আউশ, আমন ও বোরো এই তিন মরশুমেই ধান নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে যে রোগগুলি পশ্চিমবঙ্গের জল হাওয়ায় ক্ষতিকারক বলে বিবেচিত, তা হল ঝলসা, বাদামি দাগ বা বাদামি চিটে, খোলা ধস ও পচা, ব্যাক্টেরিয়াজনিত ধসা, ভূষা ও টুংরো রোগ।
মেঘলা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় যখন আপেক্ষিক আর্দ্রতা শতকরা ৯০ ভাগ, রাতের তাপমাত্রা ২৪ সে. বা তারও কম থাকে এবং ঐ সময় যদি রোগ সহনশীল জাতের ধান না থাকে তখনই এই রোগের আক্রমণ দেখা যায় এবং তাড়াতাড়ি বিস্তার লাভ করে।
ধানের পাতায় প্রথমে ছোট ছোট বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। ওই দাগগুলি ক্রমশ বড় হয়ে চোখের মতো বা মাকু আকৃতির হয়, যার মাঝখান ধূসর রঙের এবং দাগের ধার গাঢ় বাদামি রঙের হয়। অনেকগুলো দাগ এক সঙ্গে মিশে গিয়ে বড় দাগে পরিণত হয় এবং ধান গাছের পাতা লালচে বাদামি রঙ ধারণ কর। পরে পুরো পাতাটাই শুকিয়ে যায়। ফুল আসার পরে শিষের নীচের গাঁটে এই রোগের আক্রমণ হলে ওই জায়গাটি কালো হয়ে পচে যায় এবং আক্রান্ত জায়গায় শিষটি ভেঙে যায়। ফলে ধান চিটে হয়ে যায়।
পাশকাঠি ছাড়া থেকে থোড় আসা পর্যন্ত ধান গাছের যদি গড়ে শতকরা ২৫ ভাগ গুছিতে উপর দিক থেকে দ্বিতীয় পাতায় এই রোগের লক্ষণ দেখা যায়, তবেই রোগ প্রতিরোধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই রোগ ধানের চারায়, পাতায় এবং দানাতে হতে পারে। সাধারণত দাগগুলি তিলের আকারের ন্যায় খুবই ছোট, দেখতে বাদামি রঙের, তবে বড় দাগগুলির মধ্য ভাগ একটু ছাই বা কমলা রঙেরও হতে পারে। রোগের আক্রমণ বেশি হলে ধান চিটে হয়ে যায়। রোগাক্রান্ত ধানের ভাত তেতো হয়।
রোয়ার পর থেকে থোড় আসা পর্যন্ত শতকরা ৫টি বা তার বেশি পাশকাঠি চিটে রোগ দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রতিরোধের জ্ন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঝলসা ও বাদামি দাগ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি লিটার জলে নীচের যে কোনও ওষুধ গুলে স্প্রে করতে হবে।
ধানে থোড় আসার সময় এই রোগের আক্রমণ দেখা যায়। শেষ পাতার খোলের উপর ধূসর রঙের বিভিন্ন আকৃতির দাগ দেখা যায়। দাগের চার দিকে বাদামি রঙের দাগ থাকে। রোগের আক্রমণ বেশি হলে অনেক সময় শিষ আংশিক বার হয় বা মোটেই বার হতে পারে না এবং ধান কালো ও চিটে হয়ে যায়। আগস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে শতকরা ৫ ভাগের বেশি আক্রান্ত হলে দমনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মাজরা পোকা ও টুংরো রোগ আক্রান্ত গাছে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। প্রতিরোধী জাত ও কম নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করতে হবে।
