‘আম’কে ফলের রাজা বলা হয়, আর এই ফলটিকে সবাই কমবেশি পছন্দ করেন। এটা মনে করা হয় যে, এই ফলটির উৎস আমাদের দেশেই। ভারতবর্ষে ৬০০০ বছর আগে আমের চাষ শুরু হয়। রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্যেও এই ফলের উল্লেখ পাওয়া যায়। সারা পৃথিবীর মধ্যে ট্রপিক্যাল দেশগুলিতেই আমের ফলন হয়। ভারতে আনুমানিক ৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়, যা উৎপাদনের নিরিখে সারা পৃথিবীর ৮০%। যদিও রফতানির ক্ষেত্রে এই ফলটির অবদান খুবই কম। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়। আমের চাষের বাকি উল্লেখযোগ্য রাজ্যগুলি হল উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র, কেরালা, কর্ণাটক ও তামিলনাড়ু। অতীতে রাজা-মহারাজা-বাদশারা তাঁদের রাজত্বকালে এই ফলটির চাষে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, যার প্রমাণ প্রচলিত আমের জাতের নামকরণের মধ্যেই রয়েছে – রানিপসন্দ, সফদরপসন্দ, কিসেনভোগ, লক্ষ্মণভোগ। এ ছাড়াও, গোলাপখাস, পেয়ারাফুলি, হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি, চৌসা ইত্যাদি। শুনলে অবাক হতে হয় মুর্শিদাবাদ জেলায় ‘কোহিতুর’ নামে আমের যে প্রজাতির চাষ হয়, সেটি এতই সংবেদনশীল যে তুলোয় মোড়া আঁকশির সাহায্যে গাছ থেকে তাকে পাড়তে হয় এবং পরে তুলোর বাক্সে তাকে রাখতে হয়। নচেৎ দাগি হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। অতীতের আমের জাতগুলির অনিয়মিত ফলন একটি বড় সমস্যা। সাধারণত এক বছর অন্তর ফলন হয়। সে কারণে, ভারতীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কৃষি-গবেষকদের নিরলস প্রচেষ্টা ও প্রয়াসে আমের কয়েকটি সংকর জাতের উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আম্রপালি, মল্লিকা, রত্না ইত্যাদি। এই সংকর জাতগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল আয়তনে ও উচ্চতায় প্রচলিত জাতগুলি থেকে ছোট হওয়ার ফলে অল্প জায়গায় লাগানো যায়। যে কারণে প্রচলিত জাতের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় যতগুলো গাছ লাগানো যায়, ওই সম-আয়তনের জায়গায় সংকর জাতের গাছ দ্বিগুণ সংখ্যায় লাগানো যায়। অন্য দিকে সংকর জাতের গাছ নিয়মিত ফলন দেয় এবং এই ফল দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। এর ফলন প্রচলিত জাতের থেকে অনেক বেশি এবং স্বাদেও বেশি মধুর হয়। উন্নত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা যদি আমের চাষ, সংরক্ষণ ও গুদামজাত করার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে পারি তা হলে এই ফল রফতানি করে আমরা প্রচুর বিদেশি মুদ্রা অর্জন করতে পারি। কারণ এই ফলটির কদর সারা পৃথিবী জুড়ে এবং আমরাই সারা পৃথিবীর সিংহভাগ এলাকায় আমের চাষ করি।
গোলাপখাস, সরিখাস, পেয়ারাফুলি, সফদারপসন্দ, বোম্বাই ইত্যাদি। মাঝারি – হিমসাগর, রানিপসন্দ, কিশেনভোগ, অনুপম ইত্যাদি। নাবি – ল্যাংড়া, ফজলি, লক্ষণভোগ, চৌসা, আশ্বিনা, আম্রপালি, মল্লিকা ইত্যাদি
ফলের বাগান করার জন্য অতিরিক্ত জল বের হওয়ার উপযুক্ত নিকাশিব্যবস্থার সুবিধাযুক্ত উঁচু পর্যাপ্ত রোদ পায় এই ধরনের জমি নির্বাচন করতে হবে। জমির মাটি উপযুক্ত করার জন্য চারা লাগানোর আগে ওই জমিতে সবুজ সার হিসাবে ধনে, কলাই ইত্যাদি চাষ করে মাটিতে মেশাতে হবে। বাগানের ভিতর জলের উত্স থাকার প্রয়োজন আছে সেচের সুবিধার জন্য। বাগানের চার দিকে ঘন পাতাবিশিষ্ট গাছ যেমন সোনাঝুরি ইত্যাদি জাতীয় গাছ লাগাতে হবে, যাতে ফলের গাছ ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে পারে। বাগানের মধ্য যাতায়াতের জন্য রাস্তা এবং সেচ ও নিকাশি নালা করার জন্য ফাঁকা জায়গার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বর্ষার শুরুতে চারা লাগানোর এক মাস আগে সঠিক মাপের গর্ত খুঁড়ে তাতে পর্যাপ্ত জৈবসার দিয়ে রাখতে হবে। চারা লাগানোর আগে নিমখোল বা উইপোকা নিয়ন্ত্রণকারী কীটনাশক দিতে হবে। পিট বা গর্তের মাপ ১ মি x ১ মি x ১ মি সাইজের পিট বা গর্ত করতে হবে। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব আম্রপালি ও মল্লিকার ক্ষেত্রে – ৬ মি x ৬ মি অন্যান্য জাতের ক্ষেত্রে – ১১ মি x ১১ মি
বাড়ছে আমের চাষ। মানসম্পন্ন আম ফলাতে তাই দরকার আধুনিক উত্পাদন কৌশল। আম চাষিদের জানা দরকার কীভাবে জমি নির্বাচন, রোপণ দূরত্ব, গর্ত তৈরি ও সার প্রয়োগ, রোপণ প্রণালী, রোপণের সময়, জাত নির্বাচন, চারা নির্বাচন, চারা রোপণ ও চারার পরিচর্যা করতে হয়। মাটি ও আবহাওয়ার কারণে দেশের সব জেলাতে সব জাতের আম হয় না। আমের জন্য মাটির অম্লতা দরকার ৫.৫-৭.০। অনেক সময় দেখা যায় পাহাড়ি ও বরিশাল বিভাগের অনেক জেলাতে ফজলী, ল্যাংড়া, খিরসাপাত ও আশ্বিনা জাতগুলো ভাল হয়। সুতরাং কাঙ্ক্ষিত জাতটি নির্বাচিত জায়গায় হবে কিনা তা বিবেচনায় রাখতে হবে।
গভীর, সুনিষ্কাশিত, উর্বর দো-আঁশ মাটি আম চাষের জন্য ভাল। বর্ষায় জল দাঁড়ায় না এমন উঁচু বা মাঝারী উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে। কয়েকবার চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল এবং আগাছামুক্ত করতে হবে। রোপণ দূরত্ব নির্ভর করে আমের জাতের উপর। দ্রুত বর্ধনশীল আমের জাত বা বড় আকৃতির গাছ হলে সাধারণত ১২ মিটার বা প্রায় ৪০ ফুট দূরত্বে লাগাতে হবে। এই দূরত্বে গাছ লাগালে এক বিঘা জমিতে প্রায় ৯টি গাছ লাগানো যাবে। মধ্যম আকৃতির গাছ হলে ১০ মিটার বা ৩৫ ফুট দূরত্বে লাগানো যাবে এবং দূরত্ব অনুসরণ করলে এক বিঘা জমিতে ১৩টি গাছ লাগানো যাবে। খাটো আকৃতির জাত যেমন- বারি আম-৩ (আম্রপলি) হলে ৬-৮ মিটার দূরত্বে লাগানো যাবে এবং এ দূরত্ব অনুসরণ করলে এক বিঘা জমিতে প্রায় ২০-২৭টি গাছ লাগানো যাবে। জাতভেদে আম গাছের রোপণ দূরত্ব ৬×৬ মিটার; ১০×১০ মিটার এবং ১২×১২ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বর্গাকার, আয়তাকার, ত্রিভুজাকার বা ষড়ভুজাকার যে প্রণালীতে চারা রোপণ করা হোক না কেন, গাছ লাগানোর স্থানটি চিহ্নিত করে বর্ষা শুরুর আগেই সেখানে গর্ত করতে হবে। সাধারণত মে-জুন মাসে ৭৫-১০০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতায় গর্ত করতে হবে। গর্ত করার সময় গর্তের উপরের অর্ধেক অংশের মাটি একপাশে এবং নিচের অংশের মাটি অন্যপাশে রাখতে হবে। গর্ত থেকে মাটি উঠানোর পর ১০ দিন পর্যন্ত গর্তটিকে রোদে শুকাতে হবে। এরপর প্রতি গর্তে ১০ কেজি গোবর সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমপি, ২৫০ গ্রাম জিপসাম, ৫০ গাম জিংক সালফেট এবং ১০ গ্রাম বোরিক এসিড উপরের অংশের মাটির সাথে মিশিয়ে মাটি ওলোট-পালোট করে গর্ত ভরাট করতে হবে। গর্ত ভরাটের সময় উপরের অর্ধেক অংশের মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট না হলে প্রয়োজনে পাশ থেকে উপরের মাটি গর্তে দিতে হবে। তবে গর্তের নিচের অংশের মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করা যাবে না।
সুস্থ-সবল ও রোগমুক্ত চারা রোপণ করলে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যায়। রোপণের জন্য ৪-৫ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ২-৩টি ডাল বিশিষ্ট চারা নির্বাচন করতে হবে। ২-৩ বছর বয়সী ফাটল/ভিনিয়ার কলমের চারা বাগানে লাগানোর জন্য ভাল। গর্ত ভর্তি করার ১০-১৫ দিন পর পুনরায় গর্তের মাটি ভালভাবে উলোট-পালোট করে গর্তের মাঝখানে চারাটি সোজাভাবে লাগিয়ে তারপর চারদিকে মাটি দিয়ে গাছের গোড়া সমান্য চেপে দিতে হবে। চারা রোপণের সময় চারার গোড়ার বলটি যেন ভেঙে না যায় এবং চারা গোড়াটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাটির নিচে ঢুকে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রোপণের পর চারাটি খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। বিকেল বেলায় চারা/কলম রোপণ করা ভাল। রোপণের পর বৃষ্টি না থাকলে কয়েকদিন সেচ দিতে হবে। গাছে নতুন পাতা বের হলে পাতাকাটা উইভিল পোকা আক্রমণ করতে পারে। কচি পাতার নিচের পিঠে মধ্যশিরার উভয়পাশে স্ত্রী পোকা ডিম পাড়ে। পরে স্ত্রী পোকা ডিমপাড়া পাতাটির বোঁটার কাছাকাছি কেঁটে দেয়। শেষে গাছটি পাতাশূন্য হয়ে যায়। কর্তিত কচি পাতা মাটি থেকে সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। গাছে কচি পাতা বের হওয়ার ৬ দিন এবং ১২ দিন পর প্রতি লিটার জলতে ২ গ্রাম সেভিন অথবা যেকোনো কীটনাশক নির্দেশিত মাত্রায় সেপ্র করলে পোকার আক্রমণ হয় না।
বাজারজাত করার জন্য কোন জাতের আমের চাহিদা বেশি, গুণগতমান ভাল এবং বাজারমূল্য বেশি তা জানা দরকার। আমাদের দেশে বেশ কিছু উত্কৃষ্ট মানের আমের জাত (ল্যাংড়া, খিরসাপাত, হিমসাগর, ফজলী, গোপাল ভোগ ও বোম্বাই) রয়েছে। যেগুলো রঙিন না হলেও স্থানীয় বাজারে এর চাহিদা বেশি। কিন্তু এ জাতগুলো বিদেশে রফতানি করে তেমন মুনাফা পাওয়া যাবে না। কারণ বিদেশের বাজারে রঙিন ও হালকা মিষ্টি আমের চাহিদা বেশি। এর জন্য বারি আম-২ এবং বারি আম-৭ জাত দু’টি উপযুক্ত। তবে পশ্চিমবঙ্গ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতি বছর ফল দিতে সক্ষম এমন কয়েকটি জাত উদ্ভাবন করেছে। জাতগুলো হলো বারি আম-১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮। এ জাতের চারা দিয়ে বাগান করলে ভাল ফলনের পাশাপাশি লাভবান হওয়া যায়।
পশ্চিমবঙ্গে যে ৭০টি ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় তার মধ্যে আম অন্যতম। মোট ফল চাষের ৪০ ভাগ জমিতে আম চাষ হলেও দিনদিন এর পরিধি আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিভিন্ন অঞ্চলে ফলনের তারতম্য দেখা যায়। যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহীতে আমের ফলন অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি। উত্পাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে একটু যত্নবান হলে ফলন কয়েকগুণ বাড়ানো যায়। আর তাই যত্ন নিতে হবে আম সংগ্রহের পর থেকেই। রোগাক্রান্ত ও মরা ডালপালা একটু ভাল অংশসহ কেটে ফেলতে হবে মৌসুমের পর। ডালপালা এমনভাবে ছাটাই করতে হবে যেন গাছের ভেতর পর্যন্ত সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে। গাছের ভেতরমুখি ডালে সাধারণত ফুলফল হয় না, তাই এ ধরনের ডাল কেটে ফেলতে হবে। বর্ষাকালে কাটা অংশগুলো থেকে নতুন কুশি গজাবে এবং পরের বছরে ওই নতুন কুশিগুলোতে ফুল আসবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে- ডগার বয়স ৫ থেকে ৬ মাস না হলে ওই ডগায় সাধারণত ফুল আসে না। আগামী বছরে একটি গাছে কী পরিমাণ ফলন আসতে পারে তা আগস্ট মাসেই ধারনা পাওয়া যায়। এ সময়ের মধ্যে গাছে যত বেশি নতুন ডগা গজাবে ততই ভাল।
আমবাগানে সার প্রয়োগের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি গাছে বছরে কি পরিমাণ সার দিতে হবে তা নির্ভর করে মাটির গুণাগুণের উপর। গাছ বাড়ার সাথে সাথে সারের চাহিদাও বাড়তে থাকে। বছর অনুযায়ী সারের পরিমাণ দেয়া হল- গোবর সার দিতে হবে রোপণের ১ বছর পর ২০, রোপণের ২ বছর পর ২৫, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ৫ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ১২৫ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে ইউরিয়া রোপণের ১ বছর পর ২৫০, রোপণের ২ বছর পর ৩৭৫, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ১২৫ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ২৭৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। টিএসপি রোপণের ১ বছর পর ১০০, রোপণের ২ বছর পর ২০০, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ১০০ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ২১৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। এমপি রোপণের ১ বছর পর ১০০, রোপণের ২ বছর পর ২০০, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ১০০ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ২১০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। জিপসাম রোপণের ১ বছর পর ১০০, রোপণের ২ বছর পর ১৭৫, প্রতিবছর বাড়াতে হবে ৭৫ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ১৬০০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। জিংক সালফেট রোপণের ১ বছর পর ১০, রোপণের ২ বছর পর ১৫, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ৫ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ১১০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। বোরিক এসিড রোপণের ১ বছর পর ৫, রোপণের ২ বছর পর ৭, প্রতি বছর বাড়াতে হবে ২ এবং ২০ বছর ও এর উর্ধ্বে ৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে।
সব সার দু’কিস্তিতে প্রয়োগ করা ভাল। প্রথম অর্ধেক বর্ষার আগে এবং বাকিটা আশ্বিন মাসে অর্থাত্ বর্ষার পরে। যদি কোনো আমচাষি প্রথম কিস্তির সার প্রয়োগ না করেন তবে দ্বিতীয় কিস্তির সময় চাহিদার পুরো সারটাই প্রয়োগ করতে হবে। অনেক আমচাষি বাগানের ফজলি ও আশ্বিনা আম সংগ্রহ করার পর সার প্রয়োগ করেন যা মোটেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। ফলন্ত গাছে গুঁড়ি থেকে ২-৩ মিটার দূরত্বে ৩০ সে.মি. প্রশস্ত ও ১৫-২০ সে.মি. গভীর করে চক্রাকার নালা কেটে তার ভেতর রাসায়নিক ও জৈব সার মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। অথবা দুপুরবেলা যতটুকু জায়গায় গাছের ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় সার ছিটিয়ে কোঁদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সাধারণত আমগাছে ফল আসার পর গাছগুলো দুর্বল হয়ে যায়। ফলে গাছের প্রয়োজন হয় খাদ্যের। সার দেয়ার পর বর্ষা শুরু হলে গাছ তার প্রয়োজনীয় খাদ্য মাটি থেকে নিতে পারে।
আমবাগানে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। তবে মাটিতে রস থাকলে সেচের দরকার হবে না। গবেষণায় দেখা গেছে, আমগাছে পরিবর্তিত বেসিন পদ্ধতিতে অর্থাত্ গাছের গোড়ার চারদিকে এক মিটার জায়গা সামান্য উঁচু রেখে দুপুরবেলা যতটুকু জায়গায় গাছের ছায়া পড়ে ততটুকু জায়গায় একটি থালার মত করে বেসিন তৈরি করে সেচ দিলে জলর পরিমাণ কম লাগে এবং বেশির ভাগ জল গাছ গ্রহণ করতে পারে। বেসিন পদ্ধতির আরেকটি সুবিধা হল গাছের গোড়া পরিষ্কার থাকে ফলে আগাছা জন্মাতে পারে না। সেচ দেয়ার পর জায়গাটি কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দিলে মাটিতে একমাস পর্যন্ত রস থাকবে। তবে আমগাছে ফুল আসার একমাস আগে সেচ না দেয়াই ভাল। এ সময় সেচ দিলে গাছে নতুন পাতা বের হবে এতে মুকুলের সংখ্যা কমে গিয়ে ফলন কমে আসবে।
আমবাগানে জৈব পদার্থের ঘাটতি থাকলে ধৈঞ্চার চাষ করতে হবে। এতে বাগানে জৈব পদার্থসহ অন্যান্য সার যোগ হলে মাটির উত্পাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আমগাছে ২/৩ ধরনের পরগাছা দেখা যায়। ছোট গাছের চেয়ে বড় গাছে পরগাছার আক্রমণ বেশি হয়। পরগাছার বীজ আমগাছের ডালে অঙ্কুরিত হয়ে বাড়তে থাকে এবং ডাল থেকে প্রয়োজনীয় জল, খাদ্যরস, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি শোষণ করে বেঁচে থাকে। পরগাছার কোনো শেকড় থাকে না। শেকড়ের মত এক ধরনের হস্টোরিয়া তৈরি করে। ডাল থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। বর্ষাকালে পরগাছার বীজ বেশি বিস্তার লাভ করে।
আক্রান্ত ডাল পরগাছার গোড়াসহ কেটে ফেলতে হবে। কাটা স্থানে রোগের আক্রমণ যাতে না হয় তার জন্য বোর্দো পেস্টের প্রলেপ দিতে হবে। পরগাছায় ফুল ফল আসার আগেই এ কাজটি করতে হবে।
আমগাছে শতভাগ মুকুল আসা ভাল না। এতে ফলন ব্যাহত হয়। তাই শতভাগ মুকুলায়িত আমগাছের চারদিক থেকে ৫০% মুকুল ফোটার আগেই ভেঙে দিতে হবে। এতে ভাঙা অংশে নতুন কুশি গজাবে এবং পরবর্তী বছরে ওই সব ডগায় ফুল আসবে, আম আসবে।
উপরোক্ত বিষয়সমূহে নজর দিলে অবশ্যই প্রতিবছর আমের ভাল ফলন পাওয়া যাবে। আম চাষি লাভবান হবেন।
জ্যৈষ্ঠ মাস হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মধুমাস। আর এই মধুমাসের মধুফল হল আম। এই আমকে ঘিরে হয়েছে বাঙালির অনেক ঐতিহ্য এবং নানা ধরনের খাবার। তারই অংশ হিসেবে এরই মধ্যে ফলগাছ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বসতবাড়ির আঙ্গিনায় ও বাণিজ্যিকভাবে চাষোপযোগী বিভিন্ন উন্নত জাতের উচ্চ ফলনশীল বামন প্রকৃতির আমের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এছাড়াও বছরে দুই থেকে তিনবার ফলনশীল, পলিঅ্যামব্রায়োনিক, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ডায়াবেটিক আমসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আমের জাত উদ্ভাবন করেছেন।
চারা লাগানোর এক মাস আগে প্রতিটি গর্তে জৈবসার ২০ কেজি, নিমখোল ১.৫–২ কেজি এবং ফলিডল ডাস্ট ২৫ গ্রাম, আর ৫০০ গ্রাম সি. সুপার ফসফেট দিতে হবে।
বর্ষার আগে প্রতি গাছ লাগানোর আগে জৈবসার ২০ কেজি ও না : ফ : প - ৫০ গ্রাম : ২৫ গ্রাম : ২৫ করে দিতে হবে। এর পর বর্ষার পরে একই হিসাবে সার দিতে হবে। এর পর গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সারের পরিমাণ নির্দিষ্ট হারে বাড়াতে হবে এবং প্রতিটি ফলন্ত গাছে সর্বোচ্চ বর্ষার আগে জৈবসার ৫০ কেজি ও নাইট্রোজেন ১ কেজি আর বর্ষার পরে জৈবসার ৫০ কেজি ফ ও প, ৭৫০ গ্রাম করে দিতে হবে।
গ্রীষ্ম ও শীতে প্রয়োজনমতো সেচ দিতে হবে, প্রয়োজনে ৩–৪ সপ্তাহ অন্তর সেচ দিতে হবে। গ্রীষ্মকালীন সয়মে ২–৩ বার লাঙল দিয়ে চাষ দিলে আগাছা-সহ রোগ ও পোকার উপদ্রব কম হবে। যে হেতু ফলের বাগানে ৩–৪ বছরের আগে ফল পাওয়া যায় না, এ জন্য ফাঁকা জমিতে সাথী ফসলের চাষ করা যেতে পারে। প্রয়োজনমাফিক ডালপালা ছাঁটতে হবে এবং রোগ পোকা আক্রান্ত ডালপালা কেটে পুড়িয়ে দিতে হবে। সঠিক ও সুষম সার প্রতি গাছে দু’বার অর্থাৎ বর্ষার আগে ও পরে কাণ্ডের গোড়া থেকে কিছু দূরে গোলাকার গর্ত করে দিয়ে ভালো করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে, যাতে শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অতিরিক্ত শীত ও গ্রীষ্মের সময়ে সার প্রয়োগ করা যাবে না। আমের গুটি ধরার ঠিক পরেই এক বার ও ১৫ দিন পর আর এক বার আলফা ন্যাপথেলিন অ্যাসেটিক অ্যাসিড জাতীয় ওষুধ ২০ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করলে অসমসয়ে গুটি ঝরা কমানো যায়। গুটি ধরার পর বৃষ্টি না হলে শুধু মাত্র স্প্রে করেও ফলের বোঁটা শক্ত হয়।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/15/2020