প্রায় সারা বছরে ধানের চাষ হয়। তবে বোনা ও কাটার সময়ের ভিত্তিতে ধানের চাষকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। (ক) আউশ (খ) আমন (গ) বোরো।
কৃষি জলবায়ু অঞ্চল ভেদে মূলত বৃষ্টির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আউশের বীজ বোনা শুরু হয় ফাল্গুন মাস (১৫ ফেব্রুয়ারি) থেকে। চলে আষাঢ় মাস পর্যন্ত (১৫ জুলাই)। আর বোনার সময় ভেদে জ্যৈষ্ঠ (১৫ মে) মাসে শুরু হয়ে কাটা চলে আশ্বিন মাস (১৫ অক্টোবর) পর্যন্ত।
দো-আঁশ মাটির যে কোনও জমিই আউশ ধান চাষের উপযুক্ত। আউশ ধানের চল প্রধানত বৃষ্টি-নির্ভর উঁচু অথবা মাঝারি অবস্থানের জমিতেই। তবে সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে অধিকাংশ আউশ বর্তমানে সেচসেবিত। ফলে আগে যেখানে অধিকাংশ আউশের জমিতে বীজ সরাসরি মাটিতে বোনা হত এখন সেখানে রোয়া হয়।
অন্য দিকে আমনের বীজ বীজতলায় পড়তে শুরু করে আষাঢ় মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে (১৫ জুলাই)। রোয়া শুরু হয় শ্রাবণ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে (১৫ আগস্ট) আশ্বিন মাঝের মাঝামাঝি পর্যন্ত (১৫ সেপ্টেম্বর)। নিচু জিম যেখানে বর্ষার শুরুতেই এক থেকে দেড় ফুট জল দাঁড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল সেই সমস্ত অঞ্চলে অবশ্য আলোক সংবেদনশীল দীর্ঘমেয়াদি আমন ধানের বীজ মূল জমিতে সরাসরি বোনা হয় চৈত্র মাসের মাঝামাঝি (১৫ এপ্রিল) থেকে। আমন কাটা শুরু হয় কার্তিক মাসের মাঝামাঝি (অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ), চলে পৌষ মাস পর্যন্ত (১৫ জানুয়ারি)। সর্বভারতীয় স্তরে অবশ্য আউশ ও আমনকে এক সঙ্গে মিশিয়ে খরিফ ধান বলা হয়।
বেলে, দো-আঁশ থেকে এঁটেল মাটির উঁচু, মাঝারি বা নিচু যে কোনও জমিতেই আমন ধান চাষ করা যেতে পারে। আমনের চাষ মূলত বৃষ্টি-নির্ভর। সেচসেবিত এলাকাতেও কেবলমাত্র বৃষ্টির অভাবেই সেচ ব্যবহৃত হয়।
বোরো ধানের বীজ বীজতলায় পড়তে শুরু করে অগ্রহায়ণ মাস (১৫ নভেম্বর) থেকে। রোয়া চলে মাঘ মাসের প্রথম পক্ষ পর্যন্ত (৩১ জানুয়ারি)। কাটা শুরু হয় চৈত্র মাসের শেষাশেষি (২১ এপ্রিল থেকে)। শেষ হতে হতে জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম পক্ষ (১৫ মে)।
মাঝারি ও নিচু অবস্থানের সেচসেবিত বেলে, দো-আঁশ থেকে এঁটেল মাটি বোরো চাষের উপযুক্ত। জলের উত্সর সন্নিকটে যে সমস্ত নিচু জমিতে বর্ষাকালে ৪ ফুটের বেশি জল দাঁড়ানোর ফলে আমন ধানের চাষ করা যায় না সেই সব জমিতে সেচের সুবিধা না থাকলেও বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে বোরো চাষ করা যায়।
পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক জাত নির্বাচন আধুনিক চাষ বিধির প্রথম কথা। বৃষ্টি নির্ভর এলাকায় মূলত জমির অবস্থান বিবেচনা করেই জাত নির্বাচন করা দরকার। বৃষ্টি নির্ভর উঁচু জমির ক্ষেত্রে মাটির জল ধারণক্ষমতাও একটি বিবেচ্য বিষয়। আবার নিচু জমির ক্ষেত্রেও বর্ষাকালে অপ্রতুল নিকাশি ব্যবস্থার জন্য ধানের জীবনকালের অধিকাংশ সময় জুড়ে ধানের মাঠে কোথাও ১ ফুট (৩০ সেমি), কোথাও ২ ফুট (৬০ সেমি), কোথাও ৩ ফুট (৯০ সেমি) বা তার বেশি বৃষ্টির জল দাঁড়িয়ে যায়। দাঁড়ানো জলের এই তারতম্য বৃষ্টি নির্ভর নিচু এলাকার জাত নির্বাচনের আর এক নিয়ামক। আলোচ্য মাপকাঠির ভিত্তিতে বিবিধ চরিত্রের বৃষ্টি নির্ভর এলাকার জন্য সঠিক জাতের নাম উল্লেখ করা হল।
বর্ষাকালে যে সমস্ত বৃষ্টি নির্ভর উঁচু জমির জল ধারণক্ষমতা ৯০ দিনের বেশি নয় সেই সমস্ত জমিতে আউশ ও আমন মরশুমের উপযুক্ত উন্নত জাত — হীরা, প্রসন্ন, ক্ষণিক, সওরী, আই. ই. টি ১২,০৫৫, বিরসা – ১০১, বন্দনা, স্নেহা, আদিত্য, পি. এন. আর – ৫৪৬, খণ্ডগিরি, পূর্বা। এই জাতগুলি রোয়া ও বোনা উভয় পদ্ধতিতেই চাষ করা চলে। ৭০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে পেকে যায়। ফলনক্ষমতা একর পিছু ১ টনের বেশি নয়। তবে বর্ষাকালে উঁচু জমিতে ১১০ দিন পর্যন্ত জল ধরে রাখতে পারলে আরও একটু বেশি ফলনের জন্য ১১০–১১৫ দিন মেয়াদি জাত নির্বাচন করা যেতে পারে। এই জাতগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জল হাওয়ার উপযোগী জাত : রাস, পাঙ্কে, ভূপেন, অন্ন, নরেন্দ্র ০- ৯৭, স্বভাগি, কিরণ, আই ই টি ২২৩৩, কেশরী ইত্যাদি। এগুলি ১১০–১১৫ দিনের মধ্যে পাকে ও ফলনক্ষমতা একর পিছু ১.৫ টনের মতো।
বৃষ্টি নির্ভর নিচু জমিকে চার ভাগে ভাগ করে প্রতিটি ভাগের জন্য আলাদা আলাদা জাত নির্বাচন করতে হবে। অল্প নিচু জমি যেখানে বর্ষাকালে বৃষ্টির ফলে জলের গভীরতা কখনওই ১ ফুট ছাড়ায় না সেই সমস্ত এলাকার উপযোগী জাত জারাভা, প্রতীক্ষা, স্বর্ণসাব-১, পঙ্কজ, শশী, রিতা, এম টি ইউ ৭০২৯, আই ই টি ৫৬৫৬। সাম্বা মাশুরি, রনজিত, লুনিশ্রী, বিপাশা, যোগেন, পূজা, সাবিত্রী, গায়ত্রী, ধরিত্রী — জাত ভেদে এগুলো পাকতে ১৪০–১৫০ দিন সময় লাগে। ফলনক্ষমতা একর পিছু ২ – ২.৫ টন।
ধানের জমি যদি আরও একটু বেশি নিচু হয় যেখানে দাঁড়ানো জলের গভীরতা ১ ফুট ছাড়িয়ে ২ ফুটের কাছাকাছি পৌঁছে যায় কিন্তু ২ ফুট ছাড়ায় না, সেই সমস্ত এলাকার উপযুক্ত জাত : সুবেশ, বিরাজ, মন্দিরা, রাজশ্রী, উৎকল প্রভা, তুলসী, নাগার্জুন, দুর্গা, মাশুরি। এই জাতগুলোর ফলন ক্ষমতা একর পিছু ২-২.৫ টন। জাত ভেদে পাকতে সময় নেয় ১৪০ – ১৬০ দিন।
জলের গভীরতা ৩ ফুটের কাছাকাছি পৌছে গেলে নির্বাচন করতে হবে — সবিতা, অমূল্য, পূর্ণেন্দু, নলিনী, মাতঙ্গিনী, মহানন্দা, সুনীল, সরস্বতী, ভাগীরথী, পাইনধান, ভুদেব। দাঁড়ানো জলের গভীরতা ৩ ফুট ছাড়িয়ে গেলে যে জাতগুলি নির্বাচন করতে হবে তা হল : জিতেন্দ্র, দীনেশ, গোলক, জলপ্রভা, নীরজা। এই দু’ ধরনের পরিস্থিতিতে উপযুক্ত জাতগুলি আলোক সংবেদনশীল। কার্তিক মাসের (১৫ই নভেম্বর) আগে ফুল আসবে না। ফুল ধরা থেকে পাকতে সময় লাগবে ৩০ দিন। এই পরিস্থিতিতে কোনও জাতই একর পিছু ১ – ১.৫ টনের বেশি ফলন দেবে না।
বন্যাপ্রবণ বিভিন্ন ধরনের নিচু জমির জন্য বিশেষ ধরনের জাত বাছাই একান্ত প্রয়োজনীয়। কেননা এই সমস্ত অঞ্চলে বন্যার ফলে ধানের ফসল ৭ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত জলের তলায় চলে যেতে পারে। অপেক্ষাকৃত কম নিচু জমি যেখানে বন্যা না হলে মাঠে দাঁড়ানো জলের গভীরতা কখনওই ২ ফুট ছাড়ায় না সেই সমস্ত অঞ্চলের জন্য উপযুক্ত জাত আই আর ৬৪ সাব ১, সিহেরাব সাব ১, সাম্বা মাশুরি সাব ১। আর বন্যা না হলেও যেখানে মাঠে দাঁড়ানো জলের গভীরতা প্রায়শই ২ ফুট ছাড়িয়ে যায় সেই অঞ্চলের জন্য একমাত্র উপযুক্ত স্বর্ণ সাব ১।
সেচ সেবিত জমির জাত নির্বাচনের নিয়ামক শস্য পর্যায়। শস্য পর্যায়ে ধানের পরে কোন ফসলটি তা বিচার করে জলদি, মাঝারি জলদি ও মাঝারি মেয়াদি জাত নির্বাচন করা দরকার। পশ্চিমবঙ্গে সেচ সেবিত অঞ্চলে ধানের পর প্রধানত আলু, সরষে অথবা গমের চাষ হয়ে থাকে। একই জমিতে দু’বার আলু চাষের চল আছে। প্রথম বারের আলু লাগানো হয় জলদি -- অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে। যাতে জলদি বসানো আলু বাজারে অগ্রিম জোগানের ফলে দাম বেশি পাওয়া যায়।
যে সমস্ত সেচ সেবিত অঞ্চলে এই জলদি আলু চাষের চল আছে, সেই সমস্ত অঞ্চলের উপযোগী ধানে জাতের মেয়াদ ১১০ – ১১৫ দিনের মধ্যে বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। ১১০ – ১১৫ দিন মেয়াদি জলদি জাতের ধানের মধ্যে অন্যতম পি এন আর ৩৮১, রেণু, পি এন আর ৫১৯, তারা, সুফলা, পারিজাত, মোহন, সারথি, নরেন্দ্র ধান – ৯৭, এম টি ইউ – ১০০৪, লাল মিনিকিট (ডব্লু জি এল – ২০৪৭১), নয়নমণি, ভূপেন, স্বভাগি, রসি ইত্যাদি। এই জাতগুলির ফলনক্ষমতা একরে ১.৫ টনের বেশি নয়।
যে সমস্ত সেচ সেবিত অঞ্চলে জলদি আলু তুলে আবার আলু লাগানো হয় অথবা সরষের চাষ করার পরিকল্পনা থাকে সে সমস্ত অঞ্চলে ধানের মাঝারি জলদি মেয়াদি জাত ( যা ১১৫ – ১২৫ দনের মধ্যে পেকে যায়) নির্বাচন করতে হবে। এই জাতগুলির ফলন জলদি জাতের ফলন অপেক্ষা বেশি। কেননা ধানের ফলনক্ষমতা জাতের মেয়াদের ওপর নির্ভরশীল। মেয়াদ বাড়লে ফলনক্ষমতাও বাড়ে। এই পরিস্থিতির উপযোগী মাঝারি জলদি মেয়াদি ধানের জাত : ললাট, আই আর ৬৪, আই আর ৩৬, ক্ষিতিশ, রত্না, শতাব্দী (মিনিকেট), বিকাশ, সাকেত, লক্ষ্মী ৬, রঞ্জন, সরযু ৫২, কৃষ্ণ, হামসা, ত্রিগুণা, সি আর সি (এস) ৫ – ২- ২ – ৫, সি আর সি (এস) ১১-৫-০-২, সি আর সি (এস) – ২ – ১ – ৭, সি আর সি (এস) – ২ – ১ – ১, এম টি ইউ ১০১০, নরেন্দ্রদেব – ৩৫৯, বিরসা – ২০২, গজপতি, তপস্বিনী, কস্তুরী, কাব্য, অঞ্জলি ইত্যাদি। এই জাতগুলির গড়পড়তা ফলনক্ষমতা একর পিছু ২ টন।
যে সমস্ত সেচ সেবিত জমিতে গমের চাষ করার পরিকল্পনা থাকবে সেই সমস্ত জমিতে অপেক্ষাকৃত বেশি মেয়াদি অর্থাৎ ১২৫ – ১৩৫ দিনের মাঝারি মেয়াদি জাত নির্বাচন করে ধানের ফলন বাড়ানোর সুযোগ আছে। সেই লক্ষ্যের উপযোগী জাত : কুন্তী, জয়া, অজয়া, শস্যশ্রী, আই আর – ২, সুরক্ষা, ভূবন, বিক্রমাচার্য, প্রকাশ, প্রতাপ, দয়া, মুনলি, হিমালয় ৭৪১, কালিম্পং -১, ভি এল ধান – ৮১, সীতা, এম টি ইউ – ১০০১, পুসা বাসমতি- ১।
উপরোক্ত তিন ধরনের মেয়াদি জাতই বোরো মরশুমে চাষের উপযোগী। নিশ্চিত সেচ ব্যবস্থার আওতাতেই বোরো চাষ বাঞ্ছনীয়। ঠান্ডার জন্য উল্লিখিত সব জাতেরই মেয়াদ আমন অপেক্ষা বোরো মরশুমে বীজতলায় বীজ ফেলার সময় ভেদে ২০ – ২৫ দিন বর্ধিত হয়। তবে এক দিকে সেচের খরচ কমানো, অন্য দিকে কালবৈশাখী বা শিলাবৃষ্টির হাত থেকে ফসলের ক্ষতি আটকানোর জন্য উল্লিখিত জলদি অথবা মাঝারি জলদি মেয়াদি জাতের জাত নির্বাচন করাই শ্রেয়।
বীজের হার নির্ভর করে বীজ বোনার পদ্ধতির ওপর। ধান দু’ ভাবে বোনা যায়। প্রথমত জমিতে চাষ দিয়ে বীজ সরাসরি মাঠে ছিটিয়ে অথবা লাঙলের পিছনে সারিতে বীজ ফেলে মই দিয়ে মাটি টেনে বীজ ঢেকে দিয়ে বোনা। এই পদ্ধতিতে চাষ করা ধানকে বলা হয় বোনা ধান। দ্বিতীয় পদ্ধতি হল বীজ প্রথমে বীজতলায় ফেলে চারা তৈরি করে পরে সেই চারায় চার পাঁচ পাতা বেরোলে বীজতলা থেকে চারা তুলে মূল জমিতে রোপন করা হয়। একে বলে রোয়া ধান।
