উত্তরবঙ্গের ন’টি সংগঠিত চা-বাগান: রেড ব্যাঙ্ক, সুরেন্দ্রনগর, ধরণীপুর, ঢেকলাপাড়া, বান্দাপানি, মধু, রহিমাবাদ, পটকাপাড়া, রায়পুর বেশ কিছু দিন ধরে বন্ধ, রুগ্ন, নয় অনিয়মিত ভাবে চালু। এর মধ্যে ঢেকলাপাড়া বন্ধ বিগত বারো বছর। চা-শ্রমিকরা প্রভিডেন্ড ফান্ড, গ্র্যাচুইটি বাবদ তাদের ন্যায্য প্রাপ্য পাননি। অনাহারে মৃত্যু ঘটে চলেছে শ্রমিক পরিবারে। গত ছ’মাসে রায়পুরে মৃত ছয়, বান্দাপানিতে ২২, রেড ব্যাঙ্ক গ্রুপে মোট ৪৬। গত চার বছরে ঢেকলাপাড়াতে মৃতের সংখ্যা ৩৯। এই শ্রমিকদের অধিকাংশই আদিবাসী, যাদের পূর্বপুরুষকে ব্রিটিশ রাজত্বে লাগানো হয়েছিল বন সাফ করে চা-বাগান বানানোর কাজে।
চালু ব্যবস্থায়, ডুয়ার্স-তরাই অঞ্চলে চা-শ্রমিকের দিনমজুরি ৯৫ টাকা, দার্জিলিঙে ৯০ টাকা। টি প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট (১৯৫১) অনুযায়ী, মজুরি ছাড়াও আনুষঙ্গিক সুবিধা হিসেবে প্রত্যেকের প্রাপ্য ভর্তুকির রেশন, নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্বালানি কাঠ, বিনামূল্যে আবাসন, পানীয় জলের জোগান, চিকিৎসা-সুবিধা। অনূর্ধ্ব ১২ বছরের সন্তানদের জন্য প্রাইমারি স্কুলের বন্দোবস্ত। বাগানে দৈনন্দিন কাজ করার জন্য প্রত্যেকের ৭২ গজ থান কাপড় পাওয়ার কথা। কিন্তু রাজ্যের বেশির ভাগ চা-বাগানে এই সব সুবিধা নেই।
মালিকপক্ষ বলেন, তাঁরা আনুষঙ্গিক সুবিধা হিসেবে যা দেন, টাকার অঙ্কে তার মূল্য শ্রমিক পিছু ৬৭ টাকা, অর্থাৎ ডুয়ার্স-তরাইয়ের চা-শ্রমিকের আসল দিনমজুরি ধরতে হবে মোট ১৬২ টাকা। কিন্তু আসলে এই আনুষঙ্গিক সুবিধার মূল্য ৩৪ টাকা। যখন কৃষিশ্রমিকদের ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি ২১৬ টাকা, শিল্প-শ্রমিকদের দিনমজুরি এর থেকে বেশি হওয়া প্রয়োজন। সরকারি হিসাব এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী এই দিনমজুরি হওয়া উচিত ৩২৪ টাকা, যা ওই ১৬২ টাকার দ্বিগুন।
অনতি অতীতে ডুয়ার্স-তরাই-পাহাড়ের আঞ্চলিক লেবার কমিশনার দফতর থেকে এলাকার ২৭৬টি চা-বাগানের ২৭৩টি-তে এক সমীক্ষা চালানো হয়। ১০ মে ২০১৩ প্রকাশিত সমীক্ষাপত্রে পাওয়া গেল অন্তত ১০টি বঞ্চনার ছবি। এক, আড়াই লক্ষেরও বেশি শ্রমিকের মধ্যে এখনও ৯৫,৮৩৫ জন ঘর পায়নি। দুই, প্রায় ত্রিশ হাজার বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। তিন, মাত্র ৬১টি চা-বাগানে পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। চার, চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে মাত্র ১০৭টি চা-বাগানে। পাঁচ, ১৭৫টি চা-বাগানে কোনও লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই। ছয়, ক্যান্টিন নেই ১২৫টি বাগানে। সাত, স্কুল নেই ৪২টি চা-বাগান মহল্লায়। আট, ১৮টি চা-বাগান শ্রমিকদের প্রাপ্য প্রভিডেন্ট ফান্ড খাতে টাকা জমা দেয়নি। নয়, ৪৬টি বাগান এক পয়সাও গ্র্যাচুইটি দেয়নি শ্রমিকদের। দশ, কোনও রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেখাতে বা জমা দিতে পারেনি ৮৭টি চা-বাগান।
