গোলাপকে ফুলের রানি বলা হয়। পশ্চিমবঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে বহুজমিতে গোলাপের চাষ হচ্ছে এবং দিন দিন গোলাপের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং গোলাপ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
পৃথিবীজুড়ে গোলাপের অসংখ্য জাত রয়েছে। জাতগুলোর কোনোটির গাছ বড়, কোনোটি ঝোপালো, কোনোটি লতানো। জাত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী গোলাপ সাদা, লাল, হলুদ, কমলা, গোলাপি এবং মিশ্রিত রঙের হয়ে থাকে। এ ছাড়াও রানি এলিজাবেথ (গোলাপি), ব্ল্যাক প্রিন্স (কালো), ইরানি (গোলাপি), মিরিন্ডা (লাল), দুই রঙা ফুল আইক্যাচার চাষ করা হয়।
গোলাপের বংশ বিস্তারের জন্য অবস্থাভেদে শাখা কলম, দাবা কলম, গুটি কলম ও চোখ কলম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। নতুন জাত উদ্ভাবনের জন্য বীজ উৎপাদন করে তা থেকে চারা উপাদন করা হয়।
গোলাপ চাষের জন্য উর্বর দোআঁশ মাটির জমি নির্বাচন করা উত্তম। ছায়াবিহীন উঁচু জায়গা যেখানে জলাবদ্ধতা হয় না, এরূপ জমিতে গোলাপ ভালো জন্মে।
নির্বাচিত জমি ৪-৫ টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুর ঝুরা ও সমতল করতে হবে। এরপর মাটি কুপিয়ে ৫ সেমি উঁচু করে ৩ মি. x ১মি. আকারের বেড বা কেয়ারি তৈরি করতে হবে। এভাবে কেয়ারী তৈরির পর নির্দিষ্ট দূরত্বে ৬০ সেমি. x ৬০ সেমি. আকারের এবং ৪৫ সেমি. গভীর গর্ত খনন করতে হবে। গর্তের উপরের মাটি ও নিচের মাটি আলাদা করে রাখতে হবে। চারা রোপণের ১৫ দিন আগে গর্ত করে খোলা রাখতে হবে। এ সময়ে গর্তের জীবাণু ও পোকামাকড় মারা যায়।
প্রতি গর্তের উপরের মাটির সাথে ছকে প্রদত্ত সারগুলো মিশিয়ে গর্তে ফেলতে হবে। এরপর নিচের মাটির সাথে ৫ কেজি পচা গোবর, ৫ কেজি পাতা পচা সার ও ৫০০ গ্রাম ছাই ভালোভাবে মিশিয়ে গর্তের উপরের স্তরে দিতে হবে। এভাবে গর্ত সম্পূর্ণ ভরাট করার পর ১৫-২০ দিন ফেলে রাখলে সারগুলো পচবে ও গাছ লাগানোর উপযুক্ত হবে। বর্ষাকালে যাতে গাছের গোড়ায় বৃষ্টির জল জমে না থাকে, সে জন্য নালা তৈরি করতে হবে।
আশ্বিন মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। তবে পৌষ মাস পর্যন্ত চারা লাগালে বেডের গর্তের মাঝখানে ক্ষুদ্রাকৃতির গর্ত খুঁড়ে চারা লাগাতে হয়। প্রথমে পলিথিন ব্যাগ বা মাটির টব থেকে চারা বের করে দুর্বল শাখা, রোগাক্রান্ত শিকড় ইত্যাদি কেটে ফেলতে হয়। চারা লাগিয়ে গোড়ায় শক্তভাবে মাটি চেপে দিতে হবে। চারা রোপণের পর চারাটি একটি খুঁটি পুতে খুঁটির সাথে বেঁধে দিতে হবে। চারা লাগিয়ে গোড়ায় জল দেওয়া উচিত। ২-৩ দিন ছায়ার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।
গোলাপের কেয়ারিতে অনেক আগাছা হয়। আগাছা তুলে ফেলতে হবে।
মাটির আর্দ্রতা যাচাই করে গাছের গোড়ায় এমনভাবে সেচ দিতে হবে যেন মাটিতে রসের ঘাটতি না হয়।
গোলাপের কেয়ারীতে কোনো সময়ই জল জমতে দেওয়া উচিত নয়। কারণ গোলাপ গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
গোলাপের নতুন ডালে বেশি ফুল হয়। তাই পুরাতন ও রোগাক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করা প্রয়োজন। প্রতিবছর গোলাপ গাছের ডালপালা ছাঁটাই করলে গাছের গঠন কাঠামো সুন্দর ও সুদৃঢ় হয় এবং অধিক হারে বড় আকারের ফুল ফোঁটে।
অনেক সময় ছাঁটাই করার পর মূলগাছের ডালে অনেক পত্রমুকুল ও ফুলকুঁড়ি জন্মায়। সবগুলো কুঁড়ি ফুটতে দিলে ফুল তেমন বড় হয় না। তাই বড় ফুল ফোটার জন্য আসল কুঁড়ি রেখে পাশের কুঁড়ি গুলো ধারালো চাকু দিয়ে কেটে দিতে হয়।
গোলাপ গাছে যেসব পোকা দেখা যায় তন্মধ্যে রেড স্কেল ও বিটল প্রধান।
এ পোকা দেখতে অনেকটা মরা চামড়ার মতো। গরমের সময় বর্ষাকালে এর আক্রমণ বেশি পরিলক্ষিত হয়। এ পোকা গাছের বাকলের রস চুষে খায়। ফলে বাকলে ছোট ছোট কালো দাগ পড়ে। প্রতিকার না করলে আক্রান্ত গাছ মারা যায়। গাছের সংখ্যা কম হলে দাঁত মাজার ব্রাশ দিয়ে আক্রান্ত স্থানে ব্রাশ করলে পোকা পড়ে যায়। ম্যালাথিয়ন বা ডায়াজিনন ঔষধ প্রয়োগ করে এ পোকা দমন করা যায়।
শীতকালের শেষে এ পোকার আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়। এ পোকা গাছের কচি পাতা ও ফুলের পাপড়ি ছিদ্র করে খায়। সাধারণত রাতের বেলা আক্রমণ করে। আলোর ফাঁদ পেতে এ পোকা দমন করা যায়। ম্যালথিয়ন বা ডাইমেক্রন ছিটিয়ে এ পোকা দমন করা যায়।
গোলাপ গাছে অনেক রোগ হয়। তন্মধ্যে কালো দাগ পড়া রোগ, ডাইব্যাক ও পাউডারি মিলডিউ প্রধান।
এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। রোগাক্রান্ত গাছের পাতায় গোলাকার কালো রঙ্গের দাগ পড়ে। আক্রান্ত গাছের পাতা ঝরে গিয়ে গাছ পত্রশূন্য হয়ে যায়। চৈত্র থেকে শুরু করে কার্তিক মাস পর্যন্ত এ রোগের আক্রমণ ঘটে। এ রোগের প্রতিকারের জন্য গাছে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের গোড়ায় যেন জল জমে না থাকে সে দিকে খেয়াল করতে হবে। এ ছাড়া ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে এ রোগ দমন করা যায়। আক্রান্ত পাতাগুলো কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হয়।
ডাল ছাঁটাইয়ের কাটা স্থানে এ রোগ আক্রমণ করে। এ রোগ হলে গাছের ডাল বা কাণ্ড মাথা থেকে কালো হয়ে নিচের দিকে মরতে থাকে। এ লক্ষণ ক্রমে কাণ্ডের মধ্য দিয়ে শিকড় পর্যন্ত পৌঁছে এবং সম্পূর্ণ গাছ মারা যায়। এ রোগ দমন করতে হলে আক্রান্ত কাণ্ড বা ডালের বেশ নিচ থেকে কেটে পুড়ে ফেলতে হবে। ডাল ছাঁটাইয়ের চাকু জীবাণুনাশক দিয়ে মুছে ডাল ছাঁটাই করা উচিত। কর্তিত স্থান স্পিরিট দিয়ে মুছে দিতে হবে।
এটি একটি ছত্রাক জনিত রোগ। শীতকালে কুয়াশার সময় এ রোগে বিস্তার ঘটে। এ রোগে আক্রান্ত হলে পাতা, কচিফুল ও কলিতে সাদা পাউডার দেখা যায়। ফলে কুঁড়ি না ফুটে নষ্ট হয়ে যায়। এ রোগ দমন করতে হলে আক্রান্ত ডগা বা পাতা তুলে পুড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়া থিওভিট বা সালফার ডাইথেন এম-৪৫ জলতে মিশিয়ে সপ্তাহে একবার সেপ্র করে এ রোগ করা যায়।
ফুল ফোটার পূর্বেই গাছ হতে ফুল সংগ্রহ করতে হয়। সংগ্রহের পর ফুলের ডাটার নিচের অংশ পরিষ্কার জলতে ডুবিয়ে ঠাণ্ডা জায়গায় রাখলে ফুল ভালো থাকে। মাঝে মাঝে ফুলে জলর ছিটা দেওয়া ভালো।
গোলাপ চাষে ক্যাপ প্রযুক্তি একটি সফল ও জনপ্রিয় প্রযুক্তি হওয়ার পরও পশ্চিমবঙ্গে এর ব্যবহার নেই বললেই চলে। যে গোলাপ ফুলটির দাম বর্তমানে দুই টাকা, ক্যাপ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সেই ফুলটির গুণগতমান বৃদ্ধি পেয়ে দাম হয় 5 টাকা। শুধু তাই নয়, ফুলটি আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানির উপযোগী হয়। আর এ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য ফুলপ্রতি খরচ হয় মাত্র 30 পয়সা।
আন্তর্জাতিক বাজারে চীনের ফুলের চাহিদা বেশি। উন্নতমানের গোলাপ উত্পাদনের জন্য সে দেশের ফুলচাষিরা নিয়মিত রোজক্যাপ ব্যবহার করেন। রোজক্যাপ হল স্থিতিস্থাপকতা গুণসম্পন্ন প্লাস্টিকের এক ধরনের ক্যাপ। গোলাপের কুঁড়ি বের হওয়ার পর ক্যাপটি ওই কুঁড়িতে পরিয়ে দিতে হয়। এতে গোলাপ কুঁড়িটি সুরক্ষিত থাকে এবং পোকা-মাকড়ের উপদ্রব ও প্রাকৃতিক সব ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়। এ ক্যাপটি স্থিতিস্থাপক হওয়ায় কুঁড়িটি বড় হওয়ার সাথে সাথে ক্যাপটিও বাড়তে থাকে। এ কারণেই ক্যাপের ভেতর কুঁড়িটি একটি উন্নতমানের পূর্ণাঙ্গ গোলাপ হিসেবে প্রস্ফুটিত হয়। গোলাপের বাহিরে ক্যাপটি থাকায় ফুল সংগ্রহ, পরিবহন এবং বাজারজাতকরণে ফুলের কোনো ক্ষতি হয় না।
পশ্চিমবঙ্গে উন্নতমানের গোলাপ উত্পাদনের জন্য এখনো রোজক্যাপ নামে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি ফুলচাষিদের অজানা। এ কারণেই দেশে এই ক্যাপ তৈরি হয় না এবং আমদানিরও ব্যবস্থা নেই। সমপ্রতি কয়েকজন উদ্যোক্তা চীন থেকে কিছু ক্যাপ এনে ব্যবহার করে শতভাগ সুফল পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে গদখালির সরদার নার্সারি। এই নার্সারির মালিক রুস্তম আলী সরদার জানান, আগে যে ফুল ফুটত সেগুলো প্রতিটি বিক্রি হত দুই টাকায়। এখন সেই ফুল এত উন্নতমানের হচ্ছে যে তার দাম উঠেছে ১০ টাকায়। শুধু তা-ই নয়, এ ফুলের সবটাই রফতানি মানের। তবে এই ক্যাপ আমদানি না হওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছে না। ফুলচাষিদের কল্যাণে বিশেষ করে ফুল রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের স্বার্থে রফতানিযোগ্য ফুল উত্পাদনের জন্য তারা রোজক্যাপ আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
ফুল চাষের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ফুল চাষের বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কৃষি কর্মকর্তা না থাকায় কৃষি বিভাগের কাছ থেকে কোনো পরামর্শ পাওয়া যায় না। গত তিন দশক ধরে ফুলের যে চাষ হচ্ছে তা অনেকটা অনুমানের ওপর নির্ভর করে। আন্দাজে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় ফুলচাষিরা ক্ষতির শিকার হন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে পশ্চিমবঙ্গের ফুলের বাজার তৈরি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে তবে এর জন্য প্রয়োজন নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহার ও আর্ন্তজাতিক গুণগতমানসম্পন্ন ফুল উত্পাদন। এক্ষেত্রে রোজক্যাপ প্রযুক্তি নিঃসন্দেহে একটি ভাল উদ্যোগ।
উত্পাদিত ফসল বা পণ্যের মূল্য সংযোজনের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই সময়ে দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার জন্য নিত্যনতুন প্রযুক্তি গ্রহণ অপরিহার্য। আমাদের দেশে বিভিন্ন দিবস ও অনুষ্ঠানে এখন ফুলের ব্যবহার প্রায় অপরিহার্য। আর তাই চাহিদার সাথে সাথে দেশে ফুল চাষের এলাকা প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে কোলকাতায় বিদেশ থেকে আমদানি করা ফুলের ব্যবসাও বেশ জমজমাট। বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশ থেকে গোলাপের ক্যাপ আমদানি করে দেশে গোলাপ চাষকে উত্সাহিত করা সম্ভব। একই সাথে বিভিন্ন সরকারি নার্সারি ও উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ এ প্রযুক্তি সমপ্রসারণে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে।
সুত্র: বিকাশপিডিয়া টীম, পশ্চিমবঙ্গ
সর্বশেষ সংশোধন করা : 8/14/2019