পান, যার বৈজ্ঞানিক পরিচিতি পাইপার বিটল, সংস্কৃত ভাষায় ভূজঙ্গলতা পত্র। অহমিয়া ভাষায় এর নাম তাম্বুল, বাংলা ও হিন্দি ভাষায় পান বলে পরিচিত। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৮ কোটি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় পানের চাষ হয়। আর ভারতবর্ষে পানের উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশ হয় পশ্চিবঙ্গে। এ ছাড়াও, ওড়িশা, অসম, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ু রাজ্যে পানের চাষ হয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৯০০০ হাজার হেক্টর এলাকায় পানের চাষ হয়। এর মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় প্রায় ৩২৭০ হাজার হেক্টর, হাওড়া জেলায় প্রায় ২৫০০ হাজার হেক্টর পান চাষ হয়। এ ছাড়া হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং নদিয়া জেলায়ও পানের চাষ হয়। আর স্থানীয় ভাবে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি সহ বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ জেলাতেও কিছু কিছু পানের চাষ হয়।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পূজাপার্বণ থেকে ওষধি তৈরিতে পানের প্রয়োজন রয়েছে। পুরাণ অনুসারে দেবতা ও অসুর সমুদ্র মন্থন করার পর যখন অমৃত উঠে আসে তখন কয়েক ফোঁটা অমৃত পাতালে নাগরাজ্যে গিয়ে পড়ে আর সেখান থেকে এক লতার জন্ম হয়। যে কারণে এই লতাকে পুরাণে ‘নাগবল্লী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ধন্বন্তরি ‘পান’ পাতার ওষধি গুণ জানতে পারেন। পরবর্তী কালে ওই লতার পাতাই ‘পান’ পাতা হিসাবে পরিচিত।
পান চাষ পদ্ধতি এক বিশেষ রকমের যা ‘বরজ’ নামে পরিচিত। এই বরজ হল ভালো ভাবে ঘেরা ও উপরে ছাউনি দেওয়া বিশেষ ভাবে প্রস্তুত একটি ঘর। আর এই ছায়া ঘন পরিবেশের মধ্যে পানের চাষ যথেষ্ট সংখ্যায় ও উপযুক্ত মানের হয়। আর এ কারণেই ওই বিশেষ ধরনের ঘর ‘বরজ’-এ পান চাষ করাই সাধারণ রেওয়াজ। তবে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলা সহ অসম, উত্তর-পূর্ব ভারতে সাধারণ ভাবে সুপারি গাছকে অবলম্বন করে ছায়ায় বরজ ছাড়াই পান চাষ করা হয়। এই সকল অঞ্চলে বছরের বেশির ভাগ সময়ই বৃষ্টিপাত হয়। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি ও বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণও বেশি থাকে। যে কারণেই এই গাছে পান চাষের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, যদিও এই পদ্ধতিতে চাষ খুব একটা লাভজনক নয়।
পান চাষেও অন্যান্য ফসলের ন্যায় বিশেষ কয়েকটি সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল সংরক্ষণজাত সমস্যা, বর্ষার সময় অতিরিক্ত ফলন ও তার বিক্রয়জনিত সমস্যা। এ ছাড়াও বিপননজনিত সমস্যা আছে। সর্বোপরি বিশেষ কয়েকটি রোগের আক্রমণজনিত সমস্যা, যদিও পানের ভালো বাজার মধ্য প্রাচ্য সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে রয়েছে এবং আমাদের রাজ্য সহ দেশের অন্যান্য রাজ্য থেকে ওই সমস্ত দেশে রফতানি হয়।
সাধারণত যে কোনও মাটিতেই পান চাষ হতে পারে। তবে উঁচু অবস্থানের জলনিকাশিযু্ক্ত দোঁয়াশ বা এঁটেল-দোঁয়াশ মাটি পান চাষের উপযুক্ত। আর জমির পি এইচ ৬.৫ – ৭.৫-এর মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে সেচের সু-ব্যবস্থা আছে এমন বেলে বা দোঁয়াশ মাটিতেও পান চাষ করা যেতে পারে। তবে নোনা বা ক্ষার জাতীয় মাটি পান চাষের অনুপযুক্ত। ছায়াযুক্ত আর্দ্র বা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া ও রসযুক্ত মাটি পান চাষের উপযুক্ত। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৫০০ – ১৭৫০ মিলি এবং তাপমাত্রা ১০০ – ৪০০ সেলসিয়াস এই ফসলের জন্য প্রয়োজন।
সাধারণ ভাবে একটি পান-বরজ থেকে ৮ – ১০ বছর ধরে পানের ভালো ফলন পাওয়া যায়। যদি না প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনও কারণে বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মিঠা পানের জন্য দোঁয়াশ মাটি আর বাংলা ও সাঁচি পানের জন্য এঁটেল-দোঁয়াশ মাটিই সর্বোৎকৃষ্ট। পানের গুণগত মান ও ফলন দুই-ই মাটির তারতম্যের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
গাছ-পানের ক্ষেত্রে পানের লতাকে বাড়তে দেওয়া হয়। সাধারণত বছরে ৩ – ৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। গাছ-পান অন্য গাছকে আশ্রয় করে বেড়ে ওঠে। এই পানের পাতা মোটা ও ফলকটি (লিফ ব্লেড) সংকীর্ণ ও কটু স্বাদযুক্ত হয়।
এ ছাড়া বরজে নিম্ন প্রকার জাতের চাষ করা হয়
সব থেকে বেশি এই জাতের চাষ হয়। দোঁয়াশ বা এঁটেল-দোঁয়াশ মাটি উপযুক্ত। এই জাতের পাতার ফলক বড়, পাতলা, গোলাকার ও পাতাগ্র ছোট। পর্ব থেকে পর্বের মধ্যকার দূরত্ব বেশি, পাতার বোঁটা বেশ লম্বা, এর শাখা হয় না। ফলন সব থেকে বেশি। স্বাদও ভালো।
রাজ্যে হাওড়া ও মেদিনীপুর জেলার মধ্যেই মূলত এই জাতটির চাষ সীমাবদ্ধ। তবে বর্তমানে অন্যান্য জেলাতেও কিছু কিছু এই জাতের চাষ হচ্ছে। এই জাতটির পাতা ছোট, পাতলা, নরম ও ডিম্বাকৃতি, পাতার বোঁটা ছোট এবং পাতার ডগা ক্রমশ ছুঁচোলো। বাংলা জাতের থেকে এই জাতটির ফলন কম। স্বাদ ঝাল ও কটু।
রাজ্যে হাওড়া ও মেদিনীপুর জেলা ছাড়াও নদিয়া জেলায় এই জাতটির চাষ হয়। এই জাতটির পাতা ছোট, মোটা, নরম ও লম্বাটে। পাতার বোঁটা ছোট ও পাতার ডগা ক্রমশ সরু। শাখা-প্রশাখা হয়, তবে লতার বাড় অপেক্ষাকৃত কম। লতা অত্যন্ত সংবেদনশীল, ফলন তুলনামূলক ভাবে উপরোক্ত দু’টি জাত থেকে কম। স্বাদ মিষ্টি ও সুস্বাদু।
আষাঢ় ও আশ্বিন–কার্তিক মাস উপযুক্ত। তবে আশ্বিন–কার্তিক মাসে লাগালে ফলন ভালো পাওয়া যায়। এক একটি গাছাতে ৮০ – ৯০টি এক গাঁট যুক্ত কাটিং বা খাদির প্রয়োজন হয় অর্থাৎ কাঠা প্রতি ৮০০ – ৯০০ বা বিঘা প্রতি অর্থাৎ ০.৩৩ শতকে ১৬০০০ – ১৮০০০ টি কাটিং এর প্রয়োজন।
সতেজ, রোগমুক্ত ৪-৫ বৎসর পুরনো বরজ থেকে লতা সংগ্রহ করতে হবে। লতার গোড়ার দিকের এক হাত/দেড় হাত বাদ দিয়ে গাঁট বীজ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। লতা সংগ্রহের আগে সেই বরজে ১০–১৫ দিনের ব্যবধানে কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকঘটিত রাসায়নিক ওষুধ ৪ গ্রাম প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে দু’বার স্প্রে করতে হবে। এর পর লতা সংগ্রহের ৫–৬ দিন আগে গাছের ডগা ২–৩ সেমি ভেঙে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এর পর জীবাণুমুক্ত কাটার যন্ত্র দিয়ে লতা কেটে এমিসান ৬ রাসায়নিক ওষুধ ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলমিশ্রিত দ্রবণে সেই সব লতা ১০ মিনিট ভিজিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে লাগাতে হবে।
সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ – ৬০ সেমি এবং প্রতি সারিতে দু’টি লতার মধ্যে ১০ – ১৫ সেমি দূরত্ব রাখতে হবে। লতা লাগানোর সময় সারির মাটিতে কপার অক্সিক্লোরাইড দ্রবণ (৪ গ্রাম / লিটার জল) দ্বারা ভিজিয়ে দিতে হবে।
নির্বাচিত জমির মাটি ভালো ভাবে লাঙল দিয়ে তার পর ভিজিয়ে দিতে হবে। এর পর চৈত্র – বৈশাখ মাসে ওই কর্ষিত জমি ১ মাস ধরে রৌদ্র খাওয়াতে হবে। এ জন্য সাদা পলিথিন চাদরে জমি ঢেকে দিতে হবে। সপ্তাহের এক দিন বিকেলে পলিথিন চাদর খুলে জমিতে অল্প জল ছিটিয়ে আবার ঢেকে দিতে হবে। এর পর ৬০ মিলি ফরম্যালিন ১০ লিটার জলে গুলে প্রতি বর্গমিটার জমিতে প্রয়োগ করে পলিথিন চাদরে আরও ৪ – ৫ দিন ঢেকে রাখতে হবে। এর ২৫ – ৩০ দিন পর ওই জমিতে লতা লাগাতে হবে।
বরজের উচ্চতা ২ মিটারের বেশি হওয়া উচিত নয়। তাতে পরিচর্যার সুবিধা হয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘন ছাউনি না হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া বর্ষাকালে ছাউনি পাতলা ও শীতকালে ছাউনি ঘন করে দিতে হবে।
নতুন বরজে লতা বসানোর কয়েক দিন আগে প্রতি কাঠায় মোট ৬ কেজি হিসাবে আধাআধি নিম ও বাদাম খোল মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। এক মাসের মধ্যে গাঁট থেকে নতুন চারা বের হয়। চারা বের হলে মাটি ধরতে হবে এবং প্রতিটি লতার পাশে একটি করে সরকাঠি পুঁতে লতাটি কুশখড় দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। লতা যেমন লম্বা হবে তেমন ভাবে মাসে ৩ – ৪ বার পাট বা সরকাঠিতে বেঁধে দিতে হবে। ৬ – ৮ মাসের মধ্যে লতাটি প্রায় ২ মিটারের মতো লম্বা হয়ে যাবে। তখন তাকে উপরের দিকে বাড়তে না দিয়ে নীচের দিকে পাশিয়ে দিতে হবে ও কাওটি মাটি চাপা দিতে হবে। এই কাজটি বাংলা ও সাঁচি জাতের পানের ক্ষেত্রে বছরে ৫ – ৬ বার আর মিঠা জাতের পানের ক্ষেত্রে ৩ – ৪ বার করতে হয়। বর্ষাকালে সাধারণত লতার বাড় বেশি হয় আর শীতকালে তা কম হয়। লতা নামানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যে লতার নীচের পাতাটি যেন মাটির স্তর থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে থাকে, নচেৎ সহজে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পান বরজে সাধারণত বছরে ৪ থেকে ৫ বার সার ব্যবহার করা হয় এবং জৈব সার বেশি পরিমাণ ব্যবহার হয়। সাধারণত বৈশাখ, আষাঢ়, ভাদ্র, কার্তিক ও পৌষ মাসে সার ব্যবহার করা হয়। ৫ কাঠা বরজের জন্য প্রতি বছরে ১০০ কেজি খোল, ৮ কেজি ক্যালসিয়াম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সার, ১৫ কেজি মি. সুপার ফসফেট ও ১৬ কেজি মিউরেট অফ পটাশ ৬ ভাগে ভাগ করে প্রতি দু’মাস অন্তর প্রয়োগ করতে হবে।
পান ভিজে ও স্যাতসেঁতে আবহাওয়া পছন্দ করে। তাই বরজের ভিতরে আবহাওয়ায় ওই রূপ ভাব বজায় রাখার জন্য গ্রীষ্মের সময় প্রায় প্রতি দিন গাছের গোড়ায় জল দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন সেচ বেশি না হয়। সেচ বেশি হলে শিকড় পচা বা পাতা ঢলে পড়া রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শীতকালে বা বছরের অন্য সময়ে ৩ - ৪ দিন অন্তর প্রয়োজনভিত্তিক সেচ দিতে হবে। বরজের ভিতরে যাতে অতিরিক্ত জল জমে না যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় নিকাশি ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/15/2020
স্কুলে কেন আইসিটি জরুরি তা এখানে বলা হয়েছে।
কর আদায়ের পদ্ধতিকে একটি নির্দিষ্ট মানে আনার জন্য ...