খোলা পচা রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য নীচের যে কোনও একটি ওষুধ প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
এই রোগের আক্রমণে ধান গাছের পাতা ডগার দিক থেকে কমলা রঙের হতে শুরু করে কিনারা বরাবর নীচের দিকে নামে এবং শেষ পর্যন্ত পাতাটি শুকিয়ে খড় হয়ে যায়।
চারা অবস্থায় রোয়ার পর পর্যন্ত এই রোগের দ্বারা ধান গাছ আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত ধান গাছের পাশকাঠি এক দিক থেকে মেটে সবুজ রঙের হয়ে শুকিয়ে দড়ি মত হয়ে যায় এবং পুরো গুছিটিই মরে যায়। একে ব্যাক্টেরিয়াজনিত একপেশে রোগ বা ‘ক্রেসেক’ বলে। এ রোগ হলে ওষুধ প্রয়োগ তেমন কাজের হয় না। নাইট্রোজেন সার খেপে খেপে দিতে হয়। জমির অতিরিক্ত জল বার করে দিতে হবে। সিউডোমোনাস ফ্লুওরেসেন্স ব্যাকটেরিয়াল কালচার দ্বারা বীজ শোধন করা দরকার।
ছত্রাকে আক্রান্ত দানা ফেটে কালচে সবুজ বর্ণে পরিণত হয়। শিষ আসার সময় ও তার ৮ – ১০ দিন পর স্প্রে।
এটি একটি ভাইরাস জনিত রোগ। এই রোগের আক্রমণে গাছের পাশকাঠির সংখ্যা কমে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফলে আক্রান্ত গাছ বেঁটে হয়ে যায়। পাতার রং প্রথমে হলুদ ও পরে কমলা হয়ে যায়। আক্রান্ত গাছে ফুল আসতে দেরি হয় এবং শিষ খুবই ছোট হয়। শ্যামা পোকার দ্বারা এই রোগ বিস্তার লাভ করে।
চারা থেকে কাঁচা থোড় অবস্থা পর্যন্ত যদি বিক্ষিপ্ত ভাবে ১০টি গুছির মধ্যে একটি গুছিতে রোগাক্রান্ত গাছ এবং জমিতে বা আশপাশে শ্যামা পোকা দেখা যায় তবেই প্রতিকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
শ্যামা পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি লিটার জলে নীচের যে কোন একটি ওষুধ গুলে স্প্রে করতে হবে।
একরে ৩০০ লিটার ওষুধ গোলা জল ছিটোতে হবে।
চারা রোয়ার পর সপ্তাহে অন্তত: ২ দিন ভাল ভাবে ঘুরে দেখতে হবে পোকা লাগছে কিনা অথবা ক্ষতির কোন চিহ্ন দেখা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি না। সাধারণত আমন ধানের জমিতে মাজরা পোকা, ভেঁপু, বাদামি শোষক পোকা, শ্যামা পোকা, পাতামোড়া, পামরি পোকা, লেদা পোকা, দয়ে পোকা, চুঙ্গী পোকা ও গন্ধী পোকা প্রভৃতির আক্রমণ দেখা যায়।
দেরিতে বোনা বীজতলায় এবং মূল জমিতে ভেঁপু পোকার আক্রমণ দেখা যায়। রোয়ার ২০ দিনের মধ্যে যদি শতকরা ৫টি পেঁয়াজকলি আকারে পাতা আষাঢ় থেকে আশ্বিনের মধ্যে (জুলাই – সেপ্টেম্বর) দেখা যায় তবেই নীচের যে কোনও একটি দানাদার কীটনাশক ওষুধ একর প্রতি জমিতে প্রয়োগ করে ২ ইঞ্চি জল ধরে রাখতে হবে।