আগে আউশ মরশুমে বোনা ধানের চল ছিল। তবে সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে বর্তমানে সেই চল কমে গেছে। এখন অধিকাংশ আউশ ধানই রোয়া করে চাষ করা হয়। রোয়া চাষ অপেক্ষা বোনা চাষে বীজ বেশি লাগে। বর্তমানে অবশ্য বীজ বোনার জন্য বীজ বোনার যন্ত্র ‘জিরো টিলেজ’ বাজারে এসেছে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে সারিতে বীজ বুনলে রোয়া চাষের মতো বোনা চাষেও কম বীজ লাগবে। বোনার পদ্ধতি ছাড়াও বীজের আরও এক বৈশিষ্ট্যের ওপর বীজের হার নির্ভর করে। তা হল ধানের গঠনশৈলী। ধান সরু হলে বীজ কম লাগে। মাঝারি ও মোট ধানে বীজের হার অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশি।
ধানের গঠনশৈলী ও বোনার পদ্ধতি ভেদে বীজের নির্ধারিত হার:
জমিতে সরাসরি ছিটিয়ে বুনলে সরু ধান প্রতি একরে ২৮ – ৩২ কেজি বীজ লাগবে। মাঝারি ধান লাগবে ৩২ – ৩৬ কেজি। আর মোটা ধানের বেলায় তা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৬ – ৪০ কেজি। বোনা ধান ছড়িয়ে না বুনে সারিতে বুনলে সরু ধানের বেলায় একরে বীজ লাগবে ২৪ – ২৬ কেজি। মাঝারি ধানের ক্ষেত্রে একরে ২৬ – ২৮ কেজি আর মোটা ধানের ক্ষেত্রে একরে প্রয়োজন হবে ২৮ – ৩০ কেজি ধান।
রোয়া ধানের ক্ষেত্রে বীজের হার আরও একটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। তা হল চাষের মরশুম। আমন মরশুম অপেক্ষা বোরো মরশুমে সব ধরনের ধানের ক্ষেত্রেই একর প্রতি ১০ কেজি বীজ বেশি লাগে। সরু ধানের ক্ষেত্রে আমন মরশুমে একর প্রতি বীজ লাগে ১৪ – ১৬ কেজি, বোরো মরশুমে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ – ২৬ কেজি। মাঝারি ধানের বেলায় আমনে বীজ লাগে একর প্রতি ১৮ – ২০ কেজি এবং বোরোতে ২৮ – ৩০ কেজি। ঠিক সেই রকম মোটা ধানের ক্ষেত্রে আমনে ২০ – ২৪ কেজি ও বোরোতে ৩০ – ৩২ কেজি।
এ ছাড়াও বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা কম থাকলে অথবা দেরিতে রোয়ার প্রয়োজনে মূল জমিতে চারা ঘন করে অথবা গুছিতে বেশি চারা দেওয়ার প্রয়োজন হলে বীজের হার আনুপাতিক ভাবে বাড়াতে হবে। তাই বীজ বোনার আগে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা যাচাই করে নিতে হবে।
বীজ বোনার উপযুক্ত সময় নির্ভর করে চাষের মরশুম, বোনার পদ্ধতি ও জলবায়ু অঞ্চলের ভিন্নতার ওপর। আউশ মরশুমে বোনার সঠিক সময় নির্ধারণের জন্য রাজ্যকে পলিমাটি অঞ্চল, তরাই অঞ্চল ও কাঁকুড়ে মাটি অঞ্চল, এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
পলিমাটি অঞ্চলে বোনা ধানের চাষের জন্য মাঠে বীজ ফেলার প্রকৃষ্ট সময় বৈশাখ – জৈষ্ঠ (মে – জুন)। তরাই অঞ্চলে বীজ ফেলতে হবে ফাল্গুন – চৈত্র (মার্চ – এপ্রিল) মাসে আর কাঁকুড়ে মাটি অঞ্চলে বোনা ধানের বীজ পড়বে জ্যৈষ্ঠ – আষাঢ় (জুন – জুলাই) মাসে। আউশখণ্ডে সেচের সুবিধা নিয়ে রোয়া চাষ করতে গেলে পলিমাটি অঞ্চলে বীজ ফেলতে হবে জ্যৈষ্ঠ (জুন) মাসে, তরাই অঞ্চলে বৈশাখ – জ্যৈষ্ঠ (মে – জুন) মাসে এবং কাঁকুড়ে মাটি অঞ্চলে আষাড় (জুলাই) মাসে।
আমন মরশুমে মূলত রোয়া ধানের চাষ হয়। এই মরশুমে বীজ বোনার উপযুক্ত সময় নির্বাচনের নিয়ামক জমির অবস্থান। আমনের জমি উঁচু, মাঝারি, অল্প নিচু, ও বেশি নিচু, এই চার ভাগে বিভক্ত। উঁচু জমিতে জলদি মেয়াদি সরু ও মাঝারি ধানের চাষ হয়। বীজতলায় বোনার উপযুক্ত সময় আষাঢ় – শ্রাবণ (জুলাই-আগস্ট)। মাঝারি জমিতে মাঝারি মেয়াদি ধানের চাষ শ্রেয়। বীজতলায় বীজ ফেলার উপযুক্ত সময় জ্যৈষ্ঠ – আষাঢ় (জুন – জুলাই)। অল্প নিচু জমিতে সরু ও মাঝারি দু’ ধরনের মাঝারি ও দীর্ঘ মেয়াদি জাতের চাষ বাঞ্ছনীয়। বীজতলায় সরু ধান রোয়ার সঠিক সময় বৈশাখ – জ্যৈষ্ঠ (মে – জুন)। মাঝারি ও মোটা ধান বোনা দরকার জ্যৈষ্ঠ – আষাঢ় (জুন – জুলাই) মাসে। বেশি নিচু জমিতে সরু ধানের বীজ পড়বে চৈত্র – বৈশাখ মাসে। মাঝারি বা মোটা ধানের বীজ পড়বে বৈশাখ – জ্যৈষ্ঠ (মে – জুন ) মাসে।
বোরো ধানের চাষ বেশি হয় মাঝারি ও অল্প নিচু জমিতে। তবে বর্তমানে যে সমস্ত অঞ্চলের বেশি নিচু জমি বর্ষাকালে অতিরিক্ত জল জমার ফলে ধান চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ে সেই সমস্ত অঞ্চলে বোরো চাষের চল আছে। যে ধরনের জমিতেই বোরো চাষ হোক না কেন বীজতলায় বীজ ফেলার প্রকৃষ্ট সময় অগ্রহায়ণ মাস (১৫ নভেম্বর – ১৫ ডিসেম্বর)।
ধানের বপন পদ্ধতিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে পড়ে জমি চাষ দেওয়ার পর পরই ধানের শুকনো বীজ জমিতে ছড়িয়ে দিয়ে চষা জমিতে মই টেনে বীজ ঢাকা দেওয়া। বীজ ‘সাধারণত’ হাতেই ছেটানো হয়। তবে বর্তমানে বীজ বোনার যে উন্নত যন্ত্র বেরিয়েছে — তা ব্যবহার করলে শুকনো জমিতেও শুকনো বীজ সারিতে বোনা যায়। যন্ত্রটির নাম ‘জিরো টিলেজ’। ৬ – ৮টি টাইনযুক্ত বীজ বোনার এই যন্ত্রের সাহায্যে বীজ বুনলে বীজের সঙ্গে একই সাথে মূল সারও জমিতে ফেলা যায়। এই যন্ত্রটিকে ট্র্যাক্টরের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে জমিতে টানা হলে জমিতে অগভীর সারি তৈরি হয়। সারিতে প্রথমে সার ও পরে বীজ পড়ে। বীজ পড়ার পর মাটি চাপা দেওয়ার কাজটি এই যন্ত্রটিই করে। এই যন্ত্রের সাহায্যে বীজ বুনলে সার ও বীজ জমির নির্দিষ্ট গভীরতায় পড়ে এবং জমিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক চারা রাখা যায়। ধানের শিকড়ের সন্নিকটে যথাযথ গভীরতায় সার পড়ার ফলে সারের কার্যকারিতা বাড়ে। বীজ হাতে ছেটানো হলে জমির কোথাও ঘন কোথাও পাতলা হয়ে বীজ পড়ে। ফলে একটি চারা থেকে পরের চারার দূরত্ব যথাযথ বজায় রখা যায় না। এতে বীজ বেশি লাগে, ফলনও কমে যায়।
ধান বপনের দ্বিতীয় পদ্ধতি হল ধানের শুকনো অথবা কল গজানো (অঙ্কুরিত) বীজ প্রথমে বীজতলায় ফেলে চারা তৈরি করা হয়। বীজতলায় ওই চারায় ৪ – ৫টি পাতা বেরোলে চারা তুলে মূল জমিতে সারিবদ্ধ ভাবে রোপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে মূল জমিতে জল বেঁধে মাটি নরম করে চাষ দিয়ে কাদা করে জমিকে রোয়ার উপযুক্ত করে তুলতে হয়। আউশ, আমন অথবা বোরো সব মরশুমেই কাদানো জমিতে ধান বোনার এটাই প্রচলিত পদ্ধতি।
বীজতলায় চারা তৈরি না করে, কাদানো জমিতে কল গজানো (অঙ্কুরিত) বীজ সরাসরি সারিতে বোনার যন্ত্র বাজারে এসেছে। কাদা জমিতে বীজ বোনার এই যন্ত্রের নাম ‘ড্রাম সিডার’। যন্ত্রটিতে ৬ – ১০ সেমি ব্যাসের ৪ – ৬টি প্লাসটিকের ড্রাম একটি লোহার দণ্ডের ওপর সাজানো থাকে। দণ্ডের দু’ পাশে ২টি চাকা এবং যন্ত্রটি টানার জন্য হাতল থাকে। সাধারণ ব্যবস্থায় যন্ত্রটির ওজন ৬ কেজি। প্রতিটি প্লাস্টিকের ড্রামের দৈর্ঘ্য ২৫ সেমি। ড্রামের গায়ে থাকে ছিদ্রের সারি। একটি ড্রামের দু’ সারি ছিদ্রের মধ্যবর্তী দূরত্ব ২০ সেমি। ড্রামের ১/৩ অংশ খালি রেখে অঙ্কুরিত বীজ ভরা হয়। মই টেনে কাদা করা জমি উত্তম রূপে সমতল করে যন্ত্রটি হাতল টেনে বীজ বোনে। বোনার সময় জমিতে জল থাকবে না। বোনার পর ৩-৫ দিন কোনও সেচ দেওয়া যাবে না। তার পর ধীরে ধীরে জল ঢোকাতে হবে।
আমন মরশুমে এ ভাবে বীজ বোনার একটা সমস্যা আছে। বোনার পর পরই বৃষ্টি হয়ে গেলে বীজ এক জায়গায় জড়ো হয়ে যেতে পারে। বেশি বৃষ্টি হলে বীজ জলে ডুবে নষ্ট হতে পারে। তবে বোরো মরশুমে এই পদ্ধতিতে ধান বুনে সুফল পাওয়া গেছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে বীজতলায় চার তৈরি, চারা ভাঙা ও মূল জমিতে রোয়ার যে খরচ হয় এই পদ্ধতিতে চাষ করলে তা সাশ্রয় হয়।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 7/9/2020