এখানে হাইব্রিড ধান ও তা চাষের পদ্ধতি নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করা হয়েছে।
ধানের দু’টি দূর সম্পর্কীয় জাতের পরাগমিলনে উদ্ভুত প্রজনিত প্রথম পুরষটির নাম হাইব্রিড ধান। সহজ কথায় হাইব্রিড ধান দু’টি জাতের প্রথম অপত্য বংশধর। উচ্চফলনশীল বা হাই ইল্ডিং ধানগুলিও দু’টি জাতের সংকরীকরণের মাধ্যমে উদ্ভুত। তবে এই জাতগুলি পিতৃপুরুষের ষষ্ঠ/সপ্তম/অষ্টম অপত্য বংশধর। ১৯২৬ সালে বিজ্ঞানী জোনস দেখেছিলেন দু’টি মানানসই ধানের যৌন মিলনে উদ্ভুত প্রথম অপত্য বংশধরটির ফলনক্ষমতা পরবর্তী বংশধরদের ফলনক্ষমতা অপেক্ষা বহু গুণ বেশি হয়। সারা বিশ্বের কৃষি প্রজননবিদরা এই তত্ত্বের যথার্থতা অনুধাবন করলেও ধানের ফলন উন্নয়ন কর্মসূচিতে এই কৌশল প্রয়োগের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রথম অপত্য বংশের বীজ উত্পাদনের সীমাবদ্ধতা। কেননা ধানের ফুল দ্বি-লিঙ্গ। অর্থাৎ ধানের একটি ফুলের মধ্যে পুং স্তবক এবং স্ত্রী স্তবক উভয়ই বিদ্যমান। তাই ধানের বীজ উত্পাদনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া স্ব-পরাগ সংযোগ। সংকরীকরণের সময় প্রথমে দু’টি জাতের একটির ফুলের ভিতর থেকে পুং স্তবকগুলিকে তুলে ফেলা হয়। অতঃপর অন্য জাতটির পরাগধানী থেকে পরাগ সংগ্রহ করে পুংস্তবক মুণ্ডিত প্রথম জাতটির গর্ভমুণ্ডের ওপর নিক্ষেপ করে নিষেক সম্পন্ন করা হয়। এই জাতীয় দুর্বহ পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিমাণে বীজ উত্পাদন বাস্তবসম্মত নয় বলেই হাইব্রিড ধান গবেষণা থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন বিশ্বের অধিকাংশ বিজ্ঞানীরা। মুখ ফেরাননি শুধু গণপ্রজাতন্ত্রী চিন দেশের বিজ্ঞানীরা।
১৯৬৪ সাল থেকে বিজ্ঞানী যুয়ান লঙ পিঙের নেতৃত্বে হাইব্রিড ধানের ওপর নিবিড় গবেষণা চলেছে চিন দেশে। ১৯৭০ সালে লঙ পিঙের সহকারী লি বিহু হাইনান দ্বীপে প্রকৃতির কোলে গজিয়ে ওঠা ধানের বন্যপ্রজাতির মধ্যে হঠাৎই খুঁজে পেলেন পরাগ-বন্ধ্যা ধানের গাছ। হুনান চাঙসায় হাইব্রিড গবেষণা কেন্দ্রে ওই পরাগ-বন্ধ্যা গাছটির ওপর গভীর অনুসন্ধানের পর জানা গেল গাছটির পরাগ-বন্ধ্যাতের হোতা তার কোষের সাইটোপ্লাজম। বন্য প্রজাতির কোষজাত পরাগ বিনষ্টকারী এই বিশেষ প্রকৃতির সাইটোপ্লাজমের নাম দেওয়া হল ‘ডবলুএ (ওয়াইল্ড অ্যাবরটিভ) সাইটোপ্লাজম’। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ‘ডবলুএ সাইটোপ্লাজম’-সমৃদ্ধ কোষে ব্যবহারিক ধানের নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপন করে উদ্ভাবিত হল অভিনব ঘরানার ব্যবহারিক ধান। যে ধানের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য সাধারণ ধানের মতো কিন্তু পুং স্তবকটি অকেজো। বিজ্ঞানীরা এই ধানটির নাম দিলেন স্ত্রী ধান বা ‘এ’ লাইন। এই ধানটির পুং স্তবক অকেজো হওয়ার ফলে ধানটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ল পরাগ প্রদানকারী এমন প্রকৃতির ধান যা এই ধানের পুরুষত্বহীনতা-সহ সর্ব প্রকার চারিত্রিক বিশুদ্ধতা বজায় রেখে ধানটির বংশ বৃদ্ধি করে যেতে পারবে। ধানের যে ব্যবহারিক জাতটির নিউক্লিয়াস প্রতিস্থাপন করে স্ত্রী ধানটি উদ্ভাবিত হয়েছিল দেখা গেল সেই ধানটির পরাগ থেকে সংগৃহীত পরাগ এই কাজটা সুষ্ঠ ভাবে করতে পারছে। বিজ্ঞানীরা স্ত্রী ধানের প্রতিপালনের জন্য পরাগ প্রদানকারী এই ধানটির নাম রাখলেন প্রতিপালক পিতা অর্থাৎ মেনটেনার অথবা ‘বি’ লাইন। এ বার খোঁজা শুরু আরও এক বিশেষ প্রকৃতির ধান -- মৃদুমন্দ বাতাস যার পরাগ বয়ে এনে স্ত্রী ধানের গর্ভমুণ্ডে নিক্ষেপ করে সৃষ্টি করবে অতি উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধানের জাত।
কাজটা কিন্তু সহজ ছিল না। কেননা যৌন জননে জাত ভ্রূণের কোষের সাইটোপ্লাজমের সবটুকু আসে মায়ের দিক থেকে। এ ক্ষেত্রে স্ত্রী ধানের অর্থাৎ মায়ের সাইটোপ্লাজম পুরুষত্ব বিনাশকারী হওয়ার সুবাদে নিষেকের পর ভ্রূণে থেকে বেড়ে ওঠা গাছটি বন্ধ্যা হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। বাণিজ্যিক হাইব্রিড ধান উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে গর্ভাধানের জন্য প্রয়োজন সেই পরাগ পিতা যার বংশগতিদত্ত শক্তি পরাগ-বন্ধ্যা স্ত্রী ধানের পুরুষকার পুনরুদ্ধার করে ভ্রূণটিকে করে তুলতে পারে অতি উচ্চ ফলনশীল। নিবিড় অন্বেষণে অবশেষে পাওয়া গেল এ জাতীয় এক গুচ্ছ ব্যবহারিক ধানের জাত। বিজ্ঞানীরা এই বিশেষ ধানগুলির নাম দিলেন পুনরুদ্ধারক পিতা অর্থাৎ রেসটোরার অথবা ‘আর’ লাইন। ১৯৭৩ সাল নাগাদ ধান-বিজ্ঞানের তথ্যকোষে স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত হল চৈনিক বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত ভিন গোষ্ঠীর তিনটি ব্যবহারিক ধান — ‘এ’, ‘বি’ ও ‘আর’ লাইন।
এই তিনটি ধানের যোগসূত্রে ১৯৭৪ সালে চিন দেশে উদ্ভাবিত হল বিশ্বের প্রথম হাইব্রিড ধান। ১৯৭৫ সালে সারা দেশে মোট ৩৭৩ হেক্টর জমিতে প্রাথমিক মূল্যায়নের পর বিশ্বের প্রথম হাইব্রিড ধানটি বাণিজ্যিক আকারে চাষের জন্য সরকারি ছাড়পত্র পেল ১৯৭৬ সালে। উচ্চফলনশীল ধানের পাশাপাশি শুরু হল অতি উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ধানের চাষ। দুই দশকের কম সময়ের মধ্যেই চিনে ৫০% ধানী জমিতে পৌঁছে গেছে হাইব্রিড ধান। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষকেরা হাইব্রিড ধান প্রবর্তনের মাধ্যমে বর্তমানে হেক্টর পিছু গড়পড়তা ১.৭ টন অধিক ফলন ঘরে তুলতে পারছে।
মজার কথা হল বন্ধ্যা সাইটোপ্লাজমসমৃদ্ধ হাইব্রিড প্রযুক্তি উদ্ভাবনের স্বীকৃতি চিন দেশের ঝুলিতে গেলেও ধানে অনুরূপ সাইটোপ্লাজমের অস্তিতের কথা চিন দেশে কাজ শুরুর বহু আগেই ঘোষণা করেছিলেন ভারতের দুই বিজ্ঞানী — সম্পত এবং মহান্তি। ভারতীয় বিজ্ঞানীদ্বয়ের উক্ত তত্ত্বসম্বলিত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে। ওই তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগের দিকে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের বহু কাল নজর পড়েনি।
নজর পড়ল অনেক পরে। মূলত চিনের সাফল্যে আপ্লুত হয়েই আমাদের দেশে অনুসন্ধান পরিষদের ছত্রছায়ায় ফাও এবং ইউ এন ডি পি-র আর্থিক সহায়তায় হাইব্রিড ধানের ওপর নিবিড় গবেষণা প্রকল্প চালু হল ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। প্রযুক্তিগত সাহায্যের হাত বাড়ালেন হাইব্রিড প্রযুক্তির জনক চৈনিক বিজ্ঞানী লঙ পিঙ ও তাঁর সহকারীবৃন্দ। এগিয়ে এলেন ফিলিপাইনসের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীগণ। কাজ শুরু হল বিভিন্ন রাজ্যের মোট ১২টি গবেষণা কেন্দ্রে। ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদের তরফ থেকে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সমন্বয়ের দায়িত্ব পেল হায়দরাবাদের ধান গবেষণা অধিকার।
সেই থেকে এই প্রকল্পে কাজ চলেছে যুদ্ধকালীন তত্পরতায়। ভারতের জলহাওয়া উপযোগী ‘এ’ লাইন উদ্ভাবন/নির্বাচন, নির্বাচিত ‘এ’ লাইনের উপযুক্ত ‘আর’ লাইন চিহ্নিতকরণ, হাইব্রিড ধান উদ্ভাবন, উদ্ভাবিত হাইব্রিডের ফলনের নিরীক্ষা ইত্যাদি এক যোগে চলেছে। সমন্বিত নিবিড় গবেষণায় ২০১২-১২ সাল পর্যন্ত উদ্ভাবিত জাতগুলির মধ্যে ৬৫টি হাইব্রিড ধানের জাত ভারতবর্ষে বাণিজ্যিক চাষের ছাড়পত্র পেয়েছে। অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার। এর মধ্যে ৩৫টি হাইব্রিড ধানের উদ্ভাবক দেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি ধান গবেষণা কেন্দ্র। বাকি ৩০টির মধ্যে ১৫টির উদ্ভাবক ব্যক্তিগত মালিকাধীন বীজ কোম্পানি। ১৫টির মধ্যে দেশি কোম্পানির অবদান ১০টি, বহুজাতিক সংস্থার ৫টি। ১৯৯৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত মারাতেরা কেন্দ্রে উদ্ভাবন হয় খরিফ মরশুমে চাষের উপযোগী দেশের প্রথম হাইব্রিড ধানের জাত। ভারতবর্ষে রবি মরশুমে বাণিজ্যিক চাষের উপযোগী প্রথম জাতটি উদ্ভাবিত হয় পশ্চিমবঙ্গের চুঁচুড়া ধান গবেষণা কেন্দ্রে, ১৯৯৫ সালে।
বর্তমানে চিন দেশ ছাড়াও ভারত, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনস, মায়ানমার, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, কলোম্বিয়া, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশে হাইব্রিড ধানের চাষ ছড়িয়েছে। এই দেশগুলিতে সম্মিলিত ভাবে বর্তমানে মোট ৩০,০০০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ভারতবর্ষেই হাইব্রিড ধানের চাষ ১৪,০০,০০০ হেক্টরে। অর্থাৎ দেশের ২.৬ শতাংশ ধানের এলাকা বর্তমানে হাইব্রিড চাষের আওতায়। উত্তরপ্রদেশ, পজ্ঞাব, হরিয়ানা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে হাইব্রিড চাষ ইতিমধ্যেই কৃষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।
ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদের মূল প্রকল্পের অংশীদার হয়ে পশ্চিমবঙ্গে হাইব্রিড ধানের ওপর গবেষণার কাজ শুরু হয় ১৯৯২ সালের মে মাসে রাজ্য সরকারের চুঁচুড়া ধান গবেষণা কেন্দ্রে। মূলত বোরো মরশুমের উপযোগী হাইব্রিড উদ্ভাবনই এই কেন্দ্রের মুখ্য উদ্দেশ্য। নিরলস গবেষণায় এই কেন্দ্রে উদ্ভাবিত হয়েছে শতাধিক পরীক্ষামূলক হাইব্রিড ধানের। প্রাথমিক স্তরে পরীক্ষানিরীক্ষার সংক্ষিপ্ত খতিয়ান ও পশ্চিমবঙ্গের জলহাওয়ায় প্রচলিত, উচ্চফলনশীল ধানের ফলনসীমার নিরিখে হাইব্রিড ধানের উচ্চতর ফলন ক্ষমতার চিত্র নীচে তুলে ধরা হল।
পরিসংখ্যান |
মরশুম |
||
বোরো |
খরিফ |
মোট |
|
পরীক্ষিত হাইব্রিডের সংখ্যা : |
১৪৫ |
১৪০ |
২৮৫ |
জনপ্রিয় উচ্চ ফলনশীল জাত অপেক্ষা হেক্টর টনের অধিক ফলন ক্ষমতাসম্পন্ন হাইব্রিডের সংখ্যা |
৪২ |
৩২ |
৭৪ |
গবেষণা খামারে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ ফলন (টন / C2) ক ) হাইব্রিড |
৯.০ |
৭.৫ |
- |
খ) উচ্চফলনশীল |
৬.৬ |
৫.৪ |
- |
পরবর্তী কালে হাইব্রিড ধানের নিরীক্ষা কেবলমাত্র গবেষণা খামারে সীমাবদ্ধ না রেখে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় কৃষকের খামারে সম্ভাবনাময় হাইব্রিডগুলির ফলনক্ষমতা ও অন্য গুণাবলির বিস্তারিত মূল্যায়ন করা হয়েছে।
২০১২ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কৃষকের খামারে ভারত সরকারের সুপারিশকৃত মোট ৫টি হাইব্রিড জাত নিয়ে ৭১০টি ফ্রন্টলাইন প্রদর্শন ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। প্রতিটি প্রদর্শনক্ষেত্রের আয়তন ছিল ১ হেক্টর। প্রদর্শন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হাইব্রিড ধানের জাতগুলি ছিল : পি এ - ৬৪৪৪, কে আর এইচ - ২, সি এন আর এইচ - ৩, পি এ - ৬২০১, পি এইচ বি - ৭১, পি এ সি - ৮৩৫ এবং পি এ সি - ৮৩৭। প্রদর্শনক্ষেত্রের এই নিরীক্ষাগুলি ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদের তত্ত্বাবধানে চুঁচুড়া ধান গবেষণা কেন্দ্রের সহায়তায় অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি প্রদর্শনক্ষেত্রে হাইব্রিড ধানের পাশাপাশি ফলনের তুলনামূলক উত্কর্ষ যাচাই করার জন্য চাষ করা হয়েছিল সমমেয়াদি উচ্চফলনশীল জাত যেমন ক্ষিতীশ, শতাব্দী, ললাট ইত্যাদি। ফলনের তুলনামূলক বিচারে দেখা গেছে সমমেয়াদী উচ্চফলনশীল জাতের পরিবর্তে এই হাইব্রিড জাতগুলি চাষ করলে হেক্টর পিছু ১০২০ থেকে ১৬৭০ কেজি অধিক ধান কৃষকের ঘরে উঠবে।
বিধানচন্দ্র কৃষি বিদ্যালয়ের তরফ থেকে বাঁকুড়া জেলার কৃষকের খামারে ২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সালে উচ্চ ফলনশীল ধানের পাশাপাশি খরিফ মরশুমে হাইব্রিড ধানের ফলনের তুলনামূলক নিরীক্ষা চালানো হয় একটি বিশেষ গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে। নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে সমমেয়াদি উচ্চফলনশীল জাত অপেক্ষা হাইব্রিড ধানের ফলনক্ষমতা লক্ষণীয় ভাবে বেশি। তাই ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদ ও রাজ্য ধান গবেষণা কেন্দ্র যৌথ ভাবে রাজ্যে বাণিজ্যিক চাষের জন্য বিভিন্ন সমেয় যে হাইব্রিড ধানের জাতগুলো সুপারিশ করেছে তা হল — সি এন এইচ আর – ৩, কে আর এইচ – ২, পি এ – ৬২০১ ও ৬৪৪৪, ডি আর আর এইচ- ২, জে কে আর এইচ – ৭৫৫, ইউ এস – ৩১২, পি এইচ বি – ৭১, পি এস সি – ৮৩৫ ও ৮৩৭ এবং শেহাদ্রি – ৪। বর্তমানে এই জাতগুলির মধ্যে কয়েকটিকে নির্বাচন করে রাজ্য জুড়ে সবুজ বিপ্লব প্রকল্পের আর্থিক সহায়তায় প্রতি ব্লকে ১০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে ঘন বিন্যস্ত প্রদর্শনক্ষেত্র গড়ে তুলে রাজ্যে হাইব্রিড ধানকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা চলছে। খরিফ মরশুমে বিশেষ করে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর ও উত্তরবঙ্গের বৃষ্টি নির্ভর উঁচু জমিতে উচ্চফলনশীল হাইব্রিড ধানের উত্কর্ষ কৃষকদের নজর কাড়তে শুরু করেছে।
শুরু হয়েছে উচ্চফলনশীল (উফশী) ধানের পাশাপাশি আরও অধিক ফলনশীল হাইব্রিড ধানের চাষ। উফশী ধান ও হাইব্রিড ধানের গঠনশৈলীর মধ্যে বিস্তর বৈষম্য বিদ্যমান। চারা অবস্থা থেকেই এই পার্থক্য নজরে পড়তে শুরু করে। হাইব্রিড ধানের প্রাথমিক বাড়বৃদ্ধির হার, পাশকাঠি ছাড়ার ক্ষমতা এবং রোপণের প্রাথমিক অবস্থায় নাইট্রোজেন সার গ্রহণক্ষমতা উফশী ধান অপেক্ষা অনেক বেশি। সর্বোচ্চ ফলনের জন্য বর্গমিটার পিছু প্রয়োজনীয় শিষের সংখ্যা উফশী ধানের বেলায় যতটা চারার সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল হাইব্রিড ধানের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই পাশকাঠি মুখাপেক্ষী। এ জাতীয় ধানের ফলনের ৮০ শতাংশই পাশকাঠির অবদান। ধানের দুই গোষ্ঠীর এই চরিত্রগত বৈষম্যের সুবাদে বোরো চাষের পরিচিত উফশী চাষবিধি হাইব্রিড ধান চাষে পরিপূর্ণ ভাবে প্রযোজ্য হবে না। প্রাথমিক পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে হাইব্রিড ধানের বোরো চাষবিধির পরিমার্জিত নির্যাস বর্তমান নিবন্ধে তুলে ধরা হল।
চাষের জন্য হাইব্রিড ধান বীজ উফশী ধান অপেক্ষা ৬৫ – ৭০ শতাংশ কম লাগে। একর প্রতি ৬ – ৮ কেজি বীজই যথেষ্ট।
হাইব্রিড ধানের চারার বাড়বৃদ্ধি উফশী ধানের দ্বিগুণ। তাই বীজতলায় বীজ পাতলা করে ছড়ানো দরকার যাতে বীজতলা থেকেই পাশকাঠি ছাড়া শুরু হয়ে যায়। এক একর জমির চারা তৈরি করার জন্য ২০০ বর্গমিটার জমিতে বীজতলা গড়ে তুলতে হবে। ওই পরিমাণ জমিতে এক একর জমির জন্য প্রয়োজনীয় শোধিত বীজ কলা করে সর্বত্র সমান ভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। বীজশোধনের নিয়মাবলী প্রচলিত উফশী ধানের অনুরূপ। উপরোক্ত পরিমাণ বীজতলায় উল্লেখযোগ্য করণীয় :
বীজতলার অন্যান্য পরিচর্যা যথা আগাছা দমন, সেচ ও অন্যান্য রোগ নিয়ন্ত্রণবিধি উফশী ধানের অনুরূপ। চারার বয়স খরিফ মরশুমে ২০ – ২৫ দিন ও বোরো মরশুমে ৪০ – ৪৫ দিনের মধ্যে এসে গেলেই রোয়ার কাজে সর্বোত্কৃষ্ট বলে বিবেচিত হবে।
উফশী ধান ও হাইব্রিড ধানের জমি তৈরির কোনও গুণগত প্রভেদ নেই। পার্থক্য যা আছে তা মূল সার ব্যবহারবিধিতে। উফশী ধানের বেলায় প্রদেয় রাসায়নিক সারের ফসফেট ও পটাশের সবটুকু এবং নাইট্রোজেনের এক চতুর্থাংশ শেষ চাষের আগে মূল সার হিসাবে জমিতে দেওয়া হয়। হাইব্রিড ধানের ক্ষেত্রে প্রদেয় ফসফেট ও পটাশের ব্যবহার অনুরূপ ভাবে করে নাইট্রোজেনের প্রদেয় মাত্র এক চতুর্থাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৩ শতাংশ করা হয়। নাইট্রোজেন ব্যবহারবিধির এই বৈষম্যের মূল কারণ দু’ ধরনের ধানের সারবস্তু উত্পাদন করার বিপরীত ধর্মী রীতি। হাইব্রিড ধানের সিংহ ভাগ সারবস্তু উত্পাদিত হয় বাড়ন্ত কালের প্রাথমিক অবস্থায়। এই সারবস্তুই পরবর্তী কালে দানা উত্পাদনের কাজে ব্যয়িত হয়। উফশী ধানের বেলায় এই কাজটা গতি পায় বাড়ন্ত কালের প্রান্তে এসে। উদ্ভিদ শরীরবিদরা দেখেছেন হাইব্রিড ধান জীবনকালে যতটুকু নাইট্রোজেন আহরণ করে তার ৩০ – ৩৫ শতাংশ সংগৃহীত হয় রোয়ার পর থেকে পাশকাঠি ছাড়ার প্রাথমিক অবস্থার অন্তবর্তী সময়ে, আর ৩০ – ৩৫ শতাংশ এর পর থেকে শিষের সূচনাকালের মধ্যবর্তী সময়ে। তাই জমি তৈরির জন্য মূল সারের ব্যবহারবিধি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হল :
জৈবসার |
: |
৩ – ৫ টন/একর |
নাইট্রোজেন |
: |
১৪ – ১৬ কেজি/একর |
ফসফেট |
: |
২০ – ২৪ কেজি/একর |
পটাশ |
: |
২০ – ২৪ কেজি/একর |
উফশী ধান অপেক্ষা হাইব্রিড ধান কম ঘনত্বে রোয়া করা দরকার। কেননা হাইব্রিড ধানের পাশকাঠি ছাড়ার ক্ষমতা অনেক বেশি এবং এই ধানের ফলন মূলত পাশকাঠি-নির্ভর। পাশকাঠির অবদান উফশী ধানের ফলনে যেখানে ৩৫ – ৪০ শতাংশ সেখানে হাইব্রিড ধানে ৭০ – ৭৫ শতাংশ। তাই রোয়ার ঘনত্ব এমন হওয়া দরকার যাতে গুছির চার পাশের পরিবেশ পাশকাঠি বেড়ে ওঠার অনুকূল হয়। সেই সুবাদে উল্লেখযোগ্য হল —
পরিচর্যার প্রথম পাঠ গুছি পূরণ ও আগাছা দমন। গুছি পূরণের কাজটা বিশেষ যত্ন সহকারে রোয়ার ৭ – ৮ দিনের মাথায় করে ফেলা দরকার, কেননা হাইব্রিড ধানে গুছি প্রতি একটি মাত্র চারা লাগানো হয়। পাশকাঠি সর্বোচ্চ সংখ্যায় উন্নীত হওয়া পর্যন্ত জমি আগাছামুক্ত রাখাই রীতি। আগাছা নিয়ন্ত্রণের কাজটা বুটাক্লোর জাতীয় দানাদার আগাছানাশক (১৩ কেজি/একর) প্রয়োগ করেও করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রোয়ার ৭ দিনের মধ্যে জমিতে দানাদার আগাছানাশক ছিটিয়ে জমির জল ৭ – ১০ দিন বেঁধে রাখতে হবে।
সেচের ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি উফশী ধানের অনুরূপ। তবে হাইব্রিড ধানে দিন প্রতি বর্গমিটার পিছু পাশকাঠি উত্পাদনের হার ৩০ ছাড়িয়ে গেলে জমি থেকে জল বার করে সেচ বন্ধ রেখে মাটি শুকিয়ে ফেলতে হবে। নতুবা অত্যাধিক পাশকাঠি ফলনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
উফশী ধানের মতোই হাইব্রিড ধানের চাপান সার দু’বারে দেওয়া দরকার। তবে সারের মাত্রা হবে :
চাপান সার ছড়ানোর কাজটা একটু বেলার দিকে তাপমাত্রা বাড়ার পর করাই বাঞ্ছনীয়। সার ব্যবহারের পর জমিতে কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা জল বেঁধে রাখা দরকার। প্রথম চাপানের পর মাটি ঘেঁটে জল ঢোকানোর চলতি অভ্যাস দ্বিতীয় চাপানোর বেলায় করা উচিত নয়।
হাইব্রিড ধানের ফলনের অন্যতম অন্তরায় ‘মাজরা’ পোকা। কেন না অনুমোদিত হাইব্রিড ধানগুলির অধিকাংশই জলদিমেয়াদি। তাই মাজরা পোকার গতিবিধির ওপর সবিশেষ নজর রেখে নিয়ন্ত্রণের বিশেষ সুপারিশবিধি মেনে চলাই শ্রেয়।
মাজরা পোকা ছাড়াও বাদামি শোষক পোকার উত্পাত ফলনের ক্ষতি করতে পারে। প্রায়শই এদের আক্রমণ শস্যের ফলনের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই ধানে শিষের সূচনাকাল থেকে কাঁচথোড় আসা পর্যন্ত গুছিপ্রতি ১৫/২০টি পোকা অথবা ফুল আসার পর গুছিপ্রতি ২৫/৩০টি পোকা দেখা দিলে গাছের গোড়ার দিকে একর প্রতি ১০ কেজি গুঁড়ো জাতীয় রাসায়নিক ওষুধ যেমন এন্ডোসালফান ৪%, কুইনালফস ১.৫%, লিনডে ১.৪%, কার্বারিল ডি পি ছড়াতে হবে। জলে গোলা ওষুধ যেমন বি এইচ সি ৫০ ডব্লুবিপি, কার্বারিল ৫০ ইত্যাদি উফশী ধানের জন্য সুপারিশকৃত মাত্রায় ছেটানো যেতে পারে।
রোগের ক্ষেত্রে পাশকাঠি ছাড়ার পর থেকে দানা পৃষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত নজর রেখে উফশী ধানের জন্য চলতি নিয়ন্ত্রণবিধি মেনে চলতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের যে সমস্ত বৃষ্টিনির্ভর উঁচু ও মাঝারি জমিতে খরিফ খন্দে উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের ধান চাষ সত্ত্বেও ফলন বেশ কম, সেই সমস্ত অঞ্চলেই হাইব্রিড ধানের চাষ কৃষক-প্রিয় হচ্ছে। কেন না এই ধানের জমিতে উফশী ধানের পরিবর্তে হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করলে ২৫ – ৩০ শতাংশ অধিক ফলন পাওয়া যাচ্ছে। এই সব অঞ্চলের উপযোগী হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবিত হয়েছে দু’ ভাবে। উদ্ভাবনের অন্যতম প্রধান স্থল হল দেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি গবেষণাকেন্দ্র। বেসরকারি বীজ সিড কোম্পানিগুলিও বেশ কিছু জাতের উদ্ভাবন করেছে।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি গবেষণাকেন্দ্র উদ্ভাবিত জাত :
এই জাতটির উদ্ভাবক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চুঁচুড়া ধান গবেষণা কেন্দ্র। জাতটি ১৯৯৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে চাষের জন্য রাজ্য সরকারের অনুমোদন পায়। সি এন আর এইচ - ৩, আই আর ৬২৮২৯ – এ এবং অজয়া – আর নামের দু’টি উফশী ধানের মিলনে উদ্ভুত প্রথম অপত্য পুরুষ। পাকতে সময় লাগে ১০০ – ১০৫ দিন। ধান মাঝারি সরু। চালের অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৬ ২৭ শতাংশ, অ্যালকালি স্প্রেডিং ভ্যালু – ৩। তবে ১০০ কেজি ধান ভাঙালে ৭০ কেজি মোট চাল এবং ৫২ কেজি গোটা চাল পাওয়া যায়। গাছের উচ্চতা ৮০ – ৮৫ সেমি। হেক্টর প্রতি ফলন ক্ষমতা ৭.৫ টন, ক্ষিতিশের চেয়ে ৩৭ শতাংশ বেশি।
জাতটির উদ্ভাবক কেন্দ্রীয় সরকারের হায়দরাবাদ ধান গবেষণা কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় জাত অনুমোদন সংস্থা ২০০৫ সালে জাতটি পশ্চিমবঙ্গ সহ কয়েকটি রাজ্যে চাষের জন্য অনুমোদন করে। জাতটি আই আর – ৬৮৮৯৭-এ এবং ডি আর ৭১৪ – ১ -২ আর নামের দু’টি উফশী ধানের প্রথম অপত্য পুরুষ। পাকতে সময় লাগে ১১২ – ১১৬ দিন। ধান লম্বা লম্বা সরু। চালে অ্যামাইলোজের পরিমাণ ২৫%। তবে অ্যালকালি স্প্রেডিং ভ্যালু ৬৩%। মোট চাল ধানের ৭৩% এবং গোটা চাল ৬৩%। গাছের উচ্চতা ৮৫ – ৯০ সেমি। ফলন ক্ষমতা হেক্টর প্রতি ৫.৫ টন।
উদ্ভাবক কর্ণাটকের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ক্ষেত্রীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, মান্ড্য। কেন্দ্রীয় জাত অনুমোদন সংস্থা ১৯৯৬ সালে জাতটিকে পশ্চিমবঙ্গ সহ কয়েকটি রাজ্যে বাণিজ্যিক চাষের জন্য অনুমোদিত করে। জাতটি আই আর ৫৮০২৫-এ এবং কে এম আর -৩ আর, এই দু’টি উফশী ধানের প্রথম অপত্য বংশ। পাকতে লাগে ১২৫ -১৩০ দিন। লম্বা মোটা ধান। চালে অ্যামাইলোজের ভাগ ২৭%। অ্যালকালি স্প্রেডিং ভ্যালু কম ২.২%। ধানের ৭৩% মোট চাল ও ৫৭% গোটা চাল। ফলন ক্ষমতা হেক্টর পিছু ৭.৫ টন, লম্বা খড়, গাছের উচ্চতা ১১০ – ১১৫ সে মি।
মহারাষ্ট্রের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত কারজাটের আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে উদ্ভাবিত। জাতটি কেন্দ্রীয় জাত অনুমোদন সংস্থার ছাড়পত্র পায় ২০০৬ সালে। আই আর ৫৮০২৫-এ এবং কেজিটি আর - ২ – আর, এই দু’টি উফশী ধানের সংকরায়নে জাত প্রথম অপত্য পুরুষ। পাকতে সময় লাগে ১১৫ – ১২০ দিন। লম্বা সরু ধান। চালে অ্যামাইলোজের পরিমাণ মাঝারি (২৩%)। কিন্তু অ্যালকালি স্প্রেডিং ভ্যালু ৬। মোট চাল ধানের ৭০% , গোটা চাল ৫৬%। জাতটি ঝলসা, ব্যাকটেরিয়াজনিত ধসা ও ভুসো রোগ সহনশীল। এ ছাড়াও বাদামি শোষক পোকা ও মাজরা পোকায় মাঝারি সহনশীল।
সত্ত্বাধিকারী পায়োনিয়ার ওভারসিস কর্পোরেশন হায়দরাবাদে অবস্থিত ভারতীয় গবেষণা কেন্দ্র। ১৯৯৭ সালে কেন্দ্রীয় জাত অনুমোদন সংস্থার কাছ থেকে জাতটি ভারতে চাষের ছাড়পত্র পায়। জাতটির বংশপরিচয় গোপন রাখা আছে। পাকতে সময় লাগে ১৩০ – ১৩৫ দিন। ধান লম্বা সরু। চালের অ্যামাইলেজ ২৩%, অ্যালকালি স্প্রেডিং ভ্যালু – ২.৪। মোট চাল ধানের ৭১%, গোটা চাল ৫৯%, ফলন ক্ষমতা ৭.৮৬ টন। জাতটি ব্যাকটেরিয়াজনিত ধসা ও ঝলসা রোগ এবং বাদামি শোষক পোকা ও চুঙ্গি পোকা সহনশীল। গাছ আংশিক লম্বা (১৩০ সে মি)।
সত্ত্বাধিকারী বেয়ার বায়োসায়েন্স কোম্পানির হায়দরাবাদ শাখা। ভারতবর্ষে চাষের ছাড়পত্র মেলে কেন্দ্রীয় জাত অনুমোদন সংস্থার কাছ থেকে ২০০০ সালে। জাতটির বংশপরিচয় গোপন কোডে ৬ সিও – ২ এবং ৬ এমও -১ সংকরায়নে উদ্ভুত প্রথম অপত্য পুরুষ। পাকতে সময় লাগে ১২৫ – ১৩০ দিন। সরু লম্বা ধান। চালের অ্যামাইলোজ – ২৪%, অ্যালকালি স্প্রেডিং ভ্যালু – ২.০। ধানের ৬৮% মোট চাল ও ৬১% গোটা চাল। জাতটি ঝলসা, বাদামি শোষক পোকা ও পাতা মোড়া পোকা সহনশীল। গাছ আংশিক লম্বা (১১৫ সে মি)। ফলন ক্ষমতা ৬.২ টন প্রতি হেক্টর। এই জাতটি পশ্চিমবঙ্গের চাষে সুপারিশ ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদের।
এই জাতটির ও সত্ত্বাধিকারী বেয়ার বায়োসায়েন্স হায়দরাবাদ। কেন্দ্রীয় জাত অনুমোদন সংস্থার অনুমোদন মেলে ২০০১ সালে। বংশপরিচয়ের কোড ৬ সিও-২ এবং ৬ এমও -৫। জাত দু’টির সংকরায়নের ফলে উদ্ভুত প্রথম অপত্য পুরুষ। পাকতে সময় লাগে ১৩০ – ১৩৫ দিন। মাঝারি সরু ধান। ধানে মোট চালের ভাগ ৭৪%। গোটা চালের ভাগ ৬৪%। চালের অ্যালকালি স্প্রেডিং ভ্যালু ৪.৫। ফলন ক্ষমতা হেক্টর পিছু ৬.১ টন। গাছ আংশিক লম্বা (১১০ সে মি)। জাতটি খোসা পচা, ব্যাকটেরিয়াল পাতা ধসা রোগ ও বাদামি শোষক পোকা সহনশীল।
সত্ত্বাধিকারী জে কে এগ্রি জেনেটিক্স লিমিটেড, হায়দরাবাদ। বংশ পরিচয়ের কোড আরভি – ২ এ এবং আরভি -৪৪ আর, এই দু’টি জাতের সংকরায়নে উদ্ভুত প্রথম অপত্য পুরুষ। পাকতে সময় লাগে ১৪০ দিন। লম্বা মোটা ধান। ধানে গোটা চালের ভাগ ৫৯%, মোট চালের ভাগ ৭৪%। চালের অ্যামাইলোজ ২৪.৫%, অ্যালকালি স্প্রেডিং ভ্যালু ৫.২। ফলন হেক্টর পিছু ৬.২২ টন। গাছ আংশিক লম্বা। ১১৫ সে মি। পশ্চিমবঙ্গে চাষের সুপারিশ ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষেদর।
সত্ত্বাধিকারী অ্যাডভান্টা ইন্ডিয়া লিমিটেড (বর্তমানে ইউ পি এল)। জাতটি চষের জন্য ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় জাত অনুমোদন সংস্থার ছাড়পত্র পায়। বংশ পরিচয়ের কোড ৮৩৫ এ ও ৮৩৫ আর, এই দু’টি জাতের সংকরায়নে উদ্ভুত প্রথম অপত্য পুরুষ। ধান মাঝারি সরু। পাকতে লাগে ১২৫ – ১৩০ দিন। ধানে মোট চাল ৭২%, গোটা চাল ৫৯.০%. গাছ আংশিক লম্বা ১০৫ – ১১০ সে মি। ফলন ক্ষমতা হেক্টর পিছু ৫.৬ টন।
এই জাতটিরও সত্ত্বাধিকারী অ্যাডভান্টা ইন্ডিয়া লিমিটেড (বর্তমানে ইউ পি এল)। ২০০৯ সালে জাতটি ভারতে চাষের ছাড়পত্র পায়। ছাড়পত্র দেয় কেন্দ্রীয় জাত অনুমোদন সংস্থা। বংশপরিচয়ের কোড ৮৩৭ এ এবং ৮৩৭ আর, এই দু’টি জাতের সংকরায়নে জাত প্রথম অপত্য বংশ। পাকতে সময় লাগে ১৩০ দিন। ধান ছোট মোটা। ধানে মোট চালের ভাগ ৭১%, গোটা চাল ৫০%। চালের অ্যামাইলোজ ২৬%। ফলন হেক্টর পিছু ৬.০ টন। জাতটি ঝলসা সহনশীল। টুংরো ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিত ধসা রোগেও মাঝারি সহনশীল।
ধানের দু’টি দূর সম্পর্কীয় জাতের যৌন জননে প্রজনিত প্রথম পুরুষটির নাম হাইব্রিড ধান। অন্য কথায়, হাইব্রিড ধানের দু’টি জাতের মধ্যে সংকরীকরণের ফলে উদ্ভুত প্রথম অপত্য বংশধর। দু’টি জাতের মধ্যে সফল সংকরীকরণ সম্পন্ন করতে গেলে একটি জাতের ফুলের পরাগ অন্য জাতের গর্ভমুণ্ডে নিক্ষেপ করে নিষেক নিশ্চিত করা দরকার। হাইব্রিড ধানবীজ এই দু’টি উত্পাদক বীজের সমন্বয়ে উত্পাদিত। একটি জাতের কাজ শুধু পরাগ প্রদান করা। অন্য জাতটি অর্পিত পরাগরেণু নিজ গর্ভমুণ্ডে ধারণ করে জন্ম দেয় হাইব্রিড ধানবীজ।
স্ত্রী ধানের উপরোক্ত চরিত্র জাত নিরপেক্ষ। স্ত্রী ধান মাত্রেই ওই গুণগুলো থাকবে। কিন্তু একটি আদর্শ স্ত্রী ধানের নিন্মোক্ত অতিরিক্ত গুণ থাকে ---
পুরুষ ধানের পূর্বোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি জাত-নিরপেক্ষ সব ধরনের হাইব্রিড ধানের জন্য প্রযোজ্য সাধারণ চরিত্র। তবে এই সাধারণ গুণাবলি ছাড়াও আদর্শ পুরুষ ধানের নিম্নোক্ত অতিরিক্ত গুণ থাকা দরকার।
আদর্শ পুরুষ ধানের প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত গুণ ---
হাইব্রিড ধানের বীজ উত্পাদনের সাফল্য বীজমাতা ও পরাগপিতার যুগপৎ ফুল ফোটার ওপর নির্ভরশীল। বীজমাতা ও পরাগপিতার জীবনকালের মেয়াদ ভিন্ন ভিন্ন। দু’টি ভিন্ন মেয়াদি জাতে এক সঙ্গে ফুল ফোটাতে গেলে বীজতলায় দু’টি জাতের বাড়ন্ত কালের পার্থক্য মাথায় রেখে আগুপিছু বীজ ফেলা একান্ত প্রয়োজনীয়। স্বভাবতই বীজবপনের আগে বীজমাতা ও পরাগপিতার বীজবপনের সঠিক বিরামকাল নিরূপণ জরুরি। বিরামকাল নিরূপণের তিনটি পদ্ধতির মধ্যে দু’টি পদ্ধতি সহজগ্রাহ্য।
বিরামকাল দু’ ভাবে নিরূপণ করা যায়।
প্রথমত, স্ত্রী ও পুরুষ ধানের বাড়বৃদ্ধির স্থিতিকালজনিত পার্থক্য নির্ধারণ করে। অর্থাৎ স্ত্রী ও পুরুষ ধানের বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার পর ফুল আসতে কত দিন লাগে তা নথিভুক্ত করে।
দ্বিতীয়ত, এই দুটি ধানের পত্রসংখ্যাজনিত পার্থক্য নির্ধারণ করে। অর্থাৎ স্ত্রী ও পুরুষ ধানে কত পাতায় ফুল ধরে তা নিরূপণ করে।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে নির্ধারিত বিরামকাল খরিফ মরশুমে বিশেষ ভাবে কার্যকর। ধানের চারার বাড়ন্ত কাল নিম্ন তাপমাত্রার প্রভাবে দীর্ঘায়িত হয়। দু’টি ভিন্ন জাতের ধানের চারার ওপর নিম্ন তাপমাত্রার প্রভাব প্রায়শই বিষম হয়। বোরো মরশুমে বীজবপনের সময়ের সঙ্গে নিম্নতাপের স্থায়িত্ব ও তীব্রতার বাৎসরিক তারতম্য বিদ্যমান। সুতরাং বোরো মরশুমে কোনও বিশেষ বৎসরে বিশেষ সময়ে বীজ বপন করে বিরামকাল নিরূপণ করে পরবর্তী বৎসরে এমনকী সেই বৎসরে আগুপিছু বীজ ফেললে কার্যকর না হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।
তাপমাত্রা ছাড়াও ধানের মাঠ পরিচর্যার বিধিব্যবস্থাও ধানের ফুল আসাকে প্রভাবিত করে। মাঠে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল দাঁড়িয়ে গেলে বা মাটিতে রসের টান থাকলে আগুপিছু ফুল আসে। এই প্রথাজাতীয় অসুবিধা অবশ্য খরিফ বা রবি দুই মরশুমের জন্যই প্রযোজ্য।
বিরামকাল নিরূপণের এই দ্বিতীয় পদ্ধতিটি অপেক্ষাকৃত সঠিক এবং ভিন্ন ভিন্ন মরশুম ও বত্সরে সমান ভাবে কার্যকর। ধানের ফুল ফোটার সঙ্গে পত্রসংখ্যার নিবিড় যোগসূত্র আছে। প্রতিটি জাতেই নির্দিষ্ট পত্রসংখ্যায় ফুল আসে। পত্রসংখ্যার সঙ্গে ফুল ফোটার এই বন্ধনটি অপরিবর্তনীয়। তাপমাত্রা, জল-হাওয়া বা উচ্চতা পত্রসংখ্যার সঙ্গে ফুল ফোটার সম্পর্ককে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করতে পারে না। সুতরাং সঠিক বিরামকাল নিরূপণের জন্য পরাগপিতা ও বীজমাতার ফুল ফোটার জন্য প্রয়োজনীয় পত্রসংখ্যা নিরূপণ করা দরকার।
পাতার চরিত্র |
হিসাব |
---|---|
সম্পূর্ণ উন্মুক্ত পাতা |
১.০ |
প্রায় মুক্ত পাতা |
০.৮ |
অর্ধ মুক্ত পাতা |
০.৫ |
সদ্য গজানো পাতা |
০.২ |
এই প্রথা অনুসরণ করে যদি দেখা যায় পুরুষ ধানে ফুল আসছে ১৫ পাতায় আর স্ত্রী ধানে ১৮ পাতায় তা হলে বীজতলায় স্ত্রী ধানের চারায় ৩ পাতা আসলে পুরুষ ধানের বীজ বীজতলায় বাড়বে।
এ ছাড়া পুঞ্জিভূত তাপমাত্রার পার্থক্য নির্ধারণ করেও স্ত্রী ও পুরুষ ধানের বোনার সময় নিরূপণ করা যেতে পারে। চিন দেশের বিজ্ঞানীরা এই তৃতীয় পদ্ধতিটিকে অধিক গুরুত্ব দিলেও ভারতবর্ষে এই পদ্ধতি এখনও গ্রহণযোগ্য হয়নি।
পরাগপিতা -- ৩ – ৫ দিন অন্তর ২/৩ বারে
বীজ মাতা – একবারে
১. পরাগপিতার বীজ ৩ খেপে বুনলে
১ |
২ |
৩ |
৪ |
৫ |
৬ |
৭ |
৮ |
৯ |
১০ |
১১ |
১২ |
১৩ |
১৪ |
১৫ |
* |
|
|
* |
|
|
* |
|
|
|
* |
|
|
|
|
পরাগ পিতার ১ম দফার বীজবপন |
|
|
পরাগ পিতার ২য় দফার বীজ বপন |
|
|
পরাগ পিতার ৩য় দফার বীজ বপন |
|
|
|
বীজ মাতার বীজ বপন |
|
|
|
|
২. পরাগপিতার বীজ ২ খেপে বুনলে
১ |
২ |
৩ |
৪ |
৫ |
৬ |
৭ |
৮ |
৯ |
১০ |
১১ |
১২ |
১৩ |
১৪ |
* |
|
|
* |
|
|
* |
|
|
|
* |
|
|
|
পরাগ পিতার ১ম দফার বীজ বপন |
|
|
পরাগ পিতার ২য় দফার বীজ বপন |
|
|
|
বীজ মাতার বীজ বপন |
|
|
|
|
|
|
১. পরাগপিতার বীজ ৩ খেপে বুনলে
১ |
২ |
৩ |
৪ |
৫ |
৬ |
৭ |
৮ |
৯ |
১০ |
১১ |
১২ |
১৩ |
১৪ |
১৫ |
* |
|
|
|
|
|
* |
|
|
|
* |
|
|
|
* |
বীজ মাতার বীজ বপন |
|
|
|
|
|
পরাগ পিতার ১ম দফার বীজ বপন |
|
|
|
পরাগ পিতার ২য় দফার বীজ বপন |
|
|
|
পরাগ পিতার ৩য় দফার বীজ বপন |
২. পরাগপিতার বীজ ২ খেপে বুনলে।
১ |
|
|
|
৫ |
|
|
|
|
|
১১ |
|
|
|
১৫ |
* |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
* |
|
|
|
* |
বীজ মাতার বীজ বপন |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
পরাগ পিতার ১ ম দফার বীজ বপন |
|
|
|
পরাগ পিতার ২য় দফার বীজ বপন |
বীজের বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য হাইব্রিড ধানের বীজ উত্পাদনের ক্ষেত ধানের মাঠ থেকে যথেষ্ট দূরে থাকা দরকার। ধানের পরাগরেণু খুব ছোট ওবং হালকা। জীবনকালের স্থায়িত্ব মাত্র ৩ – ৫ মিনিট। কিন্তু এই স্বল্প জীবনকালের মধ্যেই পরাগরেণুগুলি বাতাসের ডানায় চেপে ১০০ মিটার পথ পাড়ি দিতে পারে। তাই অন্য ধানের মাঠ থেকে হাইব্রিড ধানের বীজ উত্পাদনের মাঠের অন্তরণ কম হলে অবাঞ্ছিত পরাগের প্রকোপে বীজমাতা দূষিত হয়ে পড়বে। আর দূষিত বীজমাতার গর্ভে উত্পাদিত হবে অশুদ্ধ/ভেজাল হাইব্রিড বীজ। হাইব্রিড ধানের বীজ উত্পাদনের মাঠ থেকে অন্য ধানের মাঠের সঠিক ব্যবধান তিন ভাগে বজায় রাখা যায়।
সারির উপরোক্ত অনুপাত, সারি থেকে সারি অথবা সারিতে গুছির বর্ণিত দূরত্ব পরিবেশ ভেদে পাল্টানো যেতে পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে করে মাঠে বীজমাতার প্রতি ৩টি শিষের জন্য পরাগপিতার একটি শিষ পাওয়া যায়।
রোপণ নকশা : পরাগপিতার বীজ ২ খেপে বুনলে |
ধান গাছে পতাকা পাতার একটি বিশেষ ভূমিকা আছে যা অন্যান্য পাতার চেয়ে ভিন্ন। পতকা পাতা সংশ্লেষিত শর্করা ও তৎসহ অন্য পদার্থ পরিবহন করে। দুধে দানাকে পরিপুষ্ট দানায় রূপান্তরিত করার মূল ভূমিকা এই পতাকা পাতার।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে পতাকা পাতা যখন দানা উৎপাদনের সঙ্গে এমন গভীর ভাবে যুক্ত, তখন এটা কেটে ফেলার কথা কেন বলা হচ্ছে ? দু’টো কারণে এই পাতা কাটার সুপারিশ করা হয়।
প্রথমত, ধানের শিষে ফুল ফোটার সময় পতাকা পাতার উপস্থিতি, হাওয়ার মাধ্যমে পরাগরেণু চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। দ্বিতীয়ত, পরীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে পতাকা পাতার আংশিক ছেদনে তার নীচের পাতাগুলির সংশ্লেষিত শর্করা সহ অন্যান্য খাদ্য পরিবহনের ক্ষমতা বেড়ে যায়। ফলে দানার পুষ্টি ও মোট উৎপাদন ব্যাহত হয় না। আর পাতার সবটুকু অংশ তো কাটার কথা বলা হয় না। আংশিক মাত্র।
পতাকা পাতার ডগা থেকে ১/২ — ২/৩ অংশ কেটে ফেলতে হবে যখন গাছে থোড় আসতে আরম্ভ হয়।
পাতা কাটার ফলে গাছের যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, সেখান দিয়ে নানান রোগ জীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে। এই কারণে পাতা কাটার পর ফসলে ম্যাঙ্কোজেব বা কার্বান্ডাজিম প্রয়োগ করতে হবে।
ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা ধসা (বি এল বি) বা পাতায় ছোপ ধরা (বি এস এল) অথবা ছত্রাকঘটিত খোলা ধসা (এস এইচ বি) রোগে আক্রান্ত ফসলে পতাকা পাতা কাটা চলবে না।
সংকর ধান বীজ উৎপাদনে বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তির মধ্যে সময়মতো জিব্বারেলিক অ্যাসিডের প্রয়োগ একটি অন্যতম প্রযুক্তি। জিব্বারেলিক অ্যাসিড একটি রাসায়নিক যৌগ যা জিব্বারেলা ফুজিকুরোই নামে একটি ছত্রাক থেকে উদ্ভুত। দেখা গেছে এই যৌগের প্রয়োগে গাছের বিভিন্ন উপকার সাধিত হয়। সাধারণ ভাবে এই যৌগটি জি এ – ৩ নামে পরিচিত।
বাজারে জি এ - ৩ চুর্ণ হিসাবে পাওয়া যায়। সাধারণত দু’ রকম চুর্ণ পাওয়া যায়। এক রকমের যাতে শতকরা ১০০ ভাগ ও অন্য রকমের যাতে শতকরা ৯০ ভাগ জি এ - ৩ থাকে। এর ওপরই কতটা দ্রবণ ব্যবহার করতে হবে তা নির্ভরশীল।
দ্রবণে জি এ - ৩ কতটা থাকবে তা প্রতি দশ লক্ষ ভাগে রাসায়নিকটি কতটা থাকবে অর্থাৎ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) হিসাবে প্রকাশ করা হয়।
মোটামুটি এক একর জমিতে সাধারণ স্প্রেয়ারের সাহায্যে প্রয়োগের জন্য ২০০ লিটার জল লাগবে, আর আল্ট্রা লো ভল্যুম (ইউ এল ভি) স্প্রেয়ারের সাহায্যে প্রয়োগের জন্য ৮০ লিটার জল লাগবে।
জি এ ৩ প্রয়োগের মাত্রা প্রতি দশ লক্ষ ভাগে
|
সাধারণ স্প্রেয়ার |
আল্ট্রা লো ভল্যুম স্প্রেয়ার |
প্রথমবার |
৬০ |
৫০০ |
দ্বিতীয়বার |
৩০ |
২৫০ |
আরও বিশদ ব্যাখার জন্য পরের সারণিতে প্রকৃতপক্ষে কতটা জি এ ৩ লাগবে তার নির্দেশ দেওয়া হল।
জমির এলাকা (বর্গমি) |
জলের পরিমাণ (লিটার) |
জি এ – ৩-এর পরিমাণ (গ্রাম)
|
|||
|
|
১০ লক্ষে ৬০ ভাগ |
১০ লক্ষে ৩০ ভাগ |
||
|
|
১০০% |
৯০% |
১০০% |
৯০% |
সাধারণ স্প্রেয়ার |
|||||
১০০০ (২৫ শতক) |
৫০ |
৩.০ |
৩.৩ |
১.৫ |
১.৭ |
৪০০০ (এক একর) |
২০০ |
১২.০ |
১৩.২ |
৬.০ |
৬.৮ |
১০০০০ ( এক হেক্টর) |
৫০০ |
৩০.০ |
৩৩.০ |
১৫.০ |
১৭.০ |
আল্ট্রা লো ভল্যুম স্প্রেয়ার (ইউ এল ভি) |
|||||
১০০০ (২৫ শতক) |
২ |
১.০ |
১.১ |
০.৫ |
০.৬ |
৪০০০ (এক একর) |
৮ |
৪.০ |
৪.০ |
২.০ |
২.৪ |
১০০০০( এক হেক্টর) |
২০ |
১১.০ |
১১.০ |
৫.০ |
৬.০ |
স্বাভাবিক ভাবে ধানে হাওয়ার মাধ্যমেই পরাগরেণু সংযোজিত হয়। হাইব্রিড ধান বীজ উৎপাদনে শুধু মাত্র হাওয়ার ওপর নির্ভরশীল না থেকে কৃত্রিম উপায়ে সম্পূরক পরাগ সংযোজনের ব্যবস্থা নিলে ফল ভালো পাওয়া যায়। উদ্দেশ্য পরাগথলি ফেটে অধিক পরিমাণে পরাগরেণু যাতে স্ত্রী কেশরের চারি পাশের বাতাসে ভেসে বেড়িয়ে বন্ধ্যা পরাগ সমন্বিত স্ত্রী ধানের গর্ভদান নিশ্চিত করতে পারে।
সম্পূরক পরাগ সংযোজন দু’ ভাবে ঘটানো যেতে পারে :
কয়েকটি লক্ষণীয় বিষয় :
ধানের জমিতে অবাঞ্ছিত গাছ মানে শুধু আগাছাই নয়। এ লাইন (স্ত্রী ধান) বা আর লাইন (পুরুষ ধান)-এর সারিতে যে সব গাছ সঠিক প্রকৃতির নয় সে সবই অপসারণ করতে হবে। অবাঞ্ছিত গাছের প্রকাশ, বিশেষ ভাবে স্ত্রী ধানের সারিতে বেশি দেখা যেতে পারে। পুরুষ ধানের সারিতেও অবশ্য মিশেল গাছ পাওয়া যেতে পারে।
গাছের জীবনকালের তিন অবস্থায় অবাঞ্ছিত গাছ অপসারণের কাজ করতে হবে। যথা :
প্রথম দু’ দফায় অবাঞ্ছিত গাছ গোড়া শুদ্ধ তুলে পা দিয়ে কাদায় চেপে দিতে হবে। ফসল কাটার সময় অবাঞ্ছিত গাছ গোড়া থেকে তুলে আলাদা করে বীজ উৎপাদন ক্ষেতের বাইরে জড়ো করে রাখতে হবে / ফেলে দিতে হবে।
হাইব্রিড ধানের আদর্শ বীজ উৎপাদন মূলত স্ত্রী ও পুরুষ ধানের যুগপৎ প্রস্ফুটনের ওপর নির্ভরশীল। সঠিক বিরামকাল নিরূপণ করে উভয় ধানের বীজ বপন করলেই মূল জমিতে দু’টি ধানের এক সঙ্গে ফুল ধরবে এমন কথা বলা যায় না। পরবর্তী পর্যায়ের পরিচর্যা দু’টি ধানের ক্ষেত্রে দু’ রকম হয়ে পড়লে যুগপৎ প্রস্ফুটন বিঘ্নিত হতে পারে। এমনকী শস্যের জীবনকালে আবহাওয়ার পরিবর্তন এক সঙ্গে ফুল ধরার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমতাবস্থায় যুগপৎ প্রস্ফুটন সুনিশ্চিত করতে গেলে উভয় ধানের খোলের ভেতর শিষের অগ্রগতি অনুসরণ করে বাড়বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি প্রয়োজনমতো নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।
পাশকাঠি সর্বোচ্চ সংখ্যায় উন্নীত হওয়ার পরপরই ধানের খোলে শিষের জন্ম সূচিত হয়। জন্মের পর থেকে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে শিষের পূর্ণাঙ্গ দশা প্রাপ্ত হতে প্রায় ৩০ দিন সময় লাগে। ক্রমবিবর্তনের এই সুদীর্ঘ পর্যায় ১০টি দফায় বিভক্ত। দু’টি ধানে (স্ত্রী ও পুরুষ) এক সঙ্গে ফুল ধরতে গেলে ক্রমবিবর্তনের এই পর্যায়গুলি উভয় ধানে সমান তালে চলা দরকার। সেই জন্যই শিষের জন্ম সূচিত হওয়া শুরু থেক উভয় ধানের নমুনা সংগ্রহ করে খোলের ভেতর বাড়ন্ত শিষের অগ্রগতির হার নিরুপণ করা আবশ্যিক। নমুনা সংগ্রহ করে শিষের বাড়বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি নিরীক্ষা করতে গেলে ধানের খোলের ভেতর বাড়ন্ত শিষটি ঠিক কখন থেকে দৃষ্টিগোচর হবে তার সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার। বীজ অঙ্কুরোদগমের পর শিষের জন্ম মূলত জাতের মেয়াদের ওপর নির্ভরশীল।
শীষের জন্মবার্তা নির্দেশিকা |
|
জাতের মেয়াদ ( দিনের হিসাবে ) |
শিষের সূচনা ( বোনার পর থেকে দিনের হিসাবে ) |
৯৫ - ১০০ |
৪০ – ৪৫ |
১০৫ – ১১০ |
৫০ – ৫২ |
১১৫ – ১২০ |
৬০ – ৬২ |
১২৫ – ১৩০ |
৬৫ – ৭০ |
খরিফ মরশুম ভিত্তিক তথ্য
উপরোক্ত সময়সূচি মোতাবেক মাঠের বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েক দফায় স্ত্রী ও পুরুষ ধানের নমুনা সংগ্রহ করে খোলার ভেতর শিষের বাড়বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি নথিভুক্ত করতে হবে।
শিষের বাড়বৃদ্ধির বিভিন্ন দশা
দশা |
কাল (ফুল ফোটার প্রায়) |
পিরণতি (শীষের দৈর্ঘ্য মিমি ) |
||
এক |
: |
শিষের সূচনা |
৩০ দিন আগে |
০.২ |
দুই |
: |
শিষের শাখার সূচনা |
২৭ দিন আগে |
০.৪ |
তিন |
: |
শিষের প্রশাখার সূচনা |
২৪ দিন আগে |
১.৫ |
চার |
: |
পুংকেশর এবং গর্ভ কেশরের সূচনা |
২০ দিন আগে |
২.০ |
পাঁচ |
: |
পরাগ মাতৃকোষের আত্মপ্রকাশ |
১৭ দিন আগে |
১০ – ২৫ |
ছয় |
: |
পরাগ মাতৃকোষের বিভাজন |
১২ দিন আগে |
৮০ |
সাত |
: |
পরিপূর্ণ পরাগ |
৬ দিন আগে |
১৯০ – ২৫০ |
আট |
: |
পরিণত পরাগ |
৪ দিন আগে |
২৬০ |
নয় |
: |
স্পাইকলেট উত্পাদনের সমাপ্তি |
২-১ দিন আগে |
২৭০ |
দশ |
: |
ফুল ফোটা |
|
|
আতসকাচের তলায় দৃশ্যমান ধানের শিশু শিষ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে পরিণত হয়ে যখন ধানের খোলার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে তখনই ধানে ফুল ধরে। ধানের শিষের এই ক্রমবিবর্তন ১০টি স্বতন্ত্র দশায় বিভক্ত। মোট ১০টি দশার মধ্যে যুগপৎ প্রস্ফুটনের স্বার্থে প্রাথমিক পর্যায়ের চারটি দশায় শিষের বাড়বৃদ্ধির গতি প্রকৃতি নিবিড় ভাবে অনুসরণ করা একান্ত প্রয়োজনীয়। ধানের শিষের এই বিভিন্ন স্বতন্ত্র দশার অনন্যপরতা নীচে দেওয়া হল। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক ঠিক নিরীক্ষণ করলে স্ত্রী ও পুরুষ ধানের কোনটিতে কখন ফুল ধরবে তা সঠিক ভাবে বলা যাবে।
শিষের বাড়বৃদ্ধির দশা
স্ত্রী ও পুরুষ ধানের খোলার ভেতর বাড়ন্ত শিষের অগ্রগতি পর্যালোচনা করলে উভয় ধানে ফুল আসার দিনক্ষণ সম্পর্কে আগাম ধারণা করা যাবে। উভয় ধানের শিষের বাড়বৃদ্ধি পর্যালোচনা করে পুরুষ ও স্ত্রী ধানের মধ্যে ফুল ফুটতে ৩ দিনের বেশি তফাৎ হতে পারে বলে মনে হলে যুগপৎ ফুল ফোটানোর জন্য বিশেষ নিয়ন্ত্রণ বিধি মানা দরকার। স্ত্রী ও পুরুষ শিষের বিষম বাড়বৃদ্ধিজনিত পরিস্থিতির মোকাবিলায় কী জাতীয় নিয়ন্ত্রণবিধি অনুসরণ করা প্রয়োজন হতে পারে তা কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে উপস্থাপিত করা হল।
পুং ধান * শিষের বাড়বৃদ্ধির দশা -১
স্ত্রী ধান * শিষের বাড়বৃদ্ধির দশা – ৪
প্রত্যাশা
যুগপৎ ফুল ধরাতে গেলে
করণীয়
স্ত্রী ধানের সারিতে
ইউরিয়া সারের শতকরা ২ ভাগ জলীয় দ্রবণ ছেটানো।
পুরুষ ধানের সারিতে
পুং ধান * শিষের বাড়বৃদ্ধির দশা – ৪
স্ত্রী ধান * শিষের বাড়বৃদ্ধির দশা -১
প্রত্যাশা
যুগপৎ ফুল ধরাতে গেলে
করণীয়
স্ত্রী ধানের সারিতে
পুং ধান * শিষের বাড়বৃদ্ধির দশা ৫ ও ৬ – এর মাঝামাঝি
স্ত্রী ধান * শিষের বাড়বৃদ্ধির দশা -১
প্রত্যাশা
করণীয়
পুরুষ ধানে ফুল আসতে স্ত্রী ধানের চেয়ে ৬ – ৭ দিন সময় বেশি লাগলে পরাগপিতা ও বীজমাতার যুগপৎ প্রস্ফুটনের জন্য উভয় শিষের বাড়বৃদ্ধির আদর্শ চিত্র হবে নিম্নরূপ :
ট্রান্সজেনিক বীজ জেনেটিক মডিফায়েড বীজ বলেই সমধিক পরিচিত। জেনেটিক মডিফায়েড বীজ বলতে সেই বীজকেই বোঝায় যার বংশানুগত মৌলিক উপাদানের কৃত্রিম পরিবর্তনের ফলে এক বা একাধিক চরিত্রের উন্নয়ন সাধিত হয়েছে অথবা কোনও নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদনের নিমিত্ত অভিনব গুণ অর্জন করেছে। জীবকোষে নিহিত এই মৌলিক উপাদান রাসায়নিক পরিভাষায় ডি অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড অর্থাৎ ডি এন এ। এই ডি এন এ-র ওপর থরে থরে সজ্জিত থাকে নির্দিষ্ট প্রোটিন উৎপাদনের সংকেতবাহী বংশানু বা জিন। জীবের প্রতিটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পিছনে থাকে নির্দিষ্ট প্রোটিনের হাত। সহজ কথায় জেনেটিক মডিফেকশন হল বংশগতির রূপান্তরসাধন, যা সাধিত হয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সংকেতবাহী জিন স্থানান্তর বা অদলবদলের ফলে। যুগ যুগ ধরে বংশগতির রূপান্তর ঘটে চলেছে। জেনিটিক মডিফিকেশন প্রকৃতির নিয়ম। বিবর্তনের কাণ্ডারি। জেনেটিক মডিফিকেশনের হাত ধরেই কোটি কোটি বছর আগে সৃষ্ট জেলির মতো আকৃতিবিহীন থলথলে প্রাণ থেকে আজকে উন্নত জীব জগতে উত্তরণ। আজকের ভারতে ধানের যে সমস্ত উচ্চফলনশীল (উফশী) অথবা হাইব্রিড জাতের চাষ চলছে একশো বছর আগেও তার কোনও অস্তিত্ব ছিল না। দেশি জাতের বংশগতির রূপান্তরের হাত ধরে এসেছে এই জাতগুলো।
ট্রান্সজেনিক ধানও জেনেটিক মডিফায়েড ধানের জাত। কিন্তু এই জাত উদ্ভাবনের পদ্ধতি এ তাবৎ চালু পদ্ধতি অপেক্ষা ভিন্ন। এত দিন পর্যন্ত জিন স্থানান্তর বা অদলবদলের কাজটা সম্পাদিত হয়েছে পরাগমিলনের মাধ্যমে। যে মিলনের ঘটক কখনও প্রকৃতি, কখনও মানুষ। এই চিরায়ত প্রথায় জিনের বিচরণ আবদ্ধ ছিল একই প্রজাতির নিকট আত্মীয়দের মধ্যে। যেমন ধানের জিন ধানে এবং গমের জিন কেবলমাত্র গমেই স্থানান্তর করা যেত। জিন বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এই বাধা সরে গেছে। বর্তমানে যে কোনও জীবিত কোষ থেকে জিন তুলে নিয়ে যে কোনও জীবিত কোষে স্থানান্তর করার প্রযু্ক্তি এখন মানুষের হাতে। এই বিশেষ পদ্ধতিতে জিন স্থানান্তরকরণ প্রক্রিয়া পরাগবাহিত নয়। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে বিভিন্ন উৎস থেকে জিন তুলে নিয়ে ধানের প্রচলিত জাতের মধ্যে অনুপ্রবেশ করিয়ে উদ্ভাবিত হচ্ছে ধানের রোগ পোকা প্রতিরোধক জাত, উন্নতপুষ্টি সমৃদ্ধ ধান। যে জিনের মাধ্যমে প্রচলিত জাতটি সমৃদ্ধ হচ্ছে সেই কাঙ্খিত জিন কখনও আসছে অনাত্মীয় উদ্ভিদ থেকে, কখনও বা ব্যাকটেরিয়ার কোষ থেকে। মাটির জীবাণু ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস থেকে জিন তুলে তৈরি হয়েছে ধানের মাজরা পোকা প্রতিরোধক জাত, ড্যাফোডিল ফুলের গাছ ও এরুনিয়া ব্যাকটেরিয়া থেকে জিন তুলে তৈরি হয়েছে ভিটামিন সমৃদ্ধ ধান। আবার ‘সয়াবিন’ থেকে জিন তুলে ধানে প্রতিস্থাপন করে তৈরি হয়েছে এমন ধানের জাত যার অন্ত:ত্বকে লৌহের মাত্রা সাধারণ ধানের ৫ – ৬ গুণ। এই সবক’টি ধানই বাণিজ্যিক ছাড়পত্রের দিন গুনছে। পরাগরেণুর ওপর ভর না করে এই বিশেষ প্রযুক্তির গর্ভজাত রূপান্তরিত বংশগতির ধানই ট্রান্সজেনিক ধান। বর্তমানে যে তিনটি ট্রান্সজেনিক ধানের ছাড়পত্রের কথা বিভিন্ন দেশ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে তারা হল :
এর মধ্যে চিন দেশে ইতিমধ্যেই বিটি ধানের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে।
জুরিখের সুইস ফেডারেল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির বিজ্ঞানী ড. ইংগো পট্রিকিউস ও জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ড. পিটার বেয়ারের যৌথ প্রচেষ্টায় ধানের শাঁসে (অ্যান্ডোসপার্ম) প্রতিস্থাপিত হল অনাত্মীয় উৎসের বিটাক্যারোটিন উৎপাদিত তিনটি জিন। তিনটি জিনের মধ্যে দু’টি জিন (পি এস ওয়াই এবং লি ওয়াই সি) আনা হল ড্যাফোডিল ফুল গাছের ক্রমোজোম থেকে। তৃতীয়টি এল এরুনিয়া জীবাণুর ক্রমোজোম থেকে। ধানের ক্রোমোজমে এই তিনটি জিন প্রতিস্থাপনের ফলে শাঁসে সংশ্লেষিত হল বিটাক্যারোটিন। শাঁসের সাদা রঙ বদলে হল হলুদ। বিটাক্যারোটিন যুক্ত খাবার থেকেই মানুষের শরীরে ভিটামিন-এ সংশ্লেষিত হয়। তাই বিটাক্যারোটিনে প্রোভিটামিন – এ নামে পরিচিত।
ধানের এই বিস্ময়কর পরিবর্তনের জন্য বিজ্ঞানীদ্বয় বেছে নিয়েছিলেন জাপানি ধানের জাত টি ৩০৯। সোনা রঙের শাঁসের জন্যই জাতটির নতুন নামকরণ হল স্বর্ণালি ধান বা গোল্ডেন রাইস। ধানের কোনও প্রজাতিই তার শাঁসে বিটাক্যারোটিন উৎপাদন করতে পারে না। তবে ধানের সব প্রজাতির কাঁচা শাঁসে একটি রাসায়নিক যৌগ উৎপাদিত হয়। তার নাম জেরানিল জেরানিল ডাইফসফেট (জি জি ডি পি)। এই জি জি ডি পি ভেঙে বিটাক্যারোটিন তৈরি হতে লাগে তিনটি উৎসেচক। এই তিনটি উৎসেচক উৎপাদনের পিছনে আছে ৩টি জিন। বিজ্ঞানীদ্বয় যা তুলে আনলেন অনাত্মীয় ড্যাফোডিল ফুল ও এরুনিয়া জীবাণুর ক্রমোজোম থেকে। পট্রিকিউস ও বেয়ার উদ্ভাবিত ভিটামিন –এ সমৃদ্ধ এই ধানটির নাম এস জি আর – ১। পরীক্ষাগারে রাসায়নিক পরীক্ষায় এই ধানের প্রতি গ্রাম চালে ১.৬ মিউগ্রাম ক্যারোটিনয়েডস পাওয়া গেল। ২০০৫ সালে প্রতি গ্রাম চালে ক্যারোটিনয়েডের পরিমাণ বাড়িয়ে ৩৭ মিউ গ্রাম উন্নীত করে সিনজেনটা কোম্পানি উদ্ভাবন করল দ্বিতীয় গোল্ডেন রাইস, এস জি আর -২। এই ৩৭ মিউগ্রাম ক্যারোটিনয়েডের মধ্যে ৩১ মিউগ্রামই বিটাক্যারোটিন। দ্বিতীয় গোল্ডন রাইস জাতটিতে বিটাক্যারোটিনের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সিনজেন্টার বিজ্ঞানীরা তুলে আনলেন ভুট্টার ক্রমোজোম থেকে ফাইটোন সংশ্লেষকারী জিন ও বিটাক্যারোটিন উৎপাদিত আদি ধানের জাত, এস জি আর – ১ থেকে সি আর টি- ১ জিন।
মানুষের শরীরে ভিটামিন এ ঘাটতি ( ভি এ ডি ) হলে দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভি এ ডির প্রভাবে ভারতবর্ষে প্রতি বছর ২৫০ – ৫০০টি শিশু অন্ধ হয়ে যায়। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউট্রিশনের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ধরা পড়ছে ভারতবর্ষের ৬২ শতাংশ শিশুর রক্তে ভিটামিন –এর পরিমাণ প্রতি ডিসিলিটারে ২০ মিউগ্রামের তলায়। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে রক্তে ভিটামিন-এ-র এই মাত্রা দৃষ্টিশক্তির পক্ষে চূড়ান্ত ক্ষতিকারক। কেবলমাত্র ভারতবর্ষেই নয়, উন্নয়নশীল বা অনুন্নত সব দেশই ভি এ ডি –র প্রতাপ আশঙ্কাজনক। কারণ যে সমস্ত সবজি, ফল অথবা মাছ-মাংসে প্রচুর পরিমাণ ক্যারোটিনয়েড পাওয়া যায় তা এই সমস্ত দেশের অধিকাংশ মানুষের নাগালের বাইরে। অথচ দু’ বেলা দু’ মুঠো ভাত এই সমস্ত দেশের অধিকাংশের করায়ত্ত। প্রতি দিন সিনজেন্টা উদ্ভাবিত এই গোল্ডেন রাইস – ২-র ১৪৪ গ্রাম চালের ভাত খেলেই শরীরের ভিটামিন এ চাহিদা মিটবে।
বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এই জাতটিকে সমগ্র মানব জাতির কল্যাণে ব্যবহারের জন্য পেটেন্টমুক্ত করেছন। বিশ্বের অনেক দেশই বর্তমানে এই জাতটির বাণিজ্যিক চাষের ছাড়পত্র দেওয়ার কথা চিন্তা করতে শুরু করেছেন।
ভারতবর্ষে যে গুটিকয়েক পোকার আক্রমণে প্রতি বছর ধানের ফলনের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলুদ মাজরা পোকা। মাজরা পোকার আক্রমণে স্থান, কাল ও মরশুম ভেদে ধানের ফলনে নথিভুক্ত ক্ষতির পরিমাণ ৩ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ (সূত্র : বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়)।
এই পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা বেশ শক্ত। কেননা শুককীট ডিম ফুটে বেরিয়ে সিঁদ কেটে ধান গাছের মূল কাণ্ড বা পাশকাঠির মধ্যে ঢুকে বসে নরম কলা খাওয়া শুরু করে। ফলে ধানের বয়স ভেদে কাণ্ডের ডগা শুকিয়ে কিংবা কাণ্ড ভেঙে নতুবা চিটে যুক্ত সাদা শিষ হয়ে ফলের ক্ষতি করে। দৃশ্যত ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত পোকার অস্তিত্ব বোধগম্য হয় না। পোকাটি কাণ্ডের ভিতরে থাকার ফলে স্পর্শবিষে কাজ হয় না। আবার অন্তর্বাহী বিষ ব্যবহার করেও সিংহ ভাগ ক্ষতি আটকানো যায় না। কেননা অন্তর্বাহী বিষ শিকড়ের পথ ধরে কোষের রসে পৌঁছতে যে সময় লাগে তা ধানের ফলনের লক্ষণীয় ক্ষতির জন্য যথেষ্ট। ফিলিপাইনসের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র ব্যবহৃত ধানের ৩৯০০০ জাত পরীক্ষা করেও মাজরা পোকা প্রতিরোধক কোনও জাত চিহ্নিত করতে পারেনি। দেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ধান গবেষণা কেন্দ্রেও সহস্রাধিক ধানের জাত পরীক্ষা করা হয়েছে। পাওয়া যায়নি মাজরা প্রতিরোধক জাত। তাই প্রচলিত প্রথায় উদ্ভাবন করা যায়নি মাজরা প্রতিরোধক জাত।
জৈববিজ্ঞানীরা মাজরা পোকা প্রতিরোধক কাঙ্খিত জিনের খোঁজ পেলেন মাটি জীবাণু ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিসের ক্রেমোজোমে। এই জীবাণুটির অনুপম বৈশিষ্ট্য হল শরীরের অভ্যন্তরে ১৭০টির বেশি স্ফটিকাকৃতির প্রোটিন উৎপাদন। এই প্রোটিনগুলোর কীটনাশক ধর্ম বর্তমান। স্ফটিকাকৃতি প্রোটিনের ইংরাজি নাম ক্রিসটাল প্রোটিন। তাই এই প্রোটিন উৎপাদী জিনের নামের শুরুতে ক্রাই শব্দ ব্যবহার করা হয়। যেমন ক্রাই-এসি জিন, ক্রাই-৯ সি জিন ইত্যাদি। ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিসের ডাক নাম বি টি — ব্যাসিলাসের বি এবং থুরিনজিয়েনসিসের টি। অধিকাংশ বিটি বিষই কীট নির্দিষ্ট। জৈববিজ্ঞানীরা দেখলেন বিটি জীবাণুর ক্রোমোজোম যে শতাধিক ক্রিসটাল প্রোটিন উৎপাদী জিন আছে তার মধ্যে ক্রাই- এবি, ক্রাই- এএ, ক্রাই- এসি ও ক্রাই- ২ এবি জিনগুলো ধানের মাজরা পোকা দমনে সক্ষম। বিজ্ঞানীরা এই জিনগুলো বিটি জীবাণুর ক্রোমোজোম থেকে ছিঁড়ে নিয়ে এসে জুড়ে দিলেন ধানের ক্রোমোজোমে। তৈরি হল মাজরা পোকা প্রতিরোধক ধান। ভারতবর্ষে যে সব গবেষণা সংস্থার পরীক্ষাগারে এই ধানগুলো উদ্ভাবিত হয়েছে তাদের নাম ও তাদের তৈরি ধানের জাতে প্রতিস্থাপিত বিটি জিনের নাম নীচে দেওয়া হল
গবেষণা সংস্থা |
প্রতিস্থাপিত বিটি জিন |
১ ) ডি আর আর, হায়দরাবাদ |
ক্রাই – এবি |
২ ) মাহিকো, মুম্বই |
ক্রাই – এসি ও ক্রাই – ২ এবি |
৩ ) মেটা হেলিক্স |
ক্রাই – এসি |
৪ ) আই আর আই, নিউ দিল্লি |
(ফিউশন জিন) |
বিট বিষ জিন প্রতিস্থাপিত ধানটি পাতা মোড়া পোকার আক্রমণও প্রতিরোধ করতে পারে।
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের এক মারাত্মক ব্যাধি রক্তাল্পতা। শিশু ও মেয়েদের মধ্যে এই রোগের ব্যাপকতা ক্রমশই বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলেছে উন্নয়নশীল দেশের ৪১ শতাংশ মেয়ে রক্তাল্পতা ব্যাধির শিকার। আবার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউট্রিশনের (এন আই এন) সমীক্ষায় ধরা পড়েছে ভারতবর্ষে ৫ বছেরর নীচে শিশুদের মধ্যে ৭০ শতাংশ শিশু রক্তাল্পতায় ভুগছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ৬১ শতাংশ শিশু এই রোগের শিকার। রক্তাল্পতা রোগের কারণ রক্তে আয়রনযুক্ত প্রোটিনের অভাব। প্রতি ডেসিলিটার রক্তে এই প্রোটিনের পরিমাণ ১৩ গ্রামের তলায় চলে গেলে রক্তাল্পতার উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। যার অবশ্যম্ভাবী ফল মনসংযোগ ও স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া। শরীর দুর্বল হয়ে পড়া। স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ কমানোর জন্য দিল্লির সরকারি স্কুলে ১০ - ১৯ বছরের ছাত্রদের মধ্যে বিনামূল্যে আয়রন ট্যাবলেট বিতরণ করা হচ্ছে। চালনির্ভর দৈনিক খাদ্য তালিকায় যে সমস্ত মহার্ঘ আহারের উপস্থিতি শরীরে আয়রন চাহিদা মেটাতে পারে তা আমাদের মতো গরীব মানুষের দেশে অধিকাংশের নাগালের বাইরে।
জৈববিজ্ঞানীরা তাই ট্রান্সজেনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এই সমস্ত দেশের প্রধান খাদ্য চালের মধ্যে আয়রনের মাত্রা বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন সাধারণ চালে প্রতি কেজিতে ১২ – ১৩ মিগ্রা আয়রন থাকে। অধিকাংশ আয়রন আবার থাকে চালে বহি:ত্বকে। মিলে পালিশ করার সময় যার ৫০ – ৬০ শতাংশ বেরিয়ে যায়। পালিশ করা প্রতি কেজি চাল তাই সাধারণ ভাবে ৫ – ৬ মিগ্রার বেশি আয়রন থাকে না। প্রয়োজন চালের অন্ত:ত্বকে আয়নরের মাত্রা বাড়ানো। আর তা করতে হলে চালের অন্ত:ত্বকে এমনই এক জিন প্রতিস্থাপন করা দরকার যা চালের আয়রনকে অন্ত:ত্বকে বেঁধে রাখবে। এই ধরনের জিনের খোঁজ পাওয়া গেছে সয়াবিন, মটর ও ভুট্টার মধ্যে। বিজ্ঞানীরা এই জিনের নামকরণ করেছন ‘ফেরিটিন’ জিন কেননা এই জিনটি ফেরিটিন নামক প্রোটিনের উৎপাদক। ফেরিটিন প্রোটিনের কাজই হল আয়রন বেঁধে রাখা। জৈববিজ্ঞানীরা দেখলেন আয়রনকে শুধুমাত্র অন্ত:ত্বকে বেঁধে রাখলেই চলবে না, ভাতের মাধ্যমে শরীরের দৈনিক আয়রন চাহিদা মেটাতে গেলে ধানের পাতা থেকে শাঁসে (অ্যান্ডোস্পার্ম) আরও অধিক পরিমাণে আয়রন পাঠাতে হবে। সুতরাং দরকার একটি আয়রনবাহক জিন। ফিলিপাইনসের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ২০০৩ সালে এই দু’টি অনাত্মীয় জিনকে ধানের প্রচলিত জাত আই আর ৬৪-এর মধ্যে প্রতিস্থাপন করে উদ্ভাবন করলেন এমন ধানের জাত যার অন্ত:ত্বকে আয়রনের মাত্রা সাধারণ ধান অপেক্ষা ৫ – ৬ গুণ বেশি। উদ্ভাবিত এই নতুন ট্রান্সজেনিক চালের প্রতি কেজি চালের অন্ত:ত্বকে আয়রনের পরিমাণ ৩৪ মিগ্রা। ভারতীয় মেডিক্যাল গবেষণা পর্ষদের সুপারিশ অনুযায়ী মেয়েদের দৈনিক ৩২ মিগ্রা আয়রন আহরণ করা দরকার। শিশুদের ক্ষেত্রে একটু কম।
আয়রন সমৃদ্ধ ট্রান্সজেনিক ধান আমাদের দেশেও উদ্ভাবিত হয়েছে। জাতটি আপাতত দেশের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্রুভাল কমিটির নিয়ন্ত্রণে মাঠ পরীক্ষার অপেক্ষায়।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 1/28/2020
আধুনিক বিজ্ঞানমতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে প্র...