিক ক্ষমতা, পরিকল্পনা প্রণয়ন, আন্তঃরাজ্য সম্পর্ক, সারা দেশে পণ্য পরিবহণন সংক্রান্ত আইন প্রভৃতি বিষয়ে শক্তিশালী কেন্দ্রকে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিশেষ রূপ। এই চলার পথ সব সময় মসৃণ হয়নি। মাঝে মাঝেই নানা বিতর্ক, কেন্দ্রীয় সরকার ও কোনও কোনও রাজ্য সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের জন্মও দিয়েছে। বস্তুত বিগত ছয় দশকে ভারতের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সে দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। ভারত নিঃসন্দেহে আজ শিল্প, প্রতিরক্ষা ও আর্থিক ক্ষেত্রে একটি বড় শক্তি হিসাবে এশিয়া তথা গোটা বিশ্বে পরিচিত হয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক শ্রেণি, জাতি, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীভিত্তিক দল ও ‘এলিটের’ উদ্ভব হয়েছে। যারা সক্রিয় ভাবে নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে সরব হয়েছে। বিপরীতমুখী নানা পরস্পর-বিরোধী শক্তির টানাটানিতে ধনী, মধ্যবিত্ত ও নির্ধনের ভিন্ন ভিন্ন দাবি ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার আবহে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলেছে। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত্রতান্ত্রিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি ও উদীয়মান শিল্পভিত্তিক ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাধারার মধ্যে তীব্র বিরোধাভাস ও দ্বান্দ্বিক অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি ও শ্রেণির জন্ম দিয়েছে। আঞ্চলিকতাবাদ, জাতীয় সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র পরিচিতিভিত্তিক রাজনীতি, আর্থ-সামাজিক মানদণ্ডে ভিন্ন ভিন্ন স্তরে থাকা মানুষ ও গোষ্ঠীর এই যে আবর্তন, তা একটি স্বতন্ত্র মাত্রায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এর ফলে সরকার গঠনে বিভিন্ন বিরোধী শক্তি কখনও ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে এক ছাতার তলায় এসেছে। জোটবদ্ধ সরকার গড়েছে। নানা চাপ বিতর্ক নিয়ে কখনও এই ধরনের সরকার সফল হয়েছে। কখনও আবার টানাপোড়েনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার স্লোগান উঠতে থাকে ষাট-সত্তরের দশকে। কিন্তু পরবর্তীকালে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্য সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রশ্ন তোলে।সেই প্রশ্নের মীমাংসা চেনা কাঠামোর মধ্যে পাওয়া যাবে কিনা সেটাই প্রশ্ন।
কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে নানা ইস্যুতে বিতর্কের জেরে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নিয়ে কখনও জোর বিতর্ক, কখনও হতাশা ও সংবিধানের বিভিন্ন ধারা উপধারা নিয়ে মতান্তর ও মনান্তর হয়েছে রাজনৈতিক দল, নীতিপ্রণেতা ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। রাজনীতির রণাঙ্গনে নতুন নতুন দল বিভিন্ন মতাদর্শ নিয়ে আবির্ভুত হতে থাকল। এর গতি তীব্রতর হল ১৯৬৭ সালের পর। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একাধিপত্যের বদলে এই যে নতুন সমীকরণ, সেটা ভারতের রাজনীতির মানচিত্রকে আমূল বদলে দিয়েছে। বর্তমানে ২৯টি রাজ্যের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে আঞ্চলিক দলগুলি ক্ষমতায়। বাকিগুলিতে দু’টি জাতীয় দল -- জাতীয় কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টি, কোথাও একটি, কোথাও বা তাদের সহযোগী দল বা দলসমূহকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় আসীন। বহুকেন্দ্রিক এবং বহুমুখী বৈচিত্র এবং জোট রাজনীতি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যা দেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে প্রায় অকল্পনীয় ছিল।
সে যা-ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো পুনর্বিবেচনা নিয়ে নানা সময়ে বিভিন্ন দিক থেকে চাপ এসেছে। এবং ধারাবাহিক ভাবে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সেগুলি সক্ষেপে পর্যালোচনা করা যাক। ১৯৬৯ সালে তামিলনাড়ুর তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী এম করুণানিধির উৎসাহে ডাঃ পিভি রাজামান্নারের নেতৃত্বে একটি তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। ভারতীয় সংবিধানের বেশ কয়েকটি ধারা পুনর্বিবেচনা করতে এবং কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন সম্পর্কে সুপারিশ করতে বলা হয়। এই কমিটির পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টে ২৪৯, ৩৫৬ ও ৩৫৭ ধারার অবলুপ্তির সুপারিশ করা হয়। কমিটি আরও বলে যে, বেশ কয়েকটি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের সূচি থেকে রাজ্যের সূচিতে হস্তান্তর করা হোক। এর মধ্যে বিশেষত উৎপাদন শুল্ক সম্বন্ধে কেন্দ্রীয় সূচির ৮৪ নম্বর ও ৫২ নম্বর বিষয় রাজ্যের হাতে দিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়।
এর পর ১৯৭৭ সালে পালাবদলের পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে একটি মেমোরান্ডাম বা স্মারকপত্র প্রকাশ করে। এটি এক অর্থে রাজামান্নার কমিটির পদাঙ্ক অনুসরণ করার সামিল। শক্তিশালী রাজ্য সরকারের পক্ষে সওয়াল করে বলা হয় যে, যদি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সম্পর্ক সুনির্দিষ্ট করা হয়, তবে তা কেন্দ্রকে দুর্বল করবে না বা বিভেদকামী শক্তিকেও উৎসাহ দেবে না। শিক্ষাকে রাজ্য সূচি থেকে যৌথ সূচিতে এনে সংবিধান যখন রদবদল করা হয়েছে, তখন রাজ্য সরকারগুলি ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের ফলে শক্তিশালী হলে কেন্দ্র দুর্বল হয়ে পড়বে না, যা দেশের স্বার্থের পরিপন্থী হবে।
পরবর্তীকালে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল বিচারপতি সারকারিয়ার নেতৃত্বে কমিশন গঠন। ১৯৮৮ সালে এই কমিশন কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক বিষয়ে দীর্ঘ রিপোর্ট পেশ করে, যাতে ২৫৬টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ নথিবদ্ধ করা হয়েছে। ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) সরকারের আমলে ২০০২ সালে আর একটি কমিশন গঠন করা হয়। যার নাম ‘সংবিধানের কার্যোপযোগিতা পর্যালোনার্থে গঠিত জাতীয় কমিশন’ (এনসিআরডাবলুসি)। এই কমিশনের রিপোর্টে অর্থ, বাণিজ্য, রাজস্ব, কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ-বিসম্বাদ মেটানোর বিষয় ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কমিশনের মূল বক্তব্য যে, শক্তিশালী কেন্দ্র ও শক্তিশালী রাজ্যের মধ্যে কোনও বিরুদ্ধ সম্পর্ক নেই। সুস্থ শরীরের জন্য শক্তিশালী অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দরকার। ক্ষমতার অতি কেন্দ্রীয়করণ ও অপব্যবহারই মূল সমস্যা। নচেৎ কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক অনেকটা সমগ্র দেহের সঙ্গে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন, সেই রকমই। আবার ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে ইউপিএ-১ পরিচালিত সরকার বিচারপতি এমএম পুঞ্ছির নেতৃত্বে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে সম্পর্ক পর্যালোচনার জন্য কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক সংক্রান্ত এক কমিশন গঠন করে। তিন বছর পর ২০১০ সালে এই কমিশন তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দেয়। আইন প্রণয়ন, শাসন ক্ষমতা ও আর্থিক বিষয়, মূলত কর রাজস্বের বণ্টন ব্যবস্থা ঠিক ঠিক ভাবে কাজ করছে কিনা; ভারতীয় সমাজ ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ও বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সংবিধান উল্লিখিত ব্যবস্থাগুলি ঠিক ভূমিকা পালন করছে কিনা -- এই সব বিষয়ের উপর যথার্থ আলেকপাত করা এই কমিশনের দায়িত্ব ছিল।
২০০৭-এর কেন্দ্র-রাজ্য কমিশন বিষয়গুলি ন’টি ভাগে ভাগ করে ন’টি টাস্ক ফোর্স গঠন করে। যাতে পর্যালোচনা ব্যাপক, বিস্তারিত ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। নটি বিষয় হল :
