উচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে গেলে সঠিক ঘনত্বে সঠিক বয়সের চারা লাগাতে হবে। রোয়া আউশের জন্য ২০ সেমি দূর দূরে সারি ও সারিতে ১০ সেমি (৪’’) অন্তর চালা লাগাতে হবে। আষাঢ় মাসের মধ্যে আউশের রোয়া শেষ করতে হবে। আমনের বেলায় জলদি জাতের চারা ২০ সেমি X ১০ সেমি (৮``X ৪``), মাঝারি জাতের চারা ২০ সেমি X ১৫ সেমি (৮``X ৬``) এবং নাবি জাতের ক্ষেত্রে ২০ সেমি X ২০ সেমি (৮``X ৮``) দূরে দূরে লাগাতে হবে।
সাধারণত গুছিতে ২ – ৩টি চারা থাকলেই যথেষ্ট। কিন্তু আমন ধানের ক্ষেত্রে মাঠে বেশি জল দাঁড়িয়ে গেলে বা চারার বয়স বেশি হলে অথবা নোনা জমিতে, গুছিতে চারার সংখ্যা বাড়িয়ে ৬ – ৭টি করতে হবে। এ সব ক্ষেত্রে বাড়তি চারার প্রয়োজন পড়তে পারে। তাই রোয়ার জমির এক কোণে বাড়তি চারা লাগিয়ে রাখা ভালো। গুছির চারা মারা গেলে ও জলের চাপে ভেসে উঠলে গুছি পূরণের জন্য একই বয়সের চারা লাগানো যায়। তবে গুছি পূরণ রোয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে করতে হবে। আষাঢ় – শ্রাবণের মধ্যে আমনের রোয়া শেষ করতে হবে। আমন ধানের চারা বৃষ্টির কারণে রুইতে দেরি হলে চারার ঘনত্ব বাড়াতে হবে।
বোরো ধানের চারা ২০ সেমি (৮``) X ১৫ সেমি (৬``) ঘনত্বে রুইতে হবে। গুছিতে ৪ – ৫টি চারা রাখা দরকার। নোনা এলাকায় গুছিতে ৬- ৭টি চারা থাকবে। বোরো ধানের রোয়া মাঘ মাসের মাঝামাঝির মধ্যে (জানুয়ারি মাসের শেষে) শেষ করা দরকার।
সব মরশুমেই আউশ আমন ও বোরো রোয়ার সময় লক্ষ রাখতে হবে রোয়ার গভীরতা কোনও মতেই যেন ৪ সেমির (২``) বেশি না হয়। বেশি গভীরে রোয়া হলে পাশ কাঠির সংখ্যা কমে ফলন পড়ে যাবে।
রোয়ার অনুষঙ্গে আরও একটি অত্যন্ত মূল্যবান বিষয় হল চারার বয়স। ঠিক বয়সের চারা রুইলে তবেই সর্বোত্তম ফলন নিশ্চিত হবে। সাধারণ ফর্মুলা হলে যত মাসের ধান তত সপ্তাহের চারা। সল্পমেয়াদি জাতে চারার বয়স হবে ১৫ – ১৮ দিন। মাঝারি জাতের ক্ষেত্রে ২০ – ২৫ দিন ও দীর্ঘমেয়াদি জাতের ক্ষেত্রে ২৫ – ৩০ দিন। শীতকালের ঠান্ডায় বীজতলায় বোরো ধানের চারার বাড়বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলে চারার বয়স ৩৫ – ৪০ দিন না পেরোলো রোয়ার অবস্থায় আসে না, যে কোনও মরশুমেই হোক না কেন।
রোয়ার বিষয়ে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাদামি শোষক পোকাপ্রবণ এলাকায় প্রতি ১৫ – ২০ সারি অন্তর এক সারি ফাঁক রাখা। এতে মাঠে আলো হাওয়া ভালো মতো খেলতে পারে। ফলে শোষক পোকার আক্রমণ কম হয়।
রোয়ার সময় জমিতে ছিপছিপে জল রাখা দরকার। কিন্তু রোয়ার পর চারা ধরে গেলে জমিতে সব সময় জল দাঁড় করিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই। জমি সম্পৃক্ত থাকলেই ফলন সর্বোত্তম হবে। জমি শুকিয়ে মাটিতে চুলের মতো ফাটল ধরলে তবেই মাঠে জল ঢোকানোর প্রয়োজন পড়ে। আমন মরশুমে বৃষ্টি না হলে কখনও সখনও এমন অবস্থা আসতে পারে। তবে বোরো মরশুমে হামেশাই মাঠ শুকিয়ে যায়। তখন সেচ দেওয়ার আবশ্যিক। ধানের পাশকাঠি ছাড়ার মুখে, ফুল আসার মুখে ও দানা পুষ্ট হওয়ার সময় মাঠে জলের টান হলে ফলন মার খাবে। এই সময় জলের জোগান নিশ্চিত করতে হবে।
ধানের ফলনের ওপর জমি তৈরির মস্ত প্রভাব আছে। ধানের জমি ঠিক মতো তৈরি না হলে মাটি থেকে উদ্ভূত জৈব অম্ল বা জৈব গ্যাস ধানের চারা নষ্ট অথবা কমজোরি করে দিতে পারে। আগাছার উপদ্রব বেড়ে ফলনের ক্ষতি অথবা চাষের খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই রোয়ার ১৫ দিন আগে থাকতে জমি তৈরির কাজে নামতে হবে।
জমি চাষ দেওয়ার আগে জমির আলে খড় বা বিচুলি বিছিয়ে রাখলে চাষের সময় বন্ধু পোকাগুলো আলে আশ্রয় নেয়। রোয়ার ২ সপ্তাহ আগে জমিতে প্রথম চাষ দিয়ে জমিতে জল ঢুকিয়ে জমি ফেলে রাখতে হবে টানা ৭ দিন। দ্বিতীয় দফায় অনুরূপ ভাবে চাষ দিয়ে জল বেঁধে জমি আরও ৭ দিন পড়ে থাকবে। ১৫ দিনের মাথায় পড়বে তৃতীয় ও শেষ দফার চাষ। শেষ দফার চাষ দিতে হবে রোয়ার ১ দিন আগে।
প্রথম চাষের সঙ্গে আগের ফসলের গোড়া, মাটির ওপর বেড়ে ওঠা আগাছা মাটির তলায় চাপা পড়বে। এই জৈব পদার্থগুলো ঠিক মতো পচে অ্যামোনিয়াম উত্পাদনের সর্ব্বোচ্চ সীমায় পৌঁছতে সময় নেয় ১৪ – ১৫ দিন। এই সময়সীমা পার না করে রোয়ার কাজ করলে এক দিকে পচন চলাকালীন সময়ে জৈব পদার্থ থেকে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন ইত্যাদি গ্যাস এবং বিউট্রিক অ্যাসিড জাতীয় অম্ল চারার সমূহ ক্ষতি করতে পারে, অন্য দিকে মূল সার হিসাবে ব্যবহৃত নাইট্রোজেন সারের অনেকটাই পচন কার্যে ব্যবহৃত হবে। ধান গাছের কাজে আসবে না। এ ছাড়াও খেপে খেপে চাষের ফলে মাটিতে পড়ে থাকা আগাছার বীজগুলো অঙ্কুরিত হয়ে মাটি চাপা পড়বে, ফলে ধানের মাঠে আগাছার উপদ্রব কমবে। নিড়ানির খরচ কমবে।
বারে বারে চাষ করলে মাটি সঠিক অর্থাৎ থকথকে হয়ে উঠবে।
জমি থকথকে কাদাময় করে ধান রোয়ার নানান সুবিধা : প্রথমত, থকথকে কাদাময় জমিতে মই টেনে জমিকে ঠিক মতো সমতল করা যায়। এতে করে জমি সর্বত্র সমান ভাবে সার ধরে রাখতে পারবে। পরিচর্যার কাজে খরচ কমবে। এ ছাড়াও ‘ড্রাম সিডারের’ মাধ্যমে অঙ্কুরিত বীজ সরাসরি জমিতে বুনতে গেলে বোনার জন্য জমি সমতল হওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়।
দ্বিতীয়ত, থকথকে কাদাময় জমির মাটিতে অক্সিজেনের শূন্য স্তর সৃষ্টি হয়। অক্সিজেনের এই শূন্য স্তর মাটির উর্বরতা ও সারের কার্য্যকারিতা বাড়ায়, থকথকে কাদাময় জমিতে মৃত্তিকাকণার সাথে মূলরোমের নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়। ফলে ধান গাছের ফসফরাস খাদ্যপ্রাণ গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ে।
এক একর জমি রোয়ার উপযোগী চারা তৈরি করতে ১০ শতক জমিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে। পরিচর্যার সুবিধার জন্য চাষ দেওয়ার পর সমগ্র বীজতলাটিকে ১.২০ মিটার (৪ ফুট) চওড়া খণ্ডে ভাগ করে নিতে হবে। প্রতি খণ্ডের চার পাশে ৩০ সেমি (১ ফুট) ও ১০ সেমি (৪ ইঞ্চি) গভীর নালা তৈরি করতে হবে।
সুস্থ সবল চারা তৈরি করার জন্য বীজতলায় জৈব এবং অজৈব উভয় সার আনুপাতিক হারে ব্যবহার করতে হবে। প্রতি ১০ শতক বীজতলার জন্য মূল সার লাগবে — গোবর বা কম্পোস্ট ১ টন ও ২ কেজি হারে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ। বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে শুকনো বীজতলা করতে নাইট্রোজেন মূল সার হিসাবে ব্যবহার না করে চারা তোলার ৭ – ১০ দিন আগে বৃষ্টির সংযোগ নিয়ে চাপান সার হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে।
এ ছাড়াও কাদানো বীজতলায় চারা ভাঙার ৭ – ১০ দিন আগে ১০ শতক বীজতলায় ২ কেজি নাইট্রোজেন চাপান হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।
শুকনো বীজতলায় শুকনো বীজ ও সিক্ত বীজতলায় অঙ্কুরিত বীজ পড়বে। লক্ষ রাখতে হবে বীজতলার সর্বত্র বীজ যেন সমান ভাবে পড়ে। গায়ে গায়ে জড়িয়ে বীজ পড়লে চারা লিকলিকে লম্বা ও দুর্বল হবে। বাছাই করা বীজই বীজতলায় ফেলা দরকার। বীজ বাছাই করার জন্য বালতিতে ১০ লিটার জল নিয়ে তাতে ১.৬৫০ কেজি খাওয়ার লবণ মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করে তাতে বীজ ধান ফেলতে হবে। লবণ-জলে ভেসে থাকা ধান ফেলে দিয়ে ডুবে যাওয়া ধান তুলে পরিষ্কার জলে ধুয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হবে। ১০ লিটার লবণ-জলে ৩০ – ৪০ কেজি বীজ ধান বাছাই করা যায়। বীজতলায় ফেলার আগে বাছাই করা বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজতলায় ছড়ানোর আগে প্রতি কেজি বীজের সঙ্গে ২ – ২.৫ গ্রাম থাইরাম ৭৫% বা ২.৫ – ৩ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম ২৫% শুকনো গুঁড়ো মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
কাদানো বীজতলার বীজ শোধনের জন্য ১.৫ লিটার জলে গ্রাম ট্রাইসাইক্লাজোল অথবা ৪ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম মিশিয়ে তাতে ১ কেজি বাছাই করা বীজ ধান ৮ – ১০ ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখতে হবে। তার পর বীজ ধান তুলে জল ঝরিয়ে অঙ্কুরোদগমের জন্য জাঁক দিতে হবে।
শুকনো বীজতলায় বীজ ফেলার পর বীজতলা জল দিয়ে ডুবিয়ে দিয়ে ২৪ ঘণ্টা জল ধরে রাখতে হবে। পরে কেবল মাত্র নালায় জল রেখে বাকি জল বের করে দিতে হবে। কাদানো বীজতলায় অঙ্কুরিত বীজ ছড়ালে বোনার এক দিন পর বীজতলা ভিজিয়ে সেচ দিতে হবে। চারা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বীজতলায় জলের পরিমাণ বাড়াতে হবে। তবে কোনও ক্ষেত্রেই বীজতলায় ২ – ৫ সেমি বেশি জল যেন না থাকে।
নীরোগ সবল চারা উচ্চ ফলনের বুনিয়াদ। তাই রোগ পোকার হাত থেকে চারা রক্ষা করতে হলে বীজতলায় ওষুধ প্রয়োগ একান্ত প্রয়োজনীয়। শুকনো বীজতলায় চারা ভাঙার ৭ – ১০ দিন আগে ও কাদানো বীজতলায় বীজ বোনার ১৮ – ২৫ দিন পর নিম্নলিখিত যে কোনও একটি ওষুধ প্রতি লিটার জলে গুলে প্রয়োগ করতে হবে –
কাদানো বীজতলাতে দানাদার কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। টুংরো প্রবণ এলাকায় দানাদার কীটনাশক বিশেষ সুফলদায়ী। প্রতি ১০ শতক বীজতলাতে ৫ কেজি কার্বোফুরান ৩ জি বা ৬০০ গ্রাম ফারেট ১০ জি বা ১.৫ কেজি কারটাপ ৪ জি প্রয়োগ করে বীজতলায় ২ ইঞ্চি জল ধরে রাখতে হবে। ঝলসা বা বাদামি রোগ দেখা দিলে প্রতি লিটার জলে নীচের যে কোনও ওষুধ গুলে স্প্রে করতে হবে --
বোরো মরশুমে পৌষের ঠান্ডার ক্ষতির হাত থেকে বীজতলার চারাকে রক্ষা করার জন্য নিচের কাজগুলোও করতে হবে :
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/14/2019