পশ্চিমবঙ্গের প্রধানত উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ, ইটাহার ব্লকে এই ধানের চাষ সমধিক প্রচলিত। বিক্ষিপ্ত ভাবে দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমুন্ডি, কুমারগঞ্জ ও বালুরঘাট ব্লকেও তুলাইপাঞ্জির চাষ হয়। এই সব অঞ্চলে মাঝারি বা উঁচু জমিতে পাট কেটে ভাদ্র মাসের প্রথম পক্ষে (আগস্ট মাসের শেষাশেষি) এই ধানটি রোয়া হয়। এই ধান চাষের জন্য উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না।
তুলাইপাঞ্জির চাল মাঝারি সরু আকৃতির। ভাত এতই সুস্বাদু, নরম ও সুগন্ধি যে এই চালকে ‘বাংলার বাসমতি’ বলা হয়। উত্তরবঙ্গের উৎসব অনুষ্ঠানে বিরিয়ানি ও পোলাও তৈরির জন্য তুলাইপাঞ্জির চাহিদা যথেষ্ট। উত্তরবঙ্গের ভাইফোঁটার অনুষ্ঠানে ভায়ের পাতে বোনের তুলাইপাঞ্জি চালের পায়েস পরিবেশন করাটাই রীতি। এই চালের পিঠে ও চিঁড়েও অত্যন্ত উপাদেয়। তাই এই অঞ্চলের প্রচলিত ছড়াতে বাড়িতে ‘গোঁসাই’ আসলে তুলাইপাঞ্জি চালের সুগন্ধি চিঁড়ে ‘গিরস্থিয়া দই’-এর সঙ্গে পরিবেশন করার উল্লেখ পাওয়া যায়।
তুলাইপাঞ্জি ধানের গুণগত বৈশিষ্ট্য উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ অঞ্চলে চাষ করলে যতটা বজায় থাকে রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলে চাষ করলে তা থাকে না। বিশেষ করে দক্ষিণ বঙ্গে চাষ করলে তুলাইপাঁজির সুগন্ধই চলে যায়।
২০১১ সালের ২৫ জুলাই শ্রী শান্তাকুমারের নেতৃত্বে ৩১ জন সাংসদ নিয়ে গঠিত ভারতের বাণিজ্য সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটি চালের এই জাতটিকে রফতানিযোগ্য বলে সুপারিশ করে। ওই বছরের ১১ আগস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির এই সুপারিশ সংসদের উভয় কক্ষে গৃহীত হয়। ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের খাদ্য উত্সবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে তুলাইপাঁজি চালের বিশেষ পদ পরিবেশন করে বিশ্বের দরবারে এই চালটির উৎকর্ষ তুলে ধরা হয়। উত্তর ভারতের বাসমতি চালের মতোই পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ ভৌগোলিক এলাকায় উৎপাদিত ধানের এই জাতটিরও বিশ্বের দরবারে সমাদৃত হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা। তুলাইপাঁজি চালের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সিদ্ধ চালে সুগন্ধ। বাসমতির সুবাস মূলত আতপ চালে।
তুলাইপাঁজি ধান থেকে সঠিক গুণমানের সিদ্ধ চাল তৈরি করার পদ্ধতিতে একটু স্বাতন্ত্র্য আছে। তুলাইপাঁজির ধানকে প্রথমে এক রাত্রি জলে ভিজিয়ে রাখা হয়। পর দিন ভেজানো ধান তুলে জল ঝরিয়ে বিশেষ ধরনের পাত্রে সামান্য পরিমাণ জলে এই ধান সিদ্ধ করা হয়। পাত্রের উচ্চতা ৬ ইঞ্চি এবং দৈর্ঘ ও প্রস্থ হয় উনুনের মাপ অনুযায়ী যাতে পাত্রের সর্বত্র সমান পরিমাণে তাপ দেওয়া যায়। এই ভাবে ১৫-২০ মিনিট সিদ্ধ করলে ধানে একটু ফাটল ধরে। ধানের ফাটল আদর্শ সিদ্ধ অবস্থা সূচিত করে। এর পর ধান তুলে রৌদ্রে ৪-৫ ঘন্টা করে প্রায় ৩ দিন ধরে শুকনো হয়। তার পর রবার হলার যুক্ত আধুনিক রাইস মিলে তৈরি হয় চকচকে সাদা চাল।
কনকচূড় একটি সরু চালের সুগন্ধী ধান। এই ধানটির চাষ মূলত সীমাবদ্ধ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গুটিকয়েক ব্লকে। এর মধ্য উল্লেখ যোগ্য জয়নগর-১, জয়নগর-২, কুলতলি, মথুরাপুর-১, মথুরাপুর-২, কুলপি। এই ধানের খই বড়ই সুগন্ধী। কনকচূড়ের বাণিজিক মূল্য এই সুগন্ধী খই। পশ্চিমবঙ্গের প্রসিদ্ধ মিষ্টি ‘মোয়া’-র মূল উপাদান কনকচূড়ের খই। এই বিশেষ মিষ্টিটির উদ্ভাবক কারিগরদের বাস দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর অঞ্চলে। তাই এই জাতটির চাষ এই জেলাতেই কেন্দ্রীভূত। তবে মোয়া ছাড়াও খই-এর বিবিধ ব্যবহারের জন্য কনকচূড়ের সুগন্ধী খই জনপ্রিয়।
পুরনো কলকাতার শেঠরা তাদের আরাধ্য দেবতা গোবিন্দ জিউ-কে এই চালের পদ নিবেদন করত বলে এই চালের নাম গোবিন্দভোগ। চালটি আকারে বেশ ছোট ও মোটা। দৈর্ঘ্য ৩.৯-৪.১ মিমি ও প্রস্থ ১.৭-১.৮ মিমি। দৈর্ঘ্য-প্রস্থের অনুপাত মোটামুটি ২:১। তবে রান্নার পর ভাতের দৈর্ঘ্য ১.৭-১.৮ গুণ বেড়ে যায়। চাল ধপধপে সাদা ও বাসমতির মতোই সুগন্ধী।
গোবিন্দভোগ একান্ত ভাবেই পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় দেশি ধান। গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে বিশেষত বর্ধমান, হুগলি, বাঁকুড়া, নদীয়া প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষকেরা কয়েকশো বছর ধরে এই ধানটি চাষ করছেন। তবে বর্তমানে এই ধানটির চাষ বর্ধমান জেলার রায়না ১ ও ২, খণ্ডঘোষ ও ভাতার ব্লকে, বাঁকুড়া জেলার কোতুলপুর, ইন্দাস ও খাতড়া ব্লকে, নদিয়া জেলার চাকদা ও হরিণঘাটা ব্লকে এবং হুগলি জেলার আরামবাগ এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গাইঘাটা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ধানটি স্থানীয় ভাবে ‘খাসধান’ নামে পরিচিত। গোবিন্দভোগ ধানের বৈশিষ্ট্য হল এটি শুধুমাত্র গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে চাষ করলে তীব্র সুগন্ধযুক্ত হয়। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলে কোথাও মাঝারি, কোথাও মৃদু গন্ধযুক্ত। পূজা পার্বণে ‘ভোগ’ রান্নার কাজে, উৎসব অনুষ্ঠানে বিরিয়ানি তৈরিতে এমনকী সুগন্ধী ‘টেবল রাইস’ হিসাবে জাতটি দক্ষিণবঙ্গে খুবই জনপ্রিয়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও এই চালের কদর বাড়ছে দক্ষিণ ভারতের কেরালা, কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে। কেননা পায়েস, পোলাও, বিরিয়ানি তৈরিতে উত্তর ভারতের দামি বাসমতির সঠিক পরিবর্ত কম দামের গোবিন্দভোগ।
গোবিন্দভোগ জাতটিকে পশ্চিমবঙ্গের ‘কৃষকের জাত’ হিসাবে নিবন্ধীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়-এর উদ্যোগে ২০০৯ সালে বর্ধমানের ‘শ্যামসুন্দর সিস্টার নিবেদিতা সংঘের’ তরফে ভারত সরকারের ‘প্রোটেকশন অব প্লান্ট ভ্যারাইটি ও ফার্মাস রাইট অথরিটি’-র কাছে গোবিন্দভোগ জাতের নিবন্ধীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও নথিপত্রর আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে গোবিন্দভোগ ‘কৃষকের জাত’ হিসাবে সংরক্ষণের মর্যাদা পাবে। তুলাইপাঞ্জির ধানের মতোই পশ্চিমবঙ্গের এই স্থানীয় জাতটিও দেশের বাণিজ্য সংক্রান্ত পার্লামেন্টারি কমিটির বিচারে রফতানিযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। বাণিজ্য সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির এই সুপারিশ ২০১১ সালে সংসদের উভয় কক্ষে গৃহীত হয়েছে।
স্বাদে-গন্ধে ম-ম করা আসল গোবিন্দভোগের বাজার বাড়াতে চাইছে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। পরীক্ষামূলক ভাবে ইতিমধ্যেই কিছু প্যাকেট বাজারে ছাড়া হয়েছে। উচ্চ মানের গোবিন্দভোগ চাষ ছড়িয়ে দিতে ২০০৯ সালে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুগন্ধি চাল বিশেষজ্ঞ মৃত্যুঞ্জয় ঘোষের তত্ত্বাবধানে নদিয়ার হরিণঘাটা, চাকদহ ও রানাঘাটে ১৩৪ বিঘা জমিতে ৭৮ জন চাষ শুরু করেন। গত পাঁচ বছরে বর্ধমান, হুগলি, বাঁকুড়া ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ২৯টি ব্লকে ১৩৬০ বিঘা জমিতে প্রায় এগারোশো কৃষক এই চাষ করেছেন। তবে আবহাওয়া ও উপযুক্ত জমির দৌলতে বর্ধমানই সব চেয়ে এগিয়ে।
গোবিন্দভোগ আগে চাষ হত বিক্ষিপ্ত ভাবে। বিপণন ছিল পাইকার ও কিছু বাণিজ্যিক সংস্থার দখলে। তাতে মান বজায় থাকছিল না। এখন কৃষি বিপণন দফতর সরকারি প্যাকেটে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে গোবিন্দভোগ বিক্রি করছে। রাজ্যের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার বলেন, ‘অন্য সুগন্ধি চালের সঙ্গে আসল গোবিন্দভোগ মিশে যাচ্ছিল। বাঙালির নস্টালজিয়ার পুনরুজ্জীবন ঘটল। এর স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বাজারজাত করাটাই চ্যালেঞ্জ।’
বিশেষত দক্ষিণ ভারতে, এমনকী দেশের বাইরেও বহু জায়গায় গোবিন্দভোগের বিপুল চাহিদা আছে। তার মধ্যে ইউরোপ যেমন আছে, পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশও রয়েছে। কিন্তু উত্পাদিত চালের মান রফতানির যোগ্য কি?
মৃত্যুঞ্জয় বাবু বলেন, ‘গুণগত মান বজায় রাখতে জেলায় জেলায় বিভিন্ন কৃষি সমবায় ও কৃষক সংঘগুলিকে একত্রিত করেছি। বীজ, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করছি। উত্পন্ন ফসলের ভাল বাজার থাকায় চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে।’
পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গের আটটি জেলার ৩৫টি সমবায় ও সংঘ গোবিন্দভোগ চাষে উত্সাহী হয়েছে। রাজ্যের কৃষি সমবায় দফতরের আওতা ভুক্ত হয়েছে ১৭টি। এখনও বর্ধমানের ১১টি ধানকলেই চাল তৈরির বরাত বেশি। এমনই একটি কলের মালিক অজয় রুদ্র যোগ করেন, ‘এখন অন্য জেলা থেকেও গোবিন্দভোগ চাল তৈরির বরাত আসছে। আশার কথা।’
২০০৯-এই লোকসভার আমদানি রফতানি নিয়ন্ত্রক কমিটি বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোবিন্দভোগের পেটেন্ট অনুমোদন করে। রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা অনুমোদন হয়। এর পরেই বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্যাকেজিং বিভাগ’ খোলে। ছোট একটি ধানকলও গড়া হয়।
মোহনপুরে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই কৃষি সম্প্রসারণ বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্যাকেটে গোবিন্দভোগ বিক্রি করা হচ্ছে। বিক্রির টাকা সবই পাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট চাষি। মৃত্যুঞ্জয় বাবু বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় চাষিদের পথ দেখায়, ব্যবসা করে না। সরকার চাষিদের ধান কেনে। এর সঙ্গে বহু স্বনির্ভর গোষ্ঠী যুক্ত। কৃষি সমবায় দফতরের কাউন্টার থেকেও চাল বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন কৃষি মেলায় যায়। পাঁচ বছরে চাহিদা অনেক বেড়েছে। আরও বাড়বে।’
চাষিরা জানান, গোবিন্দভোগের সঙ্গে মাঝারি ও ছোট দানার সুগন্ধি চাল মিলিয়ে আগে বাজারে ৩২ টাকা থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হত। বিশ্ববিদ্যালয়ের দৌলতে তার বদলে উচ্চ মানের গোবিন্দভোগ বাজারে মিলছে। এই মরসুমে হেক্টর প্রতি গড়ে আড়াই-তিন টন ধান উত্পাদন হয়েছে। কাউন্টার থেকে ৬০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে তা বিক্রিও হয়েছে।
বহু চাষিই এখনও উচ্চ ফলনশীল স্বর্ণ, জয়া, রত্না বা আই আর-৩৬ ধান চাষ ছেড়ে গোবিন্দভোগ চাষ করার সাহস দেখাননি। নদিয়ার অসীম তালুকদার, পূর্ব মেদিনীপুরের অনন্ত মাইতি বা বর্ধমানের সমর ঘোষের মতো প্রবীণ চাষিদের আশঙ্কা, ‘গোবিন্দভোগের মতো সংবেদনশীল ধান চাষ করতেও গিয়ে প্রকৃতির হাতে মার খেলে গরিব চাষিরা উঠে দাঁড়াতে পারবে না।’
