আমাদের দেশে জলাশয়ের অভাব নেই, কিন্তু মাছের চাহিদার তুলনায় জোগানের ঘাটতি আছে। আমাদের দেশের বৈজ্ঞানিক ও চাষিদের মাছ চাষের জ্ঞানেরও খুব ঘাটতি নেই। অভাব আছে সুষ্ঠু ভাবে এগুলির সদ্ব্যবহার করা। আমরা একক মাছ চাষে যথেষ্ট উন্নতি করেছি। তার চেয়েও বেশি উন্নতি হয়েছে মাছের প্রজনন পদ্ধতিকে কাজে লাগানো। তার থেকে ডিম, ধানিপোনা এবং চারাপোনা তৈরিতে। আজ সমগ্র ভারতের মাছের চারার চাহিদার শতকরা ৭৫ ভাগেরও বেশি জোগান দেওয়া হয় এই পশ্চিমবাংলা থেকে। বিভিন্ন রাজ্যে এই চারা (ধানিপোনা, আঙুলে পোনা বা চারাপোনা ) মাছ এই পশ্চিমবঙ্গ থেকেই পাঠানো হয়। অন্য দিকে আমাদের দেশের মাছের চাহিদার জোগান সম্পূর্ণ করার জন্য অন্য রাজ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।
আমাদের জলসম্পদকে আরও ভালো ভাবে কাজে লাগাতে হলে মিশ্র মাছের নিবিড় চাষ পদ্ধতি আমরা অবলম্বন করতে পারি। জলাশয়ের প্রাকৃতিক খাবার, আলোক, তাপ ও জলবায়ু উৎকৃষ্ট ভাবে মাছের উৎপাদনের জন্য কাজে লাগবে এই মিশ্র চাষের ফলে। কারণ বিভিন্ন মাছের গতিবিধি, আচরণ, খাদ্যাভাস ভিন্ন ভিন্ন। এই ভিন্নতাকে মাছের উৎপাদনে কাজে লাগালে আমাদের দেশে মাছের জোগান যথেষ্ট বেড়ে যাবে।
আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা মাছ চাষের উপর বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন এবং আজও করছেন। তাঁদের প্রচেষ্টার বিরাম নেই। পুকুরে বিভিন্ন খাদ্যস্তর বিন্যাসভিত্তিক মাছের নিবিড় মিশ্র চাষ করে তাঁরা যুগান্তকারী সাফল্য লাভ করেছেন। যেখানে সাধারণ পুকুরে বছরে হেক্টর প্রতি ৬০০ কেজি মাছ উৎপন্ন হত আজ সেই পুকুরে দ্রুতবৃদ্ধিশীল এমন কয়েকটি বাছাই করা মাছ সুষম অনুপাতে চাষ করা হয় এবং তাতে প্রয়োজনীয় সার ও পরিপূরক খাদ্য জোগানো হয় যে হেক্টর প্রতি ৩০০০ – ৬০০০ কেজি ফলন সম্ভব হয়েছে।
মাছের নিবিড় মিশ্র চাষে কী কী মাছ লাগে
রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি দেশীয় মিশ্র চাষ আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। এর সঙ্গে উন্নত ধরনের কয়েকটি বিদেশি মাছ মিশিয়ে নিবিড় চাষ করে সুফল পাওয়া গেছে। এদের নাম – সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প এবং সাইপ্রিনাস কার্প বা কমন কার্প। সম্ভব হলে সঙ্গে শিঙি, মাগুর, চিংড়ি (গলদা) ইত্যাদির চাষও করা যায়।
এই নিবিড় মিশ্র চাষের পদ্ধতি কী ?
সবার আগে পুষ্করিণী সংস্কার করা দরকার। চারা মাছ ছাড়ার আগে সমস্ত পুকুর থেকেই অবাঞ্ছিত জলজ উদ্ভিদ এবং আগাছা তুলে ফেলা উচিত। কারণ এরা ক্ষতিকারক। পুকুরে বেশি পাঁক থাকাও ভালো নয়। সম্ভব হলে তা-ও সