তেলাপিয়া মাছ আমাদের সাধারণের বাজারে ৬০-এর দশকে যখন আমদানি হতে থাকে তখন এই মাছের চাহিদা তেমন ছিল না। নানা রকম অপপ্রচার ছিল (যেমন এই মাছ খেলে বুদ্ধির বাড়বাড়ন্ত হবে না ইত্যাদি)। বাজারে এই মাছের চাহিদা যেমন ছিল না, দামও তেমনই কম ছিল। এর চাষ পদ্ধতি, এর প্রজনন ও খাদ্যভ্যাস চাষির অনুকূলে থাকার কারণে এর চাষ বন্ধ হওয়ার পরিবর্তে বেড়েই চলেছে।
তেলাপিয়া মাছ একটু চওড়া, বেঁটে, বলিষ্ট গঠনের। মাথা বেশ শক্ত ও মোটা। অনেকটা কৈ বা খলসে মাছের আকৃতির মাছ। ৫০ গ্রাম থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের এই মাছ বাজারে আসে ও কেনাবেচা হয়। এই মাছের মাংসে ছিবড়ে ভাব কম থাকায় বেশ নরম। বেশি কাঁটা নেই। মাছ বেশ সুস্বাদু, কিন্তু কারও কারও কাছে বেশ অপছন্দের। ঈষৎ গন্ধ থাকায় রুই, কাতলার মতো কালিয়ার পরিবর্তে ভাজা বা স্বল্প ঝোলওয়ালা তরকারিই মৎস্যভুকের বেশি পছন্দের। আজকাল তেলাপিয়া মাছের চাহিদা বাজারে অন্যান্য সাধারণ মাছের মতোই হয়ে উঠেছে। এই মাছ আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাজারে অন্যান্য মাছের মতো বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় না। এর প্রজনন খুব সহজ। নিজের খামারের জলাশয়ে এদের প্রজননক্রিয়া সম্পন্ন হয়, বংশবৃদ্ধি হয়। তাই সাধারণ চাষিদের অনেকেই এই সুযোগ নিয়ে থাকেন। অবশ্য ভালো ফলন পেতে হলে আঁতুড়-পুকুর, পালন-পুকুর, মজুত-পুকুর একাকার করলে চলবে না। এদের খাদ্যাভ্যাস ও প্রকৃতি সাধারণ বা প্রান্তিক চাষিদের চাষের অনুকূল। এরা বস্তুত আমিষভোজী, কিন্তু যে কোনও খাবার এরা খায়। যে কোন পরিবেশে এরা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারে। বেশ নোংরা জল বা সাধারণ দূষিত জলেও এদের চাষ করা যায়। অনেক সময় জলাশয় পরিষ্কার করা বা দূষণ মুক্ত করার জন্যও এই মাছ চাষ বেশ উপযোগী।
বর্তমানে তেলাপিয়া মাছের চাহিদা বেশ বেড়ে গেছে। এই মাছের কাঁটা কম, নরম মাংস ও জীবন্ত অবস্থায় বাজারে সহজেই পাওয়া যায়। তাই আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে অনেক বাড়িই এই মাছ বেশ পছন্দ করে। এদের রোগ-পোকা প্রতিরোধক্ষমতা বেশি, তাই রোগ-পোকা খুব হয়ও না। তেলাপিয়া মাছ স্বয়ং বংশবিস্তারক। এদের প্রজননের জন্য আলাদা করে কৃত্রিম ব্যবস্থার কোনও ঝুঁকি না নিলেও চলে। কিন্তু এই স্বয়ং বংশবিস্তারের কিছু কুফল আছে তেলাপিয়া মাছ চাষে ভালো উৎপাদন পেতে। মজুত-পুকুরেই এদের প্রজননক্রিয়া সম্পন্ন হলে পুকুরে মাছের সংখ্যা, বয়স, আকৃতি – কোনও কিছুর উপরেই কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে জলাশয় নির্বাচন ও মাছের দেখভাল, খাদ্য প্রয়োগ থেকে শুরু করে মাছ ধরা ও বাজারজাত করা --- সব কিছুতেই একটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এ সবই হয়ে যায় চাষির অজান্তে। তাই যদি একলিঙ্গ তেলাপিয়া মাছ চাষের ব্যবস্থা করা হয়, তা হলে এই চাষ লাভজনক করতে হলে চাষিকে এই অসুবিধাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে।
এই চাষে শুধু স্ত্রী মাছ বা পুরুষ মাছ একক ভাবে চাষ করা হলে তাকে মোনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ বলে। মৎস্যভুকের কাছে পুরুষ তেলাপিয়াই বেশি পছন্দের এবং পুকুরে এই পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণে বেশি সুবিধা। তাই মোনোসেক্স তেলাপিয়া চাষে পুরুষ বাচ্চা পুকুরে ছেড়ে ও পালন ও মজুত করা হয়ে থাকে। সেই জন্য মোনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ বলতে আমরা একক ভাবে শুধু পুরুষ তেলাপিয়া মাছ চাষ বুঝি। এরা সম্পূরক খাদ্যগ্রহণে অভ্যস্ত, এরা প্রতিকুল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। অধিক ঘনত্বেও চাষ করা যায়। এই ভাবে চাষ করলে প্রজননের জন্য পুকুরের পাড়ে গর্ত করে না। চাষিদের মধ্যে এই চাষের প্রবণতা উত্তরোত্তর বাড়ছে।
এই চাষ নির্বাচিত পুরুষ-চারা সংগ্রহ করে করা হয় এবং এরা স্বয়ং প্রজননক্ষম। তাই এই চাষের জন্য সাধারণত দু’ রকম পুকুরের ব্যবস্থা রাখা হয়।
তেলাপিয়া চাষের জন্য পুকুরে জলের গভীরতা কোনও সমস্যা নয়। বেশি গভীর জলাশয়েও এই মাছের চাষ সম্ভব।
তেলাপিয়া মাছ আমিষভোজী। জলাশয়ের জুপ্লাঙ্কটনই এদের বেশি পছন্দের খাবার। বস্তুত এরা সব খাবারই খায়, পচাগলা প্রাণীদেহ থেকে শুরু করে নানা রকম নোংরা খাবার। সেই কারণে পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাবার বাড়াবার উদ্দেশ্যে নিয়মিত চুন ও সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া এদের খাদ্যের চাহিদা পূরণের জন্য পরিপূরক খাবারও পুকুরে প্রয়োগ করা হয়। এই খাবার আমিষসমৃদ্ধ হতে হবে। তাই পরিপূরক খাবারে খৈল, সস্তার মাছের গুঁড়ো, ডাল জাতীয় উপাদান মিশ্রিত থাকে। খামারের নানা বর্জ্য পদার্থ যেমন গৃহপালিতদের বিষ্ঠা, পরিত্যক্ত দানা, ছাগল-মুরগির নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদি।
খাবারের সারণি |
মাছের গড় দৈহিক ওজন (গ্রাম) |
দৈনিক খাদ্যের হার দেহের ওজনের হিসাবে |
দিনে কত বার |
|
১) |
স্টারটার - ১ |
২০ - ৫০ |
৮ – ১০% |
৩ |
২) |
স্টারটার - ২ |
৫০ - ১০০ |
৬ – ৮% |
৩ |
৩) |
স্টারটার - ৩ |
১০০ - ২০০ |
৫ – ৬% |
৩ |
৪) |
স্টারটার - ৪ |
২০০ ও তার ঊর্ধ্বে |
১.৫ – ৪% |
৩ |
সূত্র : মৎস্য বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/22/2020
কেমন এই মাছটি, তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে।