বিশুদ্ধ, পুষ্ট, রোগ-পোকামাকড় মুক্ত সঠিক জাতের ধান-বীজ উৎপাদন অত্যন্ত শ্রম-সাধ্য ও ব্যায়-সাপেক্ষ হলেও, এ ধরণের বীজ ব্যবহারে ধানের ফলন ১০-২০% বৃদ্ধি হতে পারে। ধান গাছের কাংখিত বাড়বাড়তি ও ফসলের অধিক ফলনের জন্যও যথাযথভাবে বীজ গজিয়ে আদর্শ বীজতলায় ধানের সুস্থ্য-সবল চারা উৎপাদন এবং সঠিক সময়ে, সঠিক পদ্ধতিতে রোপণ ও যথাযথ অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা করা একান্ত প্রয়োজন।
(ক) নিজেদের সংরক্ষণ করা বা বাজার থেকে কেনা ধানের বীজ বস্তা থেকে বের করে তিন-চার ঘন্টা রৌদ্রে শুকিয়ে তারপর ছায়ায় রেখে স্বাভাবিক ঠান্ডা করতে হবে।
(খ) তারপর বীজ রোগ-পোকামাকড় মুক্ত চটের বস্তায় ভর্তি করে, সম্ভব হলে পরিস্কার দূষণমূক্ত জলতে এক দিন (২৪ ঘন্টা) ভিজিয়ে রাখতে হবে।
(গ) ২৪ ঘন্টা পর বীজের বস্তা জল থেকে উঠিয়ে, বীজের অতিরিক্ত জল ঝরিয়ে বস্তা বন্দী করে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে (জাক দিয়ে) খর-কুটো দিয়ে বস্তা ঢেকে দিতে হবে।
(ঘ) পরদিন, অর্থাৎ জাক দেয়ার ২৪ ঘন্টা পর, জাক দেয়া বীজ বস্তা থেকে বের করে, মেঝে, পাটি বা পলিথিনের উপর রেখে, সাবধানে নেড়েচেড়ে উপর-নিচ করে, ভেতরের গরম ছাড়িয়ে, বীজ শুকিয়ে গেলে প্রয়োজনে হালকা জল ছিটিয়ে দিয়ে, শীতকালে বেশী ঠান্ডা হলে বীজ কিছুক্ষণ রৌদ্রে গরম করে, পুনরায় বস্তায় ভরে জাক দে'য়া উচিৎ।
(ঙ) চারা না গজানো পর্যন্ত, ২৪ ঘন্টা পরপর, প্রতিদিন বীজ জাক থেকে বের করে উপরোক্ত নিয়মে বীজের গরম ছাড়িয়ে পুনরায় জাক দেয়া হলে, বোরো মৌসুমে ৪-৫ দিন, আউশ ও আমন মৌসুমে ৩-৪ দিন পর সব বীজ সমানভাবে গজাবে।
(চ) বীজ জাক দেয়ার পর এক নাগারে ৩-৫ দিন বীজ জাক দিয়ে রাখার কারণে বস্তার পার্শ্বের বীজ শুকিয়ে এবং ভিতরের বীজ অতিরিক্ত গরমে গুমিয়ে (পচে) গিয়ে ৪০-৭০% বীজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
(ক) চারিদিকে খোলা, রৌদ্র ও সেচসুবিধাযুক্ত জমিতে বীজতলা তৈরী করা উচিৎ। ছায়াযুক্ত বীজতলায় ধানের চারা লম্বা ও লিকলিকে হয়ে যায় এবং চারা রোগাক্রান্ত হতে পারে।
(খ) ভালোমত চাষ-মই দিয়ে, জমি থকথকে কাদাময় তৈরী করে, তাতে ১.০-১.৫ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট প্রয়োজন মত লম্বা একাধিক বীজতলা তৈরী করা যেতে পারে।
(গ) প্রতি দুই বীজতলার মাঝে ৩০ সেমি নালা/ড্রেন রেখে, সেখান থেকে মাটি উঠিয়ে বীজতলা একটু উঁচু ও সমতল করে তৈরী করা যেতে পারে। চারা গজানোর পর প্রয়োজনে বীজতলার মাঝখান দিয়ে হাঁটাচলা করা, চারায় জল সেচ ও অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা করা সহজতর হয়।