এমন বঞ্চনা যেখানে, অনাহার-অপুষ্টিজনিত মৃত্যু হবেই। শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হবেই। হচ্ছেও। কলকাতাবাসীদের কাছে ওই মৃত্যু এবং প্রতিবাদ দুই-ই যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে। চুপচাপ অনাহারে মারা যাওয়া অচেনা, নামগোত্রহীন আদিবাসীদের জন্য আমাদের সহানুভূতি কতটাই বা জেগে ওঠে? কিন্তু, কখনও দিনের পর দিন অনাহারে চোখের সামনে বউ-বাচ্চাকে মারা যেতে দেখে, নারীপাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে পরিবারের মেয়েদের নিখোঁজ হতে দেখে (ইউনিসেফ-এর রিপোর্টে দেখছি, ২০১০-এ রেড ব্যাঙ্ক গ্রুপের এক চা-বাগান থেকে নিখোঁজ তিনশোর বেশি নারী), তারা খেপে উঠে যদি কোনও বাগান-ম্যানেজারকে পিটিয়ে মেরে দেয়, তখন আমাদের যাবতীয় বিবেক জেগে উঠে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রতিবাদ করতে। সংবাদমাধ্যমে বয়ে যায় সহানুভূতির বন্যা। হিংসা মানে কি শুধু দৈহিক নিগ্রহ, রক্তপাত? লাগাতার বঞ্চনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ছিন্নভিন্ন করা, অনাহারে মেরে ফেলা হিংসা নয়?
দার্জিলিং-জলপাইগুড়ির পাঁচটি সংগঠন— শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন, জলপাইগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন, ডুয়ার্স জাগরণ, ফোরাম ফর পিপলস হেল্থ আর সৃজন— ডাঃ বিনায়ক সেন আর তাঁর পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ-এর সহযোগে অনাহার-অপুষ্টি পীড়িত চা-বাগানে সমীক্ষার কাজ হাতে নেয়। অপুষ্টি-অনাহারের কবলে রয়েছে কি কোনও জনগোষ্ঠী? তারা কি দুর্ভিক্ষের কবলে? এটা বোঝার জন্য মান্যসূচক হল বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই)। এই সংখ্যা যদি ১৮.৫-এর নীচে হয়, বুঝতে হবে তার ওজন স্বাভাবিকের কম— সে অনাহার, অপুষ্টিতে আছে। কোনও জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের বিএমআই ১৮.৫-এর তলায় থাকলে, ডব্লুএইচও-র সংজ্ঞা অনুযায়ী, সেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। এই তত্ত্বের নির্ভরে প্রথম সমীক্ষা হয়েছিল জুলাই ২০১৪-তে রায়পুর চা-বাগানে। ২০১২ থেকে রায়পুর বন্ধ। সমীক্ষকরা যাওয়ার আগে মারা গিয়েছিলেন ৬ জন চা-শ্রমিক। সরকারি মহল থেকে বলা হয়েছিল, কেউ অনাহারে মারা যায়নি। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী যাকে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি বলে, তা-ই বিরাজমান ওই বাগানে।
তার পরে আবার বিগত কয়েক মাস ধরে চালানো হয় তুলনায় বড় সমীক্ষার কাজ। সংগঠনগুলি উত্তরবঙ্গের রেড ব্যাঙ্ক, বান্দাপানি, ডায়না, কাঁঠালগুড়ি, ঢেকলাপাড়া এবং রায়পুর চা-বাগানে অনুসন্ধান চালায়। ওই সব বাগান থেকেই মৃত্যুর খবর আসছিল। সমীক্ষায় দেখা গেল, যা ভাবা গিয়েছিল, বাস্তব অবস্থা তার থেকে অনেক খারাপ। খাবার নেই, বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। কেউ কেউ নদীর বুকের পাথর ভেঙে খুবই সামান্য রোজগার করেন। তা দিয়ে খাওয়া চলে না। অতএব, অপুষ্টি, অনাহার।
এই ফেব্রুয়ারি মাসে সমীক্ষায় পাওয়া কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গেল। বন্ধ থাকা রায়পুর চা-বাগানে ১২৭২ জনের বিএমআই পরীক্ষায় দেখা যায়, ৫৩৯ জনের (অর্থাৎ পরীক্ষিত গোষ্ঠীর ৪২ শতাংশ) ক্ষেত্রে তা ১৮.৫-এর কম। অতএব, এঁরা দুর্ভিক্ষপীড়িত। কোনও সন্দেহ নেই, এঁরা অনাহারে মারা যাচ্ছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিএমআই যাদের ১৭ এবং ১৬, তাদের মারা যাওয়ার হার ১৮.৫-এর তুলনায় যথাক্রমে দেড় গুণ, দু’গুণ বেশি। রায়পুর চা-বাগানে পরীক্ষিতদের মধ্যে ৩৮৪ জনের (অর্থাৎ পরীক্ষিত গোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ) বিএমআই ১৭, ২৮৫ জনের (২২ শতাংশ) ১৬-র নীচে, আর ১৪০ জনের (১১ শতাংশ) ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১৪-র কম। অন্যান্য সব বন্ধ চা-বাগানের অবস্থা কমবেশি একই রকম।
চা-শ্রমিকদের দুর্দশার খবর জোগাড় এবং তা যুক্তির নির্ভরে বৃহত্তর জনসমাজে ছড়িয়ে দিয়ে তাঁদের পাশে টেনে নিতে, দার্জিলিং-জলপাইগুড়ির বন্যাত্রাণ করা হিতবাদী সংগঠনের সঙ্গে জুড়ে গেছে মানুষের অধিকার নিয়ে লড়তে থাকা সংগঠন, স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে মাথা ঘামানো মানুষ। জনজাতির ভালোমন্দ নিয়ে কাজ করে যাওয়া কয়েক জনের সঙ্গে এসে গেছে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংগঠনও।
কলকাতার নাগরিক সমাজও যত দ্রুত শিখে নেয় এই নতুন পথ, পাথুরে প্রমাণ হাতে কুযুক্তি প্রতিহত করবার বিজ্ঞান, ততই মঙ্গল। কান পাতলেই শোনা যায়, শহরের তেতে-পুড়ে থাকা মানুষ বিরক্ত গলায় সব পরিচিত রঙের ভোটপার্টির উদ্দেশে বলছেন— ‘সব দল সমান’ অথবা ‘যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ’।
অর্থাৎ, মানুষই চাইছে নতুন পথ। অচেনা পথ।
দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী যোজনার অর্ধেক সময় কেটে গিয়েছে। তবু বেটার লেট দ্যান নেভার। অবশেষে চা শিল্পের জন্য টি বোর্ডের অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব মঞ্জুর করল কেন্দ্র। বরাদ্দের অঙ্ক ১৪২৫ কোটি টাকা। একাদশ পরিকল্পনার তুলনায় যা দেড় গুণেরও বেশি। এর মধ্যে ক্ষুদ্র চা চাষিদের উন্নয়ন ও চা ব্যবসায় অনলাইন লেনদেনের পরিকাঠামো নির্মাণের মতো ক্ষেত্রে বরাদ্দ এই প্রথম। সরকারি সূত্রের খবর, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অর্থনীতি বিষয়ক কমিটি তার বৈঠকে টি বোর্ডের প্রস্তাবে ছাড়পত্র দিয়েছে। ক্ষুদ্র চা চাষিদের সংগঠন সিস্টা-র সভাপতি বিজয়গোপাল চক্রবর্তী বলেন, “ক্ষুদ্র চাষিদের জন্য এই প্রথম পৃথক ভাবে অর্থ বরাদ্দ করা হল। এই আর্থিক সহায়তা তাঁদের উন্নয়নে সাহায্য করবে।” উল্লেখ্য, এত দিন বোর্ড সাময়িক ভাবে তাঁদের কিছু আর্থিক সহায়তা দিলেও এ বারের প্রস্তাবে তার অভিমুখ আরও নির্দিষ্ট করা হয়েছে ও তা সম্প্রসারিতও হয়েছে। বরাদ্দ হওয়া ১৪২৫ কোটি টাকা যে যে খাতে ভাগ করা হয়েছে, তা এ রকম- চা গাছের চাষ ও উন্নয়নে ৪০০ কোটি, অর্থোডক্স ও অন্যান্য চা উৎপাদন ও মানোন্নয়নে ৩০০ কোটি, বিপণন খাতে উৎসাহ দিতে ২০০ কোটি, বিপণন ব্যবস্থা (বৈদ্যুতিক নিলাম ও অনলাইনে লাইসেন্স) ২৫ কোটি, ক্ষুদ্র চা চাষিদের উন্নতিতে ২০০ কোটি, গবেষণায় ১৫০ কোটি ও মানব সম্পদ উন্নয়নে ১০০ কোটি টাকা। এ ছাড়াও বাকি ক্ষেত্রে অনুদান বা ভর্তুকির অঙ্কও এ বারে অনেকটা করেই বাড়বে বলে জানা গিয়েছে।
রুগণ চা-বাগানের শ্রমিকদের জীবন রক্ষায় পৃথক তহবিল গড়ে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু প্রকৃতির যা খামখেয়ালিপনা শুরু হয়েছে, তাতে চলতি মরসুমে আরও কিছু চা বাগান রুগণ হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টির স্বল্পতায় ইতিমধ্যেই চা উত্পাদনে ঘাটতি হয়েছে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ। তার প্রভাব সার্বিক ভাবে শিল্পে পড়বে বলে মনে করছেন চা-বাগানের মালিকরা। এমনকী, নয়ের দশকের সঙ্কটের মতো পরিস্থিতি আবার তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। আটের দশকে চা শিল্পে স্বর্ণযুগের পরের দশ বছরেই চা শিল্পে ভয়াবহ মন্দা দেখা দেয়। তখন থেকেই লকআউট হতে থাকে একের পর এক বাগান। লকআউট ঘোষণা না করলেও বেশ কিছু বাগান পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন মালিকরা।
সেই পরিস্থিতি থেকে সদ্য ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল চা শিল্প। তখনই নামছে প্রকৃতির রোষ। চা আবাদে প্রথম কুঁড়ি আসার সময়ই বৃষ্টির অভাব দেখা দিয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে এই প্রথম কুঁড়ির চায়ের চাহিদা যেমন বেশি, তেমনই তার দামও চড়া থাকে। এর দিকে তাকিয়ে থাকেন চা বাগান মালিকরা। এর জন্য দরকার শীতকালীন বৃষ্টির। অথচ চলতি মরসুমে জানুয়ারিতে মাত্র ১৯.৩০ মিমির পর গোটা ফেব্রুয়ারিতে কোনও বৃষ্টিই হয়নি। মার্চেও সারা মাস খরা চলার পর একেবারে শেষ সন্তাহে প্রায় ৬০ মিমি বৃষ্টি হয়েছে, যা চায়ের ভালো আবাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। ডুয়ার্সের নিউল্যান্ডস চা বাগানে প্রায় তিন দশক ম্যানেজারের কাজ করছেন ম্যাথু ফিলিপ। চা চাষ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ফিলিপ বলেন, ‘মনেই পড়ে না, এর আগে এমন আবহাওয়া আগে দেখেছি কি না। পরিস্থিতি সত্যিই কপালে ভাঁজ পড়ার মতো। এমন অবস্থা চলতে থাকলে উত্পাদনে ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে না।’ কৃত্রিম জলসেচ দিয়েও এই পরিস্থিতির মোকাবিলা সম্ভব নয় বলে জানাচ্ছেন চা শিল্পপতিরা। দিনে চড়চড় করে বাড়ছে তাপমাত্রা। কখনও কখনও তা ৩৬ ডিগ্রিতে পৌঁছচ্ছে।কিন্তু রাত বাড়লেই সেই তাপমাত্রা নেমে যাচ্ছে ১৮ থেকে ২০ ডিগ্রিতে। এমন আবহাওয়া বৃষ্টির অনুকূল নয় বলে মনে করেন বাগানের প্রবীণ শ্রমিকরাও। কাদম্বিনী চা বাগানের শ্রমিক চারোয়া লাকড়া বলেন, ‘আকাশে মেঘ হচ্ছে বটে, তা জল ঝরানোর নয়। চার দিক শুকিয়ে গিয়েছে। বাতাসেও শুকনো টান। এমন হাওয়ায় ভালো চা হতেই পারে না। আবার বোধহয় আমাদের ঘোর বিপদ আসতে চলেছে।’ কৃত্রিম জলসেচ করলেও বাতাসে আর্দ্রতা ৬০ শতাংশের কম থাকায় চা পাতায় জল পড়তেই শুকিয়ে যাচ্ছে। নিউল্যান্ডস চা বাগানের ম্যানেজার ফিলিপ বলেন, ‘আমার ৬০০ হেক্টরের চা বাগানে দশ রাউন্ড জলসেচ করিয়েছি। তাতে আশি লক্ষের বেশি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু উত্পাদন বাড়ছে না। আমার বাগানে ঘাটতির পরিমাণ ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ’এর পর বৃষ্টি নামলেও এই ঘাটতি মেটানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন চা বাগান মালিকরা। তা ছাড়া কৃত্রিম জলসেচে উত্পাদিত পাতা থেকে তৈরি চায়ের গুণমানও ভালো হচ্ছে না। ফলে বাজারে দামও ভালো পাওয়া যাবে না। ইতিমধ্যে বাজার পড়তে শুরু করেছে বলে ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আলিপুরদুয়ারের কাছে মাঝেরডাবরি চা বাগানের ম্যানেজার তাপস বাগচি বলেন, ‘পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে চোখের সামনে।’ পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক বর্ণনা করে ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা অমিতাংশু চক্রবর্তী বলেন, ‘এ বছরই চা শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। তাতে এক দিকে আমাদের উপর যখন খরচের বোঝা চেপে বসেছে, তখন প্রকৃতির রোষে পড়ে বিপন্ন চা শিল্পই। চা উত্পাদনে ভয়ঙ্কর দুর্দিন নেমে আসছে।’ ২০০৯ থেকেই মরসুমের প্রথমে বৃষ্টির পরিমাণ কমতে আরম্ভ করেছিল। মাঝে ২০১২-তে পরিস্থিতির সামান্য উন্নতি হলেও এ বছর তা চরমে পৌঁছেছে।
রাজনীতির নয়, অন্য স্বাদের চায়ে পে চর্চার আসরে মাততে চলেছে কলকাতা। চা বাগানের মাঝে রাজকীয় বাংলোয় বসে ধোঁয়া ওঠা চায়ের স্বাদ নিয়ে তর্কে তুফান তোলার প্রেক্ষাপটটাও প্রায় তৈরি। অবাক লাগলেও সত্যি। নিউ টাউনের ইকো পার্কে ৩ একর জায়গা জুড়ে তৈরি হচ্ছে আস্ত একটা চা বাগান। শুধু চা বাগানই নয়, সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে একটি বাংলোও। সেই বাংলোর টি-লাউঞ্জে মিলবে নানা ব্র্যান্ডের চায়ের স্বাদ। প্রশ্ন উঠতে পারে পাহাড়, নিদেনপক্ষে মালভূমি এলাকায় না হয়ে দক্ষিণবঙ্গের সমতলেও কি চা বাগান তৈরি করা সম্ভব ? অসম্ভব কেন হবে! সমতলে বাগান তৈরির কাজ চালাচ্ছে খ্যাতনামা চা উত্পাদনকারী সংস্থা অ্যান্ড্রূ ইউল। পরীক্ষামূলক ভাবে যে কাজ আগে করেছে খড়গপুর আইআইটি কিংবা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। অ্যান্ড্রূ ইউলের সঙ্গে সহযোগিতায় তা বাস্তবায়িত করছে হিডকো।
তাদের ডুয়ার্সের চা বাগান থেকে সমতলের এই বাগানের জন্য চা গাছ এনেছে অ্যান্ড্রূ ইউল। আনা হয়েছে চা চাষের পক্ষে উপযুক্ত মাটিও। তবে তাতেও রয়েছে সমস্যা। কারণ, চা চাষের জন্য উপযুক্ত আবহাওয়া, দিনে সূর্যের আলো, রাতে বৃষ্টি। ঢালু জমিই চা চাষের পক্ষে আদর্শ। তবে নিউ টাউনের মাটিতেও চা উত্পাদন সম্ভব বলেই মনে করছেন অ্যান্ড্রূ ইউলের আধিকারিকরা। হিডেকোর চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন জানান, সেই চা বাগানে গড়ে তোলা হচ্ছে একটি টি-লাউঞ্জ। যা হবে একটি চা বাগানের বাংলোর আদলে। বাংলোর নকশা তৈরি করেছেন বিশিষ্ট আর্কিটেক্ট দুলাল মুখোপাধ্যায়। তিন দিক কাচে ঘেরা সেই বাংলোয় বসে আগ্রহী সকলেই পান করতে পারবেন নানা স্বাদের চা। দেবাশিসবাবু আরও জানালেন, কফি নিয়ে যথেষ্ট চর্চা হচ্ছে কলকাতায়। চা নিয়ে বরং সে তুলনায় চর্চা অনেক কম। সেই আগ্রহ বাড়াতেই এই উদ্যোগ বলে জানান দেবাশিসবাবু। অ্যান্ড্রূ ইউলের চেয়ারম্যান কল্লোল দত্ত জানান, কলকাতার পরিবেশে চায়ের গাছগুলি বাঁচিয়ে রাখাই যথেষ্ট কঠিন। এ জন্য উপযুক্ত জলসেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বছরখানেক আগেই সেখানে রোপণ করা হয়েছে চায়ের চারাগুলি। এই গরমকালটা গেলে বোঝা যাবে সেগুলির বৃদ্ধি কেমন হচ্ছে। জানা গিয়েছে, এখন প্রায় ফুটখানেক উচ্চতা হয়েছে চা গাছগুলির। চা বাগানের রূপ পেতে সময় লাগবে আরও অন্তত এক বছর। যদিও একটি চা গাছের ঝোপ পুরোপুরি তৈরি হতে সময় প্রয়োজন প্রায় পাঁচ বছর।
কল্লোলবাবু জানান, লাউঞ্জে বসে শুধু যে হরেক রকম চা পানের সুযোগই মিলবে তা-ই নয়, চা বাগান, চা শিল্প সংক্রান্ত প্রদর্শনী থাকবে। চা বাগানের উপর নানা ভিডিয়ো ক্লিপিংসও দেখানোর ব্যবস্থাও থাকবে। কেউ আগ্রহী হলে তা নিজেই চালিয়ে দেখে নিতে পারবেন। এ ছাড়াও চা পাতা তোলা, চা পাতার প্রসেসিং কী ভাবে হয়, সে সম্পর্কে আগ্রহীদের জন্য থাকবে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। পাশাপাশি টি টেস্টিং কী ভাবে করা হয়, সে সম্পর্কেও হাতে-কলমে অভিজ্ঞতার সুযোগ মিলবে সেখানে। দেবাশিসবাবু জানিয়েছেন, দার্জিলিং চায়ের খ্যাতি সারা বিশ্বেই। ডুয়ার্সেও ভালো পরিমাণ চা হয়। নিখাদ দার্জিলিং চায়ের গন্ধ আর স্বাদই এখন শহরবাসীর কাছে তুলে ধরতে এক খণ্ড দার্জিলিং গড়ে তুলতে চাইছে হিডকো। আর সেই লক্ষ্যে এই টি-লাউঞ্জটি গড়ে তোলা হচ্ছে।
চা গাছে ক্ষতিকারক কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলিতে নজরদারি চালাবে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি দফতর। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে চা গাছে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে সাম্প্রতিক কালে নানা মহল থেকে অভিযোগ ওঠার কারণেই এই উদ্যোগ। তাদের অভিযোগ, হয় গাছে অননুমোদিত বা ক্ষতিকারক কীটনাশক ব্যবহার করা হয় বা অনুমোদিত কীটনাশক সহায়ক মাত্রার থেকে বেশি ব্যবহার করা হয়।
চায়ে ক্ষতিকারক কীটনাশকের উপস্থিতি মিললে দেশীয় বাজারেই নয়, স্বাস্থ্যহানির কারণে রফতানি বাজারেও নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়বে ভারতীয় চা। এর আগেও ইউরোপ, পশ্চিম এশিয়ার বাজারে এ নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিল ভারতীয় চা।
চা উৎপাদনের বিষয়টি এখন আর শুধু বড় বা সংগঠিত চা বাগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রায় ৩৫ শতাংশ চা তৈরি করেন ক্ষুদ্র চাষিরা। তাদের কাছ থেকে অনেক বটলিফ কারখানা যেমন চা পাতা কেনে, তেমনই বড় বাগানও পাতা কেনে চা তৈরির জন্য। ফলে বড় বাগান যদি কীটনাশক ঠিকমতো ব্যবহার করেও, ক্ষুদ্র চা চাষিরা নিয়ম মেনে না চললে বাগানের পাতায় কীটনাশক থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা এড়ানো যায় না।
যে কোনও চাষের মতোই ক্ষতিকারক পোকার হাত থেকে চা গাছ বাঁচাতে কীটনাশকের ব্যবহার স্বাভাবিক। সব চাষের ক্ষেত্রেই কোন কীটনাশক কতটা ব্যবহার করা যাবে, তার বৈজ্ঞানিক মাপকাঠি রয়েছে। চা গাছের ক্ষেত্রেও কীটনাশক ও তার ব্যবহারের মাত্রা নির্দিষ্ট। এ জন্য সরকার ও চা শিল্প যৌথ ভাবে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে পৃথক ভাবে গবেষণা চালায়। পাশাপাশি কেন্দ্রেরও নির্দেশিকা রয়েছে। গবেষণা ও সেই নির্দেশিকা মেনেই নানা পোকামাকড়, ছত্রাক, আগাছা ইত্যাদি মারার জন্য ৩৭টি কীটনাশকের ব্যবহার অনুমোদন করেছে সেন্ট্রাল ইন্সক্টিসাইড বোর্ড। কী ভাবে, কতটা মাত্রায় সেগুলির ব্যবহার গাছের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়, চা শিল্পের গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে যৌথ ভাবে তা নির্দিষ্ট করেছে টি বোর্ড।
অনুমোদিত কীটনাশক ও তার ব্যবহার বিধি কার্যকর হয়েছে ২০১৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে। কিন্তু বিভিন্ন স্তরে এ নিয়ে এখনও সচেতনতার অভাব রয়েছে। তাই কর্মশালা ও সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করছে টি বোর্ড। পাশাপাশি নজরদারির জন্য কৃষি দফতরের সাহায্যও চেয়েছে টি বোর্ড। অনুমোদিত কীটনাশকের তালিকা ও তার ব্যবহার বিধি কৃষি দফতরকে দিয়েছে টি বোর্ড। সেই অনুযায়ী বাগানগুলিতে নজরদারির পাশাপাশি সচেতনতা কর্মসূচিও হাতে নেবে কৃষি দফতর।
কীটনাশক ও তার ব্যবহারবিধি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে টি বোর্ডের অধীন ‘স্মল টি গ্রোয়ার্স ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টরেট’ জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর ও কোচবিহারে শতাধিক প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করছে। পরের ধাপে বৈদ্যুতিন মাধ্যম ও এসএমএস-এও বার্তা পাঠানো হবে। বড় বাগান ও বহুজাতিক সংস্থাগুলিও ক্ষুদ্র চা চাষিদের এ নিয়ে প্রশিক্ষণ দেবে।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/14/2020