যে সব জাতের ধানের সময়কাল ১১০ দিনের বেশি সে সব ধানে মাজরা পোকার আক্রমণ রোয়ার ৩০ দিনের মধ্যে হলে কীটনাশক ওষুধ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। কিন্তু সময়কাল ১১০ দিনের মধ্যে হলে মাজরা পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য কীটনাশক ওষুধ প্রয়োগের প্রয়োজন আছে। আষাঢ়ের মাঝামাঝি থেকে কার্তিকের মাঝামাঝির মধ্যে (জুলাই – অক্টোবর) শতকরা অন্তত ৫টি মাঝের পাতা বা শিষ যদি শুকনো দেখা যায় এবং বন্ধু বোকা যেমন মাকড়সা, লেডি বিটল, লম্বা শুঁড় ঘাস ফড়িং, উরচুঙ্গা, মিরিড বাগ, ওয়াটার বাগ এবং নানা ধরনের পরজীবী বন্ধু পোকা ইত্যাদির উপস্থিতি যদি শত্রু পোকার তুলনায় খুবই কম থাকে, তখনই ভেঁপু পোকা দমনের জন্য যে সব কীটনাশক ওষুধের সুপারিশ আগেই করা হয়েছে তার যে কোনও একটি অথবা নীচের তালিকার যে কোন একটি কীটনাশক ওষুধ প্রতি লিটার জলে গুলে প্রয়োগ করতে হবে। তবে থোড় অবস্থায় কোনও কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন নেই। আলোক ফাঁদ ব্যবহার ও লাইন ছেড়ে রোয়া করা দরকার।
দানাদার কীটনাশক হিসাবে একর প্রতি ১২ কেজি কার্বোফুরান ৩ জি বা ৪ কেজি ফোরেট ১০ জি বা ৭.৫ কেজি ফিপ্রোনিল ০.৩ জি প্রয়োগ করা যায়।
খরিফ খন্দে বাদামি শোষক ও সাদাপিঠ শোষক পোকার আক্রমণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই উপদ্রুত এলাকায় রোয়ার সময় প্রতি ১৫ – ২০ সারির পর একটি করে ফাঁকা রেখে যেতে হবে। নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন করা ছাড়াও ভ্রাদ্রের মাঝামাঝি (সেপ্টেম্বর) থেকে ওই সব পোকার উপস্থিতি লক্ষ রাখতে হবে এবং দানা পুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্থানে অন্তত কমপক্ষে ১৫টি গুছির গোড়ার দিকে লক্ষ্ করলে যদি পর পর ৩টি গুছিতে ১০টির বেশি শোষক পোকা দেখা যায় এবং ওই সময় যদি বন্ধু পোকা যেমন মাকড়সা, লেডি বিটল, ড্যামসেল ফ্লাই, ড্রাগন ফ্লাই, লম্বা শুঁড় ঘাস ফড়িং, উরচুঙ্গা, মিরিড বাগ, ওয়াটার বাগ ও অন্যান্য পরজীবী পোকা ইত্যাদির উপস্থিতি প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকে তা হলে নীচের যে কোনও একটি কীটনাশক প্রতি লিটার জলে গুলে ধান গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।
সাবধানতা হিসাবে ইমিডাক্লোপ্রিড ও থায়ামেথক্সাম প্রয়োগ করা যাবে না।
আষাঢ়ের মাঝামাঝি থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি (জুলাই – সেপ্টেম্বর) এবং রোয়ার ৪০ দিনের মধ্যে যখন প্রতি গুছিতে একটি পূর্ণাঙ্গ কীট বা ১ – ২ ক্ষতিগ্রস্ত পাতা দেখা যাবে এবং একই সঙ্গে বন্ধু পোকা তুলনায় খুবই কম হবে, তখনই কীটনাশক ওষুধ স্প্রে করতে হবে। কেরোসিন ভেজানো দড়ি টানা কার্যকর।