(ঘ) প্রতি বর্গমিটার বীজতলায় ৮০-১০০ গ্রাম হারে সমানদূরত্বে বীজ বপন করা উচিৎ। এরূপ এক বর্গ মিটার বীজতলার চারা দিয়ে ২৫-৩০ বর্গমিটার জমিতে রোপণ করা যাবে।
(ঙ) বীজতলা থেকে চারা তোলার ৭ (সাত) দিন পূর্বে প্রতি বর্গ মিটার বীজতলার জন্য ৭ (সাত) গ্রাম হারে ইউরিয়া সার ছিটিয়ে তাতে হালকা করে জল সেচ দেয়া যেতে পারে। এতে করে উৎপাদিত শক্ত-সবল চারা রোপনের পর সহজে, অল্প সময়েই মাটিতে শিকড় গেড়ে লেগে যায়, চারা নষ্ট হয় না
গতানুগতিক ভাবে সমস্ত জমি জুড়ে চাষ দিয়ে তৈরীকৃত বীজতলায় বীজ বপন করলে –
(i) দূর থেকে ছিটিয়ে বীজ বোনার ফলে সমান দুরত্বে বীজ পড়েনা,
(ii) ঘন/দলাদলা বা পাতলাভাবে বীজ পড়লে বীজতলার সব জায়গায় সমান হারে চারা গজায়না,
(iii) বীজতলা সমতল করে তৈরী করা যায় না, ফলে উঁচু স্থানে বোনা বীজ শুকিয়ে এবং গর্ত/নিচু স্থানে বোনা বীজ পঁচে বপনকৃত বীজের ২০-৪০% নষ্ট হয়ে যেতে পারে,
(iv) ঠিকমত পরিচর্যা করা যায়না বিধায় ধানের চারাও অসুস্থ এবং দূর্বল হয়।দেখা যায় যে, গবেষনা প্রতিষ্ঠানে ধান যথাযথভাবে জাক দিয়ে, আদর্শ বীজতলায় উৎপাদিত ২-৩ কেজি বীজের চারা দিয়ে, প্রতি গোছায় ২-৩ টি সবল চারা ব্যবহার করে এক বিঘা জমি রোপণ করা গেলেও, কৃষক ভাইদের গতানুগতিকভাবে তৈরীকৃত বীজতলায় উৎপাদিত প্রায় ১০-১২ কেজি ধানের চারার (প্রতি গুছিতে ৫-১০ টি রোগাক্রান্ত দূর্বল চারা রোপণ) প্রয়োজন হয়।
উত্তমরূপে কাদাময় করে তৈরী জমিতে আউশ মৌসুমে ২০-২৫ দিন, আমন মৌসুমে ৩০-৩৫ দিন এবং বোরো মৌসুমে ৪০-৪৫ দিন বয়সের চারা প্রতি গুছিতে ২-৩ টি করে ২-৩ সেমি গভীরতায় রোপণ করা উচিৎ। বোরো মৌসুমে ধানের চারার বয়স ৪৫ দিনের বেশী হলে, প্রতি দিন বেশী বয়সের জন্য প্রতি হেক্টরে ২০-২৫ কেজি হারে ধানের ফলন কম হতে পারে।
বোরো মৌসুমে ধানের চারা রোপনের আদর্শ সময় হলো ১৫ই ডিসেম্বর থেকে ১৫ই জানুয়ারী (পৌষ মাস), তবে ৩১শে জানুয়ারীর পর প্রতিদিন বিলম্বে চারা রোপণের জন্য হেক্টর প্রতি ৫০-৬০ কেজি ধান কম হতে পারে। রোপা আমন মৌসুমে পুরো আগষ্ট মাস (১৫ শ্রাবন থেকে ১৫ ভাদ্র) ধানের চারা রোপনের আদর্শ সময়। বন্যার জল নেমে যাওয়ার পর, আলোক সংবেদনশীল জাতের ধানের চারা ১৫ সেপ্টেম্বর (৩০ ভাদ্র) পর্যন্ত রোপন করা যায়। এর পর চারা রোপন করলে ধানের ফলন কমে যায়।
বোরো ও রোপা আমন মৌসুমে ২৫ সেমি X´ ১৫ সেমি এবং আউশ মৌসুমে ২০ সেমি ´X ১৫ সেমি দূরে দূরে সারি করে ধানের চারা রোপণ করা উচিৎ। সারিতে রোপণ করে ধানের ফলন ১৫-২০% বৃদ্ধি হতে পারে, অন্যান্য অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা করা সহজতর হয়, ব্যয় সাশ্রয় হয়।
সুত্র: বিকাশপিডিয়া টীম, পশ্চিমবঙ্গ
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/21/2020