এই ঝুঁকি সত্ত্বেও গোবিন্দভোগ যে সাধারণ ধানের চেয়ে বেশি লাভদায়ক, সেটাই এখন চাষিদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী কৌশিক ব্রহ্মচারীর আক্ষেপ, ‘গোবিন্দভোগের যে বড় বাজার তৈরি করা সম্ভব, তা চাষিদের বোঝানোই হয়নি। অথচ নদিয়ায় তো পড়ে থাকা জমিতে গোবিন্দভোগ হচ্ছে।’
২০১০ থেকে নদিয়ার তিনটি খামারে জৈব চাষের জমি তৈরি হয়েছে। মৃত্যুঞ্জয় বাবু বলেন, ‘এ বছর প্রথম ভেষজ গোবিন্দভোগ বাজারজাত হবে। প্যাকেজিং সংক্রান্ত অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। চাষিরা দেশের বাইরেও বড় বাজার পাবেন।’
বাজারে দু’ রকমের চাল পাওয়া যায়। একটি ‘আতপ’ বলে পরিচিত। অন্যটি ‘সিদ্ধ’ চাল। এই দু’ ধরনের চালের উত্পত্তির পিছনে আছে ধানের প্রক্রিয়াকরণগত পার্থক্য। একই জাতের ধান থেকে আতপ ও সিদ্ধ দু’ ধরনের চালই বানানো যায়। পশ্চিবঙ্গে সাধারণত পূজাপার্বন ও চালের বিশেষ পদ তৈরিতে আতপ চালের চল সীমাবদ্ধ। দৈনিক খাদ্য তালিকায় সাদামাটা ভাতের জন্য সিদ্ধ চালই জনপ্রিয়।
ধান ভাঙিয়ে চাল। ধান কেটে ঝাড়াই করার পর রোদে ফেলে শুকিয়ে নিয়ে গুদামজাত করা হয়। ওই শুকনো ধান (আর্দ্রতা ১২-১৪%) সরাসরি ঢেঁকিতে বা আধুনিক ধানভাঙা কলে ভাঙিয়ে যে চাল তৈরি হয় তার নাম আতপ চাল। আর সিদ্ধ চাল তৈরি করতে গুদামের শুকনো ধান প্রথমে ভাপে গরম করে নিয়ে জলে ১৫ – ২০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা হয়। পরিবর্ত হিসাবে ধানের বদলে জল ভাপে গরম করে ৬৫০-৭০০ সেন্টিগ্রেডে এনে তাতে ধান ৪ – ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত ভিজিয়ে রাখা হয়। এর পর ভেজা ধান তুলে পুনরায় শুকিয়ে আর্দ্রতা নিয়ে আসা হয় ১২ – ১৪ শতাংশে। এই সিদ্ধ শুকনো ধান ভাঙিয়ে যে চাল পাওয়া যায় তার নাম সিদ্ধ চাল।
গুণগত মান বিচারে ভোজ্য হিসাবে আতপ অপেক্ষা সিদ্ধ চাল তুলনামূলক ভাবে ভালো। ব্যবসার দিক থেকে দেখতে গেলেও সিদ্ধ চাল তৈরি করা লাভজনক। সিদ্ধ চালের ক্ষেত্রে ধান ভাঙানোর আগে সিদ্ধ করার ফলে ধানের শর্করা জাতীয় যে অংশকে এন্ডোস্পার্ম বলা হয় তা নরম হয়ে থকথকে (জিলেটিনাই জেসান) চেহারা নেয় ও ফুলেফেঁপে উঠে ধানের খোসার ভিতরে থাকা চালে বহি:ত্বকে একটা চাপের সৃষ্টি করে। ফলে চালের ফাটল জোড়া লেগে দানা হয়ে ওঠে শক্ত, অনমনীয় মসৃণ। তাই সিদ্ধ শুকনো ধান ভাঙানোর সময় ভাঙা চালের পরিমাণ কমে। দানা শক্ত হওয়ায় পোকা কম লাগে। মজুত ক্ষমতা বাড়ে। ধান ভাঙার আগে সিদ্ধ করে শর্করার জিলেটিনাইজেশনের ফলে রান্নার সময় চালের শর্করা বেরিয়ে আসতে পারে না। সেই জন্য সিদ্ধ চালের মাড় হয় পাতলা ও হালকা বাদামি রঙের। অন্য দিকে আতপ চালের মাড় হয় ঘন ও সাদা। সিদ্ধ চাল অপেক্ষা আতপ চালের ভাত তাড়াতাড়ি রান্না হলেও সিদ্ধ চাল অপেক্ষাকৃত সহজপাচ্য। খাদ্যগুণ বিচারেও আতপ চালের তুলনায় সিদ্ধ চাল উত্কৃষ্ট। কেননা ভাঙানোর আগে ধান সিদ্ধ করার সময় চালের উপরি ত্বকে স্তরে স্তরে সজ্জিত চাদরের মধ্যে নিহিত ভিটামিন ও খনিজ পদার্থ জলে গুলে বেরিয়ে এলে চাল তা শুষে নেয়। আবার চালের ভিতর থেকে স্নেহ জাতীয় পদার্থ বাইরে বেরিয়ে এসে উপরি ত্বকের ব্র্যানে জমা হওয়ার ফলে সিদ্ধ চালের ব্র্যানে তেলের ভাগ বেশি হয়। তবে আতপ অপেক্ষা সিদ্ধ চাল পালিশ করা কষ্টকর।
দুই ধরনের চালে লাভ লোকসানের খতিয়ান নিম্নরূপ :
গুণ মানের মানদণ্ড |
আতপ চাল |
সিদ্ধ চাল |
|
ধান থেকে চাল (%) |
৭০ |
৬৮ - ৭০ |
৭০ - ৭২ |
ভাঙা চাল (%) |
৭০ |
১৫ – ৫০ |
১ – ৫ |
ব্র্যানে তেলের পরিমাণ (&) |
% |
১৫ – ২০ |
২০ – ২৭ |
প্রোটিন (%) |
% |
৬.৫ – ৭.০ |
৭.০ – ৭.৫ |
স্নেহজাতীয় পদার্থ (%) |
% |
০.৩ -০.৫ |
০.২ -০.৪ |
শর্করা (%) |
% |
৮০ – ৮১ |
৮০ – ৮১ |
ক্যালসিয়াম (মিলিগ্রাম / ১০০ গ্রাম) |
|
২০ – ২৫ |
৬০ – ৭০ |
ফসফরাস (মিলিগ্রাম / ১০০ গ্রাম) |
|
৯০ – ১০০ |
২০০ – ২১০ |
লোহা (মিলিগ্রাম / ১০০ গ্রাম) |
|
০.৮ – ১.০ |
২.৮ – ৩.০ |
সোডিয়াম (মিলিগ্রাম / ১০০ গ্রাম) |
|
৫ – ৬ |
৯ – ১০ |
পটাশিয়াম (মিলিগ্রাম / ১০০ গ্রাম) |
|
৯০ – ৯৫ |
১৫০ – ১৬০ |
থায়াসিন (মিলিগ্রাম / ১০০ গ্রাম) |
|
০.০৬ – ০.০৭ |
০.১২ – ০.১৪ |
নিয়াসিন (মিলিগ্রাম / ১০০ গ্রাম) |
|
১.৫ – ১.৭৫ |
৩.০ – ৩.৫ |
চালের কেবলমাত্র ২টি প্রজাতি চাষযোগ্য। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একটির নাম অরাইজা স্যাটাইভা, অন্যটি অরাইজা গ্ল্যাবেরিমা। ধানের চাষ মূলত স্যাটাইভা প্রজাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গ্ল্যাবেরিমার চল কেবলমাত্র পশ্চিম আফ্রিকায়। স্যাটাইভা প্রজাতির বিভিন্ন জাত থেকে রঙবেরঙের চাল পাওয়া যায়। ধানের খোসা ছাড়ালে ভেতর থেকে যে চাল বেরিয়ে আশে তার উপরিভাগটা বেশ কয়েক স্তরের অংশুল চাদর দিয়ে ঢাকা থাকে। সব থেকে বাইরের চাদরটার বৈজ্ঞানিক নাম পেরিকার্প। এই বিস্তৃতি ছয় স্তর পর্যন্ত। রঙের বসত এই পেরিকার্পে। জাত ভেদে এই পেরিকার্পে নানা রঙ জমা হয়। পেরিকার্পে এই রঙের ছোপকে ভিত্তি করে চালকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় : ক) কালো চাল, খ) লাল চাল, গ) বাদামি চাল।
কালো চাল আবার বেগুনি চাল (পার্পল রাইস) হিসাবেও প্রসিদ্ধ। আসলে এই চালের পেরিকার্পে যে রঙের ছোপ ধরে তা ঘন কালচে হলেও রান্নার পর ভাতের রঙ হয় গাঢ় বাদামি। কালো চালের কিছু কিছু জাতের ভাত আঠালো হয়। ইন্দোনেশিয়ায় প্রচলিত কালো জাতের চালগুলির ভাত মূলত আঠালো। তাই বলে কালো চাল মানেই আঠালো ভাত তা নয়। কালো চাল পুষ্টিমানে উন্নত। এই চালে লোহা, ভিটামিন-ই এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের পরিমাণ বেশি। কালো চালের ব্র্যানের উপরি তলে সর্বাধিক পূঞ্জিভূত অ্যানথোসায়ানিন অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টের অন্যান্য রঙিন চাল অপেক্ষা বেশি । কালো চালে আঁশের পরিমাণও বেশি। তবে কালো চালের ভাতের স্বাদ বাদাম চিবানোর পর যেমন লাগে সেই রকম। কালো চালের ভাত মূত্রগ্রন্থি, পাকস্থলী ও যকৃতের পক্ষে উপকারী।
লাল চালের পেরিকার্পে যে অ্যানথোসায়ানিন রঞ্জক জমা হয় তার রঙ লাল। চালের উপরিত্বকে জমা লাল রঙের এই রঞ্জকের অঙ্গের স্ফীতি, প্রদাহ ইত্যাদি উপশমের ক্ষমতা আছে। লাল চালের ভাতের ক্যানসার ও অ্যালার্জি প্রতিরোধক ক্ষমতা বিদ্যমান। এ ছাড়াও লাল চালে বি-ভিটামিন, লোহা, ক্যালসিয়াম ও জিঙ্ক অধিক পরিমাণে থাকায় শরীরবৃত্তির নানান উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। বি ভিটামিন শরীরের সমস্ত অঙ্গ, ইন্দ্রিয়ের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শরীরে অধিক শক্তি জোগায়। ক্যালসিয়াম হাড়ের শক্তি বাড়ায়। জিঙ্ক বাড়ায় মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা।
বাদামি চালের পেরিকার্পে জমা হয় বাদামি রঙের রঞ্জক। লাল চালের মতো বাদাম চালে ভিটামিনের (বি ভিটামিন সহ) পরিমাণ বেশি। এ ছাড়াও লাল বাদামি চাল ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও সেলেনিয়ামে সমৃদ্ধ। ক্যালসিয়ামের মতো ম্যাগনেসিয়ামও হাড় ও দাঁতের গঠন ও শক্তির জন্য মূল্যবান উপাদান। অপর পক্ষে ম্যাঙ্গানিজ শরীরবৃত্তি উন্নত করে এবং সেলেনিয়াম খনিজটি শরীরের রোগ প্রতিরোধক শক্তি বাড়ায়।
স্যাটাইভা প্রজাতির সব চালের পেরিকার্পেই এই তিন রঙের যে কোনও একটি থাকে। বাজারে সমধিক প্রচলিত ‘সাদা’ চাল তৈরি হয় ধানকলে। ভাঙানোর সময় চালের ওপরে স্তরে স্তরে সজ্জিত অংশুল চাডর উঠে গেলে যে শর্করাসমৃদ্ধ এন্ডোস্পার্ম পড়ে থাকে তার রঙ সাদা। রঙিন চালের পুষ্টিগুণ সাদা চেলের অপেক্ষা বেশি হলেও চাল সহজপাচ্য নয়, সহজে পোকা লাগে। বেশি দিন মজুত করা যায় না।
বাজারে যে চাল পাওয়া যায় তার সিংহ ভাগের রঙ সাদা। এ ছাড়াও আরেক রঙের চালের কথা প্রায়শই শোনা যায়, যা বাদামি চাল হিসাবে পরিচিত। ধানের খোসা ছাড়ানোর পর আঁকাড়া চালের ওপর যে অংশুল চাদরগুলো থাকে যেমন অ্যালুইরোন স্তর, সিড-কোট, পেরিকার্প ও জার্ম ধানকলে ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার পর যে সাদা রঙের শর্করাসমৃদ্ধ এন্ডোস্পার্ম পড়ে থাকে তাই সাদা চাল। আর বাদামি চাল বলতে বোঝায় ধানকলে খোসা অপসারিত আঁকাড়া চাল। আঁকাড়া চালে উল্লিখিত অ্যালুইরোন, সিড-কোট, পেরিকার্প ও এমব্রায়ো অক্ষুণ্ণ থাকে।