কমিশন বিভিন্ন রাজ্য সরকারের দ্বারা উত্থাপিত বিষয়, দাবিদাওয়া ও কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্বেগ, আশঙ্কা, দেশের অখণ্ডতা রক্ষা, উগ্রপন্থীদের ধ্বংসাত্মক নীতি ও কার্যকলাপ -- এ সমস্ত নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত আলোচনা করেছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিষয়কে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। সংবাদমাধ্যমে, সংসদে, বিতর্কসভায় সরব আলোচনা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার যখন সিদ্ধান্ত নেয় যে জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র বা এনসিটিসি গঠন করা হবে, তখন বেশ কয়েকটি রাজ্য যথা, বিহার, গুজরাত, হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, ওড়িশা, পঞ্জাব, তামিলনাড়ু ও পশ্চিমবঙ্গ -- ‘আইনশৃঙ্খলা রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত একটি বিষয়, তাই কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত’ -- এই অজুহাতে এর বিরোধিতা করে। পণ্য ও পরিষেবা কর জিএসটি সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়েও কয়েকটি রাজ্য প্রতিবাদে মুখর হয়। অন্ধ্র প্রদেশ ভেঙে নতুন রাজ্য তেলঙ্গানা প্রতিষ্ঠার সময়ও জোরদার বিতর্ক ও প্রতিবাদ শুরু হয়। মূলত রাজ্য আইনসভার সম্মতি ব্যতিরেকে রাজ্য প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রের ক্ষমতা প্রয়োগ -- আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। সংবিধানের ৩ ও ৪ নম্বর অনুচ্ছেদ, যেখানে নতুন রাজ্য গঠন, রাজ্যের কোনও এলাকা ও সীমানার পুনর্বিন্যাস, রাজ্যগুলির নাম পরিবর্তন প্রভৃতি বিষয়ে সংসদকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে ডাঃ বি আর আম্বেদকর প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, অনুচ্ছেদ তিন ও চার দ্বারা প্রদত্ত ক্ষমতা সংবিধানের সাধারণ বৈশিষ্ট্য নয়। এগুলি বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতেই ব্যবহার করা হয় এবং এতদ্বারা কেন্দ্র রাজ্যের ক্ষমতাকে খর্ব করতে পারে।
মনে রাখা প্রয়োজন যে পূর্বে ঝাড়খণ্ড, ছত্তিসগড় ও উত্তরাখণ্ড রাজ্য গঠনের সময় সংশ্লিষ্ট রাজ্য আইনসভার সম্মতি নেওয়া হয়েছিল। এনসিটিসির ক্ষেত্রেও কেন্দ্রের যুক্তি যে, এটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূল সুরের বিরোধী নয়। বস্তুত অনুচ্ছেদ ৩৫৫-তে এই ক্ষমতা নিহিত। যেখানে বলা আছে, “It shall be duty of the union to protect every state against external aggression and internal disturbences and to ensure that the government of every state is carried out in accordance with the provisions of this constitution” অর্থাৎ বিদেশি অগ্রাসন ও বিশৃঙ্খলা থেকে রাজ্যকে রক্ষা করা কেন্দ্রের দায়িত্ব। এনসিটিসির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হল ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বইয়ে পাকিস্তান থেকে আগত জঙ্গিরা যখন নরহত্যা চালিয়েছিল তার পর। বিদেশি আক্রমণের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে এই ব্যবস্থা।
ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এই যে বিবর্তন ধারাবাহিক ভাবে হয়ে চলেছে, তা শুধুমাত্র সম্ভব হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির অভ্যুদয় ও তাদের কর্মধারার জন্য, এমন নয়। বিচারব্যবস্থা, বিশেষ করে শীর্ষ আদালত বা সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রায়ের ফলেও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা প্রভাবিত হচ্ছে। এ সম্পর্কে কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ মামলার রায়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
রাজস্থান রাজ্য বনাম ভারত সরকার মামলায় (১৯৭৭) কোঅপারেটিভ ফেডারেলিজম বা সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি বেগ এই সম্পর্কে বলতে গিয়ে সংবিধানকে ‘উভচর’ বলেছেন। “It can move either in the federal, or on unitary plane, according to the needs of the situation and circumstances of a case.’ অর্থাৎ পরিস্থিতির প্রয়োজনে কখনও যুক্তরাষ্ট্রীয় আবার সময়ে সময়ে এককেন্দ্রিকতার স্তরে কাজ করার ক্ষমতাও এ সংবিধানে রয়েছে। এস আর বোম্মাই বনাম ভারত সরকার মামলার রায় যুগান্তকারী (১৯৯৪)। এতে ৩৫৬ অনুচ্ছেদের যথেচ্ছ ব্যবহার সীমিত করে দেওয়া হয়। কেউ কেউ বলেন ওই রায় ৩৫৬ অনুচ্ছেদটিকে প্রায়-মৃত ঘোষণা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ভারতে যে রকম সাফল্য পেয়েছ পৃথিবীর কোথাও সে রকম হয়নি। বিশেষ করে পশ্চিমের বহু দেশে আগে থেকে ব্যবস্থা চালু হলেও তা ইতিহাসের অনিবার্য নিয়মে ভেঙে গিয়েছে।
বিচারপতি আহমদি সংবিধান সম্পর্কে pragmatic federalism শব্দ দু’টি ব্যবহার করেছেন। তাঁর রায়ে বলা হয়েছে, “It would thus seem that the Indian constitution has in it not only features of a pragmatic federalism, which, while distributing legislative power and indicating the spheres of governmental powers of state and central governments is overlaid by strong unitary features.” অর্থাৎ এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই একটি এককেন্দ্রিকতার সুর স্পষ্ট।
হরিয়ানা বনাম পঞ্জাব মামলায় বিচারপতিরা সেমি ফেডেরাল বা আধা-যুক্তরাষ্ট্রীয় শব্দ ব্যবহার করেছেন। অপর একটি মামলা -- শামসের সিং বনাম পঞ্জাব রাজ্য --তার রায়ে সংবিধানকে বলা হয়েছে ‘more unitary than federal’ অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত এককেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। স্মরণ করা যেতে পারে যে সংবিধান প্রণয়ন-সভাতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ১৯৪৬-এর ১৩ ডিসেম্বর তাঁর ভাষণে স্পষ্ট করেছিলেন যে, কেন্দ্রে সরকারের প্রশাসনযন্ত্র ও কর্মপদ্ধতির মধ্যে সুসংহত ও একমুখীন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। রাজ্যগুলির মধ্যে সহযোগিতা ও পরামর্শের মধ্যে এটি সম্ভব। স্বাধীন সার্বভৌম ভারতের এবং রাজ্যগুলির সরকার ও সরকারের সমস্ত অঙ্গের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের উৎস জনগণ। অভিজ্ঞতায় দেখা গিয়েছে যে, সাম্প্রদায়িকতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, ভাষার ক্ষেত্রে উগ্রবাদ যখন বেশি মাত্রায় সক্রিয় থাকে, তখন এককেন্দ্রিকতার দিকে ঝোঁক রাষ্ট্র্ব্যবস্থার পক্ষে নিঃসন্দেহে আশীর্বাদস্বরূপ।
পণ্ডিত নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় উদ্দেশ্য ছিল শাসনব্যবস্থার সহযোগিতামূলক আবহের মধ্যে কাজ করার মানসিকতা তৈরি করা। তাঁর সময়ে যোজনা কমিশন, জাতীয় উন্নয়ন পরিষদ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রান্ট, যা যোজনা কমিশন দ্বারা অনুমোদিত তার প্রায় শতকরা সত্তর ভাগ, আর বাকি বিশ ভাগ দেওয়া হয় অর্থ কমিশনের মাধ্যমে। অর্থ কমিশন ধারা ২৮০-র মাধ্যমে রাজস্ব বণ্টন করে। বর্তমানে যোজনা কমিশন নীতি আয়োগে রূপান্তরিত হয়েছে।
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা রাজনৈতিক শক্তির বিবর্তন প্রভাব ফেলেছে। ১৯৯০-এর দশকে গ্রহণ করা হয় আর্থিক উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের নীতি। বিভিন্ন রাজ্য সরকার এর সুযোগ নিতে চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের আগ্রহ নিয়ে দেশের সীমা পেরিয়ে নানা আন্তজার্তিক সংস্থার সঙ্গেও বহুমাত্রিক চুক্তি সম্পাদন করছে। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্যের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে এই সব প্রচেষ্টা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এর আগে জাতীয় ফ্রন্ট সরকারের আমলে ১৯৮৯ সালে জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদ (এনডিসির) পুনরুজ্জীবন হয়। সেই সময়ের সরকারের মতে, এর ফলে অতিকেন্দ্রীকরণ নীতির পরিবর্তে প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় ভঙ্গিতে চলার নীতি নেওয়া হল। ১৯৮৯ সালে এনডিসির দু’টি সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুমোদনের পূর্বে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সামনে এই সম্মেলনে যোজনা কমিশনের দ্বারা পরিকল্পনার খুঁটিনাটি নিয়ে বিশদ বিবরণ পেশ করা হয়। উদ্দেশ্য, কেন্দ্র-রাজ্য অংশীদারিত্ব সুনিশ্চিত করা।