প্রতি গুছিতে ১ – ২টি ক্ষতিগ্রস্ত পাতা যদি আষাঢ় মাস থেকে কার্তিকের মাঝামাঝি (জুলাই – সেপ্টেম্বর) দেখা যায় এবং বন্ধু পোকার উপস্থিত তুলনামূলক ভাবে কম হয়, তখনই কীটনাশক ওষুধ স্প্রে করতে হবে।
যখন গড়ে প্রতি গুছিতে ১ – ২টি সদ্য আক্রান্ত পাতা বা চোঙ্গা দেখা যাবে তখনই নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
পামরি পোকা, পাতা মোড়া পোকা ও লেদা পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য নীচের যে কোনও একটি কীটনাশক প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
ওষুধ প্রয়োগের ৭ – ১০ দিন পরেও যদি ওই পোকার আক্রমণ থেকে যায় তবে দ্বিতীয় ওই একই ওষুধ উপরোক্ত সুপারিশ অনুযায়ী ছিটোতে হবে।
ধানে যখন দুধ আসে তখন এই পোকা পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ দুই অবস্থাতেই ধানের ক্ষতি করে। যদি গড়ে ৫টি গুছির মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ অথবা অপূর্ণাঙ্গ পোকা দেখা যায় তখনই কীটনাশক ওষুধ বেলা ১১টার পর প্রয়োগ করতে হবে।
যদি প্রতি গুছিতে গড়ে ১ – ১১/২ ইঞ্চি আকারের একটি করে শিষ কাটা লেদা পোকার কীড়া দেখা যায় তখনই বিকেলের দিকে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। তবে কার্বারিল-সহ বিষটোপ বেশি কার্যকরী।
গন্ধী পোকা ও শিষ কাটা লেদো পোকা নিয়ন্ত্রণে জন্য নীচের যে কোনও একটি কীটনাশক জলে গুলে স্প্রে করতে হবে। প্রতি লিটার জলে ওষুধের মাত্রা ও নাম নীচে দেওয়া হল।
তবে তরল ওষুধ ছিটোনো অপেক্ষা ডাস্ট প্রয়োগ বেশি কার্যকর।
জৈবিক নিয়ন্ত্রণের মূল হাতিয়ার দু’টি --- মিত্র পোকা ও মিত্র রোগ-জীবাণু।
ধান ক্ষেতে যেমন থাকে অনিষ্টকারী পোকামাকড় অর্থাৎ শত্রু পোকা, তেমনই পাওয়া যায় ওই সব অনিষ্টকারী পোকামাকড়ের প্রাকৃতিক শত্রু। এই প্রাকৃতিক শত্রুরা মাংসাশী। এরা ফসলের অনিষ্টকারী তৃণভোজী শত্রু পোকাকে আক্রমণ করে তাদের খেয়ে ফেলে অথবা তাদের থেকে খাদ্য গ্রহণ করে মেরে ফেলে। ফলে অনিষ্টকারী পোকামাকড়ের সংখ্যা বাড়তে পারে না। ধান ক্ষেতে পোকামাকড় দমানোর ক্ষেত্রে এই প্রাকৃতিক শত্রুরা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে। তাই এদের বন্ধু পোকা বা মিত্র পোকা বলা হয়। যুগ যুগ ধরে এরা ধান ক্ষেতে ঘোরাফেরা করছে। রাসায়নিক কীটনাশক প্রবর্তনের আগে মূলত এরাই ধানের ফসলকে শত্রু পোকার ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করত। ধানের মাঠে এদের বিচরণ খাবারের খোঁজে। ধানের এই বন্ধু পোকারা সংখ্যায় শত্রু পোকার থেকে বহু গুণ বেশি। এরা এসে বসে ধান গাছের ওপরের দিকে। শত্রু পোকারা থাকে গাছের নীচে ভিতরের দিকে। তাই কীটনাশক ছেটালে বন্ধু পোকারা আগে মরে। শিকার মারার ধরনের বিচারে বন্ধু পোকা দু’ ভাগে বিভক্ত : ১)পরভোজী (প্রিডেটর) ২)পরজীবী (প্যারাসিটয়েড)
এরা শত্রু পোকাকে তার জীবনচক্রের যে কোনও দশাতেই খেয়ে ধ্বংস করতে পারে। সারা জীবন ধরে বেঁচে থাকার জন্য এই পরভোজী পোকারা শিকার করে পূর্ণ বয়স্ক পোকা, তাদের কিড়া ও ডিম। এই পরভোজী পোকারা যত দিন বেঁচে থাকে নানান শত্রু পোকার পূর্ণাঙ্গ বা বাচ্চা বা ডিম খেয়ে যায়।
লম্বা শুঁড় ঘাস ফড়িং
আকারে বড়, মুখটা ঝোলানো ও তেরছা ধরনের। ক্ষতিকারক ঘাসফড়িং এর চেয়ে এদের শুঁড় অনেক লম্বা যা দেহের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এরা বেশ ছটফটে এবং একটু নাড়া দিলেই এরা উড়ে পালায়। রাত্রিবেলায় এরা বেশি তত্পর হয়। সবুজ এবং হরিদ্রাভ সবুজ রঙের হয়। এরা মাজরা পোকা ও গান্ধী পোকার ডিম এবং বাদামি শোষক পাকা ও শ্যামা পোকার বাচ্চা বা নিম্ফ শিকার করে খায়। একটা লম্বা শুঁড় ঘাসফড়িং ৩ – ৪টা মাজরা পোকার ডিমের গাদা দৈনিক খায়।
ড্যামসেল ফড়িং ও ড্রাগন ফড়িং
ড্যামসেল ফড়িংকে সুন্দরী ফড়িংও বলা হয়। এদের পাখনা গুলো খুবই সরু, ফলে খুব বেশি উড়তে পারে না। অন্য দিকে ড্রাগন ফড়িংয়ের পাখনা বেশ চওড়া ও মজবুত হয় ফলে এরা অনেক বেশি উড়তে পারে। এরা বিভিন্ন ধরনের শোষক পোকা শিকার করে খায়।
মাকড়সা
এদেরকেও সকেলই চেনে। অনেক ধরনের মাকড়সা দেখা যায়। কিছু মাকড়সা আকারে বেশ বড় আবার অনেক মাকড়সা আছে যারা আকারে বেশ ছোট। এদের মধ্যে অনেকেই জাল তৈরি করতে পারে আবার অনেকে পাতা বা গাছের আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকে। এদের শরীরের গঠন বা আকৃতি ও কর্মতত্পরতা অনুযায়ী নামকরণ হয়েছে। যেমন নেকড়ে মাকড়সা, সিংকস মাকড়সা, লাফানো মাকড়সা, বেঁটে মাকড়সা, জাল মাকড়সা ও লম্বামুখী মাকড়সা। এদের দেহের রঙও ভিন্ন রকমের হয়। জাল মাকড়সারা সাধারণত অলস প্রকৃতির। বাকিরা সবাই শিকারের পিছনে তাড়া করে। এরা বিভিন্ন শত্রু পোকাকে পূর্ণাঙ্গ বা অপূর্ণাঙ্গ অবস্থায় ধরে শিকার করে। এরা প্রথমে পোকাকে ধরে এবং পোকার শরীরে শুঁড় ঢুকিয়ে এক ধরনের বিষাক্ত রস দেহের মধ্যে মিশিয়ে অবশ করে দেয়। তার পর শত্রু পোকার দেহের অংশকে তরলে রূপান্তরিত করে তরল পদার্থকে চুষে খায় শুধুমাত্র শত্রুপোকার খোলসটুকু বাইরে থেকে পড়ে থাকে। এরা গড়ে দৈনিক ৭ – ১০টি শোষক পাকা এবং ৪ – ৫টি মথ খেয়ে থাকে।
লেডি বার্ড বিটল
ডিম্বাকৃতি উজ্জ্বল লাল রঙের, কখনও গায়ে কালো দাগ যুক্ত এই পোকা ধান গাছের উপরের দিকে থাকে। দিনের বেলায় এরা বেশ কর্মতত্পর হয়। ধীরে চলমান শিকার শত্রু পোকা বা ডিমের গাদা খেয়ে ধ্বংস করে। বাদামি গাছ ফড়িং এবং শোষক পোকাও এরা ধরে খায়। এই বিটল-এর অপূর্ণাঙ্গ অবস্থা বা নিম্ফ বা বাচ্চারা পূর্ণাঙ্গ বিটলের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ পোকা খায় এবং দৈনিক ৫ – ১০টা শত্রু পোকা বা তাদের (শত্রু পোকাদের) ডিম ধরে খায়। অনেক এলাকায় এই বিটলদের টিপ পোকাও বলা হয়।
গ্রাউন্ড বিটল
এদের পূর্ণাঙ্গ বিটল লালচে তামাটে রঙের। নিম্ফ বা অপূর্ণাঙ্গ বিটল উজ্জ্বল কালো রঙের হয়। এদের শরীর বেশ শক্ত। একটা গ্রাউন্ড বিটল দৈনিক ৩ – ৫টি পাতামোড়া পোকার কিড়া বা শুককীট খায়। এরা বাদামি শোষক পাকা ও সাদা পিঠযুক্ত শোষক পোকা এবং এদের ডিমও খায়।
ওয়াটার ট্রিডার
এরা আকারে ওয়াটার বাগের চেয়ে একটু বড়। এরাও ধানক্ষেতে জমা জলে বাস করে। এরা হালকা সবুজ রঙের হয়। এই ধরনের ওয়াটার ট্রিডার পাখাযুক্ত ও পাখাবিহীন হয়। এরা একাকী শিকার ধরে খায়। যখন মাজরা পোকার কিড়া, শ্যামা পোকা ও বাদামি শোষক পোকা জমির জলে পড়ে যায় তখন এরা এই ক্ষতিকারক পোকাগুলিকে ধরে খায়।
ওয়াটার স্ট্রাইডার
এরা আকারে বেশ বড় এবং লম্বা পায়ের সাহায্যে জলের উপর দ্রুত চলাচল করে। ধানের ক্ষেতে এদের প্রচুর সংখ্যায় দেখা যায়। এরা নিজেদের সম্পর্কে খুবই সজাগ, একটু নাড়াচাড়া হলেই দ্রুত পালায়। এরাও বিভিন্ন ধরনের শোষক পোকা, মথ, মাজরা পোকার কিড়া বা অন্যান্য কিড়া চলাফেরা করার সময় যখন জলের উপর পড়ে যায় তখন এদের ধরে খায়। এরা প্রতি দিন গড়ে ৫ – ১০টা পোকা খায়।
উরচুঙ্গা
কালো ও তামাটে দুই রকমের উরচুঙ্গা দেখা যায়। ধানক্ষেতে এরা মাজরা পোকা, পাতামোড়া পোকা এবং লেদা পোকা ইত্যাদির ডিম এবং বাদামি শোষক পোকা ও শ্যামা পোকার পূর্ণাঙ্গ ও নিম্ফ বা অপূর্ণাঙ্গ পোকাকে শিকার করে খায়।
মিরিড বাগ
পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ (নিম্ফ) বাগ কালো আভাযুক্ত সবুজ রঙের হয়। এরা ধান গাছের পাতার খোলে বা গাছের কাণ্ডে শ্যামা পোকার বা বাদামি শোষক পোকার ডিম খুঁজে বেড়ায় এবং ডিম পেলে এই বাগেরা এদের শুঁড় ঢুকিয়ে ডিম থেকে রস চুষে চুষে খায়। এরা প্রতি দিন গড়ে ৮ – ১০টি ডিম বা ২ – ৫টি শোষক পাকার নিম্ফ বা বাচ্চা খায়। এরা রাত্রের আলোতে এসে পড়ে।
অ্যাসাসিন বাগ
এরা ধূসর রঙের হয়। পিঠে তিনটি সুস্পষ্ট কাঁটা থাকে। ক্ষেতে এদের সংখ্যা কম থাকলেও এরা একাকী শিকার ধরে খায়। শিকারের দেহে শুঁড় বা হুল ঢুকিয়ে বিষাক্ত রস শরীরের মধ্যে মিশিয়ে দিয়ে শিকারকে অবশ করে দেয়। এরা এদের নিজেদের শরীরের তুলনায় বড় শিকারও ধরে থাকে। সাধারণত এরা বিভিন্ন ধরনের মথ ও প্রজাপতি।
ওয়াটার বাগ
আকারে খুবই ছোট। এরা পাখাযুক্ত বা পাখাবিহীন, দুই রকমের হয়। ধানক্ষেতে জমা জলে এদের প্রচুর দেখা যায়। জলের উপরিভাগে এরা বাস করে এবং দলবদ্ধ ভাবে শিকার ধরে খায়। এরা প্রতি দিন ৪ – ৭টা পর্যন্ত শ্যামা পোকা, বাদামি শোষক পোকা বা নরমদেহী পোকা শিকার করে খায়।
ইয়ার উইগ
এরা উজ্জ্বল কালো রঙের হয়। আত্মরক্ষার জন্য এদের দেহের পিছনের দিকে চিমটার মতো অংশ থাকে। এরা ধান গাছের গোড়ায় বাসা বাঁধে। ধান গাছে মাজরা পোকার কিড়ার দ্বারা তৈরি ফুটো দিয়ে ঢুকে মাজরা পোকার কিড়া এরা শিকার হিসাবে ধরে খায়।
লাল পিঁপড়ে
শুকনো ধানক্ষেতের মধ্যে এরা ভিজে ধানক্ষেতের আলে বাসা বাঁধে। এরা কামড়ালে আগুনে পোড়ার মতো জ্বলে বা যন্ত্রণা হয়। এরা সমাজবদ্ধ ভাবে বা দলবদ্ধ ভাবে বাস করে। এরা বাসা থেকে বের হয়ে দূরে গিয়ে শিকার ধরে খায়। ব্ল্যাক বাগের ডিমই এদের প্রধান খাদ্য। অনেক সময় বড় পোকার মথ ও কিড়াকেও সুযোগমত কাবু করে খায়।
বোলতা
বোলতা সকলেই চেনে। আকারে বেশ ছোট এবং নীলাভ আভাযুক্ত সবুজ রঙের হয়। এদের কিড়া শ্যামা পোকা বা বাদামি শোষক পোকার ডিমের গাদা খুঁজে বেড়ায়। এদের কিড়া দৈনিক গড়ে ৫ – ৮টি ডিম খায়।
এরা সাধারণত শত্রু পোকার জীবনের যে কোনও দশাতেই নিজেদের জীবনের ডিম, শুককীট বা কিড়া বা মূককীট বা পুত্তলি দশা অতিক্রম করে এবং শত্রু পোকাকে পরোক্ষভাবে ধ্বংস করে। শত্রু পোকার জীবদ্দশায় এরা নিজেদর জীবনকাল অতিবাহিত করে। পরজীবী বন্ধু পোকা আবার দু’ ভাবে বিভক্ত :
বিভিন্ন প্রকার ডিমের পরজীবি পোকা : বোলতা, টেলিনোমাস, টেটাস্টিকাস, ট্রাইকোগ্রামা, গোনাটোসেরাস, এনাগ্রাস, ওলিগোসেটা, কপিডো সোম্পসিস : এরা সকলেই আকারে খুবই ছোট এবং খালি চোখে এদের দেখা যায় না। এদের স্ত্রী পোকারা মাজরা পোকা ও বিভিন্ন মথের ডিমের মধ্যেই ডিম পাড়ে এবং সেখানেই এদের কিড়া বেড়ে ওঠে। প্রয়োজনে একাধিক ডিমেও এরা জীবন অতিবাহিত করে। এদের অনেকেই শত্রু পোকার ডিমকে প্যারাসিটাইজ করে। ফলে ডিমের সাধারণ রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়। এই সমস্ত আক্রান্ত ডিম থেকে পরবর্তী কালে শত্রু পোকার বাচ্চা বা নিম্ফ বের হয় না। তবে জীবজগতের নিয়ম অনুসারে সব ডিমকে এরা প্যারাসিটাইজ করে না। কিছু রেখে দেয় যাতে করে বন্ধু পোকার পরবর্তী প্রজন্ম আবার খাদ্য বা শিকার পায়।
বিভিন্ন প্রকার কিড়ার পরজীবি পোকা : বোলতা, অ্যামপোসরফা, জ্যান্থোপিমপলা, স্টেনোব্রাকন, ফেনারোটোমা, ট্রাইকোমা, ম্যাকসোমেন্টু কার্ডিওচাইনেস, কোটোসিয়া, পোনাইওজাম, ইলাসমাস, ইটোপ্নোকটিস কারপস, টোসেলুচা স্নেলেইনিয়াস ব্রাকাইমোরিয়া, ওপিয়াস, হ্যাপলোগোনাটোপাস, মোটা মাথা মাছি, স্ট্রেপিসপটেরা ইত্যাদি বন্ধু পোকারা মাজরা পোকার, পাতামোড়া পোকার এবং সাদা মাছির পোকার কিড়ার উপর প্যারাসিটাইজ করে জীবনধারণ করে। অনেকে এই সব কিড়ার ভিতরে ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে নিম্ফ বা বাচ্চা এই সব কিড়ার মধ্যে জীবনধারণ করে বড় হয়। এবং পরবর্তী কালে পূর্ণাঙ্গ হয়ে বের হয়ে আবার জীবনচক্র শুরু করে।
