ধান থেকে দু’ ভাবে চাল তৈরি করা হয়।
ধান ঝাড়াই–মাড়াই করার পর ব্লোয়ার চালিয়ে হাওয়া দিয়ে ধানকে পুরোপুরি চিটে মুক্ত করা হয়। এর পর কড়া রোদে ফেলে এমন ভাবে শুকনো করা হয় যাতে শুকনো ধানে আর্দ্রতার পরিমাণ ১২ – ১৪ শতাংশের মধ্যে থাকে। বর্তমানে আধুনিক চালকলে ভাঙানোর আগে ধান শুকনো করার কাজটা ড্রয়ারের সাহায্যেই করা হয়। ধানের আর্দ্রতা নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি অথবা কম থাকলে চালের পরিমাণ কমবে অথা ভাঙা চাল বাড়বে। ঠিক মতো শুকনো ধান এ বার সরাসরি কলে ভাঙিয়ে খোসা ও ব্র্যান থেকে এন্ডোস্পার্ম অর্থাৎ চাল আলাদা করে ব্যাগে ভরা হয়। এই ধরনের প্রক্রিয়াপ্রসূত চাল ‘আতপ চাল’ নামে পরিচিত।
এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে শুকনো ধান (আর্দ্রতা ১২ – ১৪ শতাংশ) জলে ভিজিয়ে রাখা হয়। উদ্দেশ্য ধানের কেন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত যাতে ভালো ভাবে ভিজে যায়। আগে ধান ভেজানো হত ঠান্ডা জলে। এতে ধান ভিজতে সময় লাগত ৪০ থেকে ৭০ ঘণ্টা পর্যন্ত। এতক্ষণ জলে ভিজিয়ে রাখার ফলে চালের গুণগত মান নেমে যেত ও চালে ভ্যাপসা গন্ধ হত। তাই এর প্রচলন এখন আর নেই। বর্তমানে প্রচলিত প্রক্রিয়ায় ধান ভেজানো হয় গরম জলে। শুকনো ধানে ভাপ চালিয়ে গরম করে নিয়ে সেই গরম ধান জলে ফেলা হয়। এতে জলের তাপ কিছুটা বেড়ে যায় ও এই ভাবে গরম করা জলে ধান ভিজিয়ে রাখা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ধান ভিজতে সময় লাগে ১৫ – ২০ ঘণ্টা। পরিবর্ত পদ্ধতিতে জল ভাপে গরম করে নেওয়া হয় এবং তার মধ্যে ধান ফেলে ভেজানো হয়। এই পদ্ধতিতে জলের তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে। তবে কখনওই ৬৫০ – ৭০০ সেলসিয়াসের উপর হয় না। চালকল মালিকেরা তাঁদের নিজস্ব ব্যবস্থা ও অভিজ্ঞতার বিচারে ভিন্ন ভিন্ন ধানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন তাপমাত্রা ও ভেজানোর সময় ঠিক করেন। এ ভাবে ধান ভিজতে সময় লাগে ৪ – ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত। জলের তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে সময়। তাপমাত্রা বেশি হলে কম সময়েই ভেজানোর কাজ সমাধা হয়। ভেজাকালীন তাপমাত্রা ৭০০ ডিগ্রির ওপরে হলে ধানের ক্ষতি হয়ে যায়। ভেজানোর কাজ সম্পূর্ণ হলে ধান ছেঁকে তুলে নিয়ে দ্বিতীয় বার ভাপে ফেলা হয় প্রয়োজনীয় সময়মতো। এই ভাবে সিদ্ধ করা ধান আবার নানা পদ্ধতির মাধ্যমে শুকিয়ে নিতে হয় চাল তৈরি করার জন্য। প্রথম ধান যখন নেওয়া হয় তার আর্দ্রতা থাকে ১২ – ১৪ শতাংশ। ভেজানোর শেষে আর্দ্রতা হয় ২৫ শতাংশের আশেপাশে। দ্বিতীয় বার ভাপে রাখার শেষে অর্থাৎ ধান সিদ্ধ হওয়ার শেষে আর্দ্রতা দাঁড়ায় ৩৩-৩৫ শতাংশ। এই আর্দ্রতা আবার নামিয়ে নিয়ে আসা হয় ১২ – ১৪ শতাংশে। মজুত করা অথবা ভাঙানোর জন্য। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে এ ভাবে সিদ্ধ শুকনো ধান ভাঙিয়ে তৈরি হয় চাল। এই প্রক্রিয়ায় তৈরি চালকে সিদ্ধ চাল বলা হয়।
প্রথম পদ্ধতিতে তৈরি হয় আতপ চাল। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে সিদ্ধ চাল। ধান সিদ্ধ করার সময় জলের উত্তাপে ধানের খোসার অভ্যন্তরে নিহিত চালের ভৌতিক ও রাসায়নিক চরিত্রের বড় সড় পরিবর্তনয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য :
উপরোক্ত গুণাগুণ বিচার করে পৃথিবীর অধিকাংশ ধান উত্পাদনকারী দেশের চাল ব্যবসায়ীরা দ্বিতীয় পদ্ধতি অর্থাৎ সিদ্ধ শুকনো করে ধান ভাঙানোর দিকে ঝুঁকছে।
ধান কেটে ঝাড়াই-মাড়াই করে রোদে শুকিয়ে ধানের আর্দ্রতা ১০–১২ শতাংশের মধ্যে আনতে হবে। শুকনো ধান কুলোয় ঝেড়ে অথবা ব্লোয়ার চালিয়ে জোরে হাওয়া দিয়ে চিটে মুক্তো করতে হবে। চিটেমুক্ত শুকনো ধান ঠান্ডা জলে ২৫–৩০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা হয়। তবে ধান ভেজানোর আগে জল উষ্ণ উষ্ণ গরম করে নিতে পারলে চিঁড়ে দীর্ঘ দিন মজুত করা সহজ হয়। উল্লিখিত নির্দিষ্ট সময় ধরে ধান ভেজার পর ধান তুলে জল ঝরিয়ে ফেলা হয়।
এর পর ভিজে ধান ঢিঁকেতে ফেলে পেটানো হয়। বর্তমানে চিঁড়ে তৈরির কল বেরিয়েছ। চিঁড়েকলে রোলারের চাপে ধান চ্যাপ্টা হয়ে যায়। ধানের খোসাও রোলার ঢেঁকির চাপে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে চাল থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসে। ঢেঁকিতে অথবা চিঁড়েকলে ধান চাপানোর আগে বালি খোলায় অল্পক্ষণ ভেজে নিতে পারলে চিঁড়ের গুণমান বর্ধিত হয়।
অতঃপর ঢেকির খোল অথবা চিঁড়েকল থেকে খোসামিশ্রিত চিঁড়ে বের করে নেওয়া হয়। এবং তারের জালের বড়ো চালুনিতে ফেলে উত্তম রূপে চালা হয়। গুঁড়ো চালুনির তলায় পড়ে যায়। চালুনির উপরে চিঁড়ে আলাদা হয়ে জমা হয়।
বর্তমানে অবশ্য অধিকাংশ চিঁড়েই ভাঙানো কলে তৈরি হচ্ছে। কেননা ঢেঁকির প্রচলন কমে গিয়ে তলানিতে এসে পৌছেছে।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে প্রস্তুত চিটেমুক্ত শুকনো ধান লোহার কড়ায় বালির ওপর ফেলে ভাজা হয়। ভাজার সময় গরম বালি-সহ ধান অনবরত নাড়তে হয়। নাড়তে নাড়তেই ধানের খোসা সরিয়ে বেরিয়ে আসে খই। তবে খইয়ের নীচের দিকে তখনও ধানের খোসা আলগা ভাবে আটকে থাকে। খোসা সুদ্ধ খইয়ের পর তারের চালুনিতে ফেলে বেশ কয়েক বার নাড়াচাড়া করলে খোসা ও খই আলাদা হয়ে যায়। চালুনির ফাঁক গলে খোসা নীচে পড়ে। চালুনির ওপরে থেকে যায় খই। বর্তমানে খই তৈরির মেশিন বেরোলেও রাজ্যের অধিকাংশ খই এখনও গাঁয়েগঞ্জে বালি খোলাতে ভেজে তৈরি করা হয়। সব ধানের খই ভালো হয় না। উত্কৃষ্ট খই বানানোর জন্য নির্দিষ্ট কিছু ধানের জাত চাষ করা হয়ে থাকে। যেমন সুগন্ধি খইয়ের জন্য চাষ করা হয় কনকচূড় ধান।
ধান সিদ্ধ শুকনো করে যা চাল তৈরি হয় সেই সিদ্ধ চাল থেকেই মুড়ি বানানো হয়। মুড়ি বানানোর প্রথম ধাপে জল ঝরানো ভেজা চাল আগুনে বসানো শুকনো কড়ায় ফেলা হয়। এর পর চালের ওপর মাপমতো নুন/খাবার সোডা ফেলে কড়া চাল ততক্ষণ নাড়াচাড়া করে যেতে হবে যতক্ষণ না আঠালো হয়। চাল আঠালো হয়ে গেলে কড়া থেকে নামিয়ে বস্তায় মুখ বেঁধে ১ – ২ দিন ফেলে রাখা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে বস্তা থেকে চাল বার করে আগুনের ওপর বসানো শুকনো কড়ায় ভাজতে হবে। শুকনো কড়ায় নাড়াচাড়া করতে করতে ততক্ষণ ভাজতে হবে যতক্ষণ না চাল লাল হয়ে ঠিকমতো শক্ত হয়। যাতে দাঁতে কাটলে ‘কট’ করে শব্দ করে দু’ খানা হয়ে ভেঙে যায়, গুঁড়ো হয়ে বা চেপ্টে যায় না।
তৃতীয় দফায় এই ভাবে ভাজা চাল কড়ায় জ্বাল দিয়ে গরম করা বালির ওপর ফেলতে হবে। ফেলে বালিশুদ্ধ চাল নাড়াচাড়া করতে হবে। বালি ঠিকমতো গরম হলেই চাল ফুটে মুড়ি তৈরি হবে। বালিশুদ্ধ গরম মুড়ি চালুনিতে চেলে নিলেই বালি তলায় পড়ে গিয়ে মুড়ি আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসবে।
সব ধানের মুড়ি সুস্বাদু না হলেও বর্তমানে জাতের বাছবিচার না করে যে কোনও ধানের চাল থেকেই মুড়ি তৈরি হচ্ছে। এবং বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কেবলমাত্র গাঁয়েগঞ্জে নয়, শহরের উপকণ্ঠে এখনও আগুনের আঁচে শুকনো খোলায় ও বালি খোলায় মুড়ি ভাজার কাজ চলছে বাণিজ্যিক ভাবে। তবে মুড়ির চাহিদা বাড়ার যান্ত্রিক কলে মুড়ি বানানো ক্রমশই বাড়ছে।
সিদ্ধ শুকনো ধানের বদলে শুকনো চাল সরাসরি ধান কলে ভাঙিয়ে যে চাল পাওয়া যায় সেই আতপ চাল থেকেই চালভাজা বানানো হয়। খই, চিড়ে, মুড়ির তুলনায় চালভাজার চাহিদা নগণ্য। তবুও শহর ও শহরতলিতে হামেশাই রাস্তার পাশে বালতি উনুনে লোহার কড়ায় বালি খোলায় চালভাজা তৈরি হতে চোখে পড়ে। খই, মুড়ি অথবা চিড়ে অপেক্ষা চালভাজা তৈরির পদ্ধতি অনেক সহজ। কড়ার এক তৃতীয়াংশ বালি ভরে উনুনে বসানো হয়। বালি গরম হলে শুকনো চাল ফেলে নাড়া চাড়া করতে করতে ততক্ষণ ভাজা চলে যতক্ষণ না চাল পট পট করে ফাটতে শুরু করে। পট পট করে চাল ফোটার ৫–১০ মিনিটের মধ্যেই চালভাজা তৈরি হয়ে যায়।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 10/30/2023