এই সঙ্গে আরও একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল -- আন্তঃরাজ্য কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠা। এটাও হল কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে নতুন ফোরাম তৈরি করার জন্য। ১৯৯০-এর আগস্ট মাসে এর প্রথম বৈঠক বসে। ওই বৈঠকে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক, এমনকী সরকারি কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশ নিয়েও আলোচনা হয়।
এর পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হল। ১৯৯১ সালে সাধারণ নির্বাচনের পর নরসিংহ রাওয়ের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। তিনি জাতীয় উন্নয়ন পরিষদ ও আন্তঃরাজ্য পরিষদ -- এই দুই সংস্থাকে সাম্প্রদায়িকতা, সুষম উন্নয়ন প্রভৃতির মতো বিভিন্ন জটিল সমস্যার ব্যাপারে আলোচনার ফোরাম হিসাবে ব্যবহার করেছেন। রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে মত বিনিময়ের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ১৯৯২ সালে ৭৩ এবং ৭৪ নম্বর সংবিধান সংশোধনী বিল সংসদে পেশ করা হয়। এর মাধ্যমে দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বিকেন্দ্রীকৃত ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পথ সুগম হয়েছে। ভারতের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের ক্ষমতায়নের পথে এটি একটি নিশ্চিত পদক্ষেপ। পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক সহ বিভিন্ন রাজ্যে এটির সফল রূপায়ণ হতে থাকে।
এস আর বোম্মাই বনাম ভারত সরকার মামলায় নয় বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত বেঞ্চের রায়ের কথা বলা হয়েছে। এটি কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী রায়। মূল রায়টি ৩৫৬ ধারা নিয়ে, যাতে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার সংস্থান রয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টি কোনও ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি বা মত নয়। যে তথ্য বা ঘটনা তাঁর সামনে রাজ্য সম্পর্কে পেশ করা হচ্ছে, তা থেকে যেন একটি ন্যায়সঙ্গত অনুমানে বা সিদ্ধান্তে আসা যায় এবং তা বিচারযোগ্য হওয়া চাই। তথ্যনির্ভর বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হতে হবে এবং এতে যেন ক্ষমতার অপপ্রয়োগ না হয়। যখন সংবিধানসম্মত ভাবে শাসনব্যবস্থা চলছে না বা সংবিধান ভেঙে পড়েছে তখনই ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করা যেতে পারে কেবলমাত্র সাংবিধানিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। তার অতিরিক্ত কোনও উদ্দেশ্যে নয়। মন্ত্রিসভার দেওয়া পরামর্শের ভিত্তি ও তৎসংশ্লিষ্ট ঘটনাকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ৭৪(২) ধারায় দেওয়া আছে। এই রায় কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এক আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে।
ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। এ প্রসঙ্গে ১৯৯৬ সালে হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে বৈঠকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁরা একযোগে ‘ফেডারেশন উইদাউট এ সেন্টার’-এর ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকার গঠনের পরে তাঁরা সকলে ভেবেছিলেন যে, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। যার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার যেন প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ১৯৯৫-এ এনডিএ সরকার কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে নতুন আবহ তৈরি করে। ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় ও উত্তরাখণ্ড রাজ্য গঠিত হল। আঞ্চলিক জাতিগত ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার অনুরূপ সেই ধাঁচা।
একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চমকপ্রদ অগ্রগতি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিকাঠামো ও বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের প্রসার, সর্বোপরি ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু হওয়া প্রভৃতি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ব্যপক প্রভাব বিস্তার করেছে।
ভারতের ঈশান কোণের রাজ্যগুলিতে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, পরিচিতিবোধ থেকে উদ্ভূত নানা আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, রাজনৈতিক ও স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বা সম্পর্কিত দাবিদাওয়াকে সংবিধানের কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করে সমাধান করার দৃষ্টান্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাফল্যই সূচিত করে। সমগ্র পূর্বোত্তর অঞ্চল কালক্রমে ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের মর্যাদা পায়। নাগাল্যান্ড অবশ্য আগেই স্বতন্ত্র রাজ্যে পরিণত হয়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পর্ষদ আইন ১৯৭১-এর বলে পূর্বোত্তর পরিষদ শিলংয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে সিকিম রাজ্যও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, তার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন ও রূপায়ণের মাধ্যম হিসাবে এই সংস্থা কাজ করে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে এই পূর্বোত্তর রাজ্যগুলি --- অসম, মেঘালয়, নাগ্যল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মণিপুর এবং সিকিম যাতে আর্থিক ও সামাজিক প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে পারে, সে জন্য কতকগুলি বিশেষ কার্যক্রম নেওয়া হয়। তার মধ্যে একটি -- বিভিন্ন কেন্দ্রীয় মন্ত্রক ও বিভাগের বাজেটের অন্তত দশ শতাংশ পূর্বোত্তর রাজ্যগুলির উন্নয়নের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা। ১৯৯৬ সালে অক্টোবর মাসে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী এই ঘোষণা করেছিলেন।
আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ হল এই রাজ্যগুলির জন্য একটি অ-তামাদি কেন্দ্রীয় সম্পদ তহবিল তৈরি করা। এই খাতে নির্দিষ্ট করা অর্থ বিশেষ আর্থিক বছর শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তামাদি হয়ে যায় না। এই তহবিলে রক্ষিত অর্থ দ্বারা বিভিন্ন পরিকাঠামোগত, সামাজিক, উন্নয়নমূলক প্রকল্প রূপায়ণ হবে। এর মধ্যে রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ, সড়ক ও সেতু নির্মাণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জল সরবরাহ, স্বচ্ছতা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কিত নানা প্রকল্প। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, “My government has also created a pool of nonlapsable funds for the North-East and Sikkim. This pool meant for funding development projects in these states will fill the resource gap in creation of new infrastructure, which is a top priority concern of the union government.” কেন্দ্র, রাজ্য ও ত্রিস্তর স্থানীয় সরকারের মধ্যে মসৃণ সম্পর্কই ভারতের জাতীয়তা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মূল কথা।
সূত্র : যোজনা, ফেব্রুয়ারি ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 3/29/2020
নবগঠিত বিধাননগর পুরনিগমের নিজস্ব আয় বাড়িয়ে স্বনির্...