অনেক শত্রু পোকা আবার নানা রকমের রোগ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই রোগ জীবাণুগুলি মূলত ছত্রাক, জীবাণু, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া ও কৃমি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে এই সব গোষ্ঠীভুক্ত রোগ জীবাণুগুলি ধানের জমিতে স্বত:স্ফুর্ত ভাবে দেখা যায় এবং শত্রু পোকার জীবদ্দশায় আক্রমণ করে তাদের মধ্যে মারণ রোগ সৃষ্টি করে মেরে ফেলে। তাই এরা ধান ক্ষেতের মিত্র রোগ জীবাণু হিসাবে পরিচত।
ছত্রাকজনিত মিত্র জীবাণু
ধানের উল্লেখযোগ্য মিত্র ছত্রাক বলতে বোঝায় মিটার থিজিয়াম, বিউভেরিয়া, হিরসুটেলা ও নিমুরিয়া। এই সমস্ত ছত্রাকের অধিকাংশই দেখতে সাদা রঙের হয়। তবে কেউ কেউ কালো বা বাদামি রঙেরও হয়। মিটার থিজিয়াম, হিরসুটেলা জাতীয় ছত্রাকগুলি বাদামি ও সাদা পিঠ শোষক পোকা, শ্যামা পোকা, গান্ধী পোকা ইত্যাদি পোকার পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ অবস্থা বা নিম্ফ বা বাচ্চাকে আক্রমণ করে। বিউভেরিয়া ও নিমুরিয়া অনুরূপ ভাবে মাজরা পোকা, পাতামোড়া পোকা, লোদা পোকা, চুঙ্গি পোকার পূর্ণাঙ্গ ও অপূর্ণাঙ্গ অবস্থা বা নিম্ফ বা বাচ্চাকে আক্রমণ করে। উল্লিখিত ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়ার ফলে শত্রু পোকা মারণ রোগের কবলে পড়ে ও মরে যায়।
ব্যাক্টেরিয়াজনিত মিত্র জীবাণু
ব্যাক্টেরিয়াজনিত মিত্র জীবাণুর মধ্যে অন্যতম ব্যাসিলাম থুরিন জেনসিস। এই ব্যাক্টেরিয়ার কোষে এক ধরনের বিষ প্রোটিন উত্পাদিত হয় যা লেগিডটেরিয়ান গোষ্ঠীর বিভিন্ন শত্রু পোকার যেমন পাতামোড়া পোকা, মাজরা পোকা, লেদা পোকা, চুঙ্গিপোকা ইত্যাদির খাদ্যনালিতে প্রবেশ করলে আক্রান্ত হয়। খাদ্যগ্রহণে অনীহা জন্মায়। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে মারা যায়।
ভাইরাসজনিত মিত্র জীবাণু
ধানের উল্লেখযোগ্য ভাইরাসঘটিত মিত্র জীবাণু নিউক্লিয়ার পলিহাইড্রোসি, ব্যাকুলোভাইরাস, গ্র্যানুলোসিস ইত্যাদি। এই সব ভাইরাস বিভিন্ন ধরনের লেদা পোকাকে আক্রমণ করে। আক্রান্ত লেদা পোকা প্রথমে সাদা ও পরে কালো রঙের হয়ে যায়। লেদা পোকার শরীরে ভাইরাস অনুপ্রবেশের পর লেদা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে ও শেষে মারা যায়। পরবর্তীকালে উপযুক্ত পরিবেশে এই সব মৃত লেদা পোকা থেকে ভাইরাস আবার সুস্থ সবল লেদা পোকায় ছড়িয়ে পড়ে।
মিত্র ক্রিমি
ধানে কয়েক ধরনের উপকারী কৃমির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হেসামারমিস। এই জাতীয় কৃমি ধানের বাদামি শোষক পোকা বা সাদা পিঠ শোষক পাকাকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 3/6/2024