আঁকাড়া চাল থেকে এই অংশুল চাদরগুলি অপসারণের ফলে সাদা চালের গন্ধ গ্রথন বাহ্যিক রূপের পরিবর্তন হয় এবং চালের সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে। সাদা চালে পালিশ পড়ে বলে রঙ উজ্জ্বল শুভ্র হয়। আবার এই অংশুল আস্তরণ ও অ্যান্ডোস্পার্ম বাদ যাওয়ার ফলে সাদা চাল থেকে নানা ধরনের ভিটামিন যেমন ভিটামিন বি১, ভিটামিন বি৩, খনিজ পদার্থ যেমন লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, সোডিয়াম ইত্যাদিও বহুলাংশে অপসারিত হয়। ফলে খাদ্যগুণ কমে যায়। অপর পক্ষে বাদামি চালে এই আস্তরণগুলো থাকার ফলে ভিটামিন, ভোজ্য খনিজ পদার্থ ও মূল্যবান স্নেহজাতীয় পদার্থে সমৃদ্ধ হয়।
সাদা চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) বেশি। বাদামি চালের কম। কোনও ভোজ্যের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সেই ভোজ্য খাওয়ার পর রক্তে শর্করা কত তাড়াতাড়ি কী পরিমাণে জমা হয় তা সূচিত করে। সাদা চালের জিআই বেশি হওয়ার জন্যই মধুমেহ (ডায়াবেটিক) রোগীদের ভাত কম খেতে বলা হয়। অন্য দিকে বাদামি চালের জিআই সূচক কম হওয়ার ফলে তা ভক্ষণ করলে রক্তে শর্করার অনুপ্রবেশ ঘটে ধীর গতিতে। পরন্তু উপকারী স্নেহজাতীয় অম্লের আধিক্য থাকায় বাদামি চাল হৃদরোগীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ্য।
সাদা ও বাদামি এই দুই রঙের চালের ভোজ্যগুণ নিম্নরূপ
ভোজ্যগুণ (প্রতি ১০০ গ্রাম চালে)
খাদ্য চরিত্র |
সাদা চাল |
বাদামি চাল |
ক্যালোরি |
১৩০ |
৩৭১ |
কার্বোহাইড্রেট |
২৮ গ্রাম |
৭৭.২৪ গ্রাম |
শর্করা |
০.০ ’’ |
০.৮৫ গ্রাম |
ভোজ্য আঁশ |
০.৪ ’’ |
৩.৫২ গ্রাম |
স্নেহজাতীয় পদার্থ |
০.৩ ’’ |
২.৯২ গ্রাম |
প্রোটিন |
২.৭ ’’ |
৭.৮৫ গ্রাম |
ভিটামিন |
- |
|
ক) থায়ামিন (বি-১) |
০.১০ মিগ্রা |
০.৪০ মিগ্রা |
খ) রাইরোফ্ল্যাভিন (বি-২) |
- |
০.০৯ মিগ্রা |
গ) ভিটামিন বি-৬ |
০.০৫ মিগ্রা |
০.৫১ মিগ্রা |
ঘ) ফোলেট (বি-৯) |
- |
২০ মিগ্রা |
ঙ) নিয়াসিন (বি-৩) |
১.৮৩ মিগ্রা |
৫.০৯ মিগ্রা |
ধাতু |
|
|
ক) ক্যালসিয়াম |
২০ মিগ্রা |
৩৫ মিগ্রা |
খ) লোহা |
০.৫৯ মিগ্রা |
১.৪৭ মিগ্রা |
গ) ম্যাগনেসিয়াম |
২৪ মিগ্রা |
১৪৩ মিগ্রা |
ঘ) ম্যাঙ্গানিজ |
১.৮৭ মিগ্রা |
৩.৭৪ মিগ্রা |
ঙ) ফসফরাস |
১৬৬ মিগ্রা |
৩৩৩ মিগ্রা |
৬) পটাসিয়াম |
৩৫ মিগ্রা |
২২৩ মিগ্রা |
৭) সোডিয়াম |
১ মিগ্রা |
৭ মিগ্রা |
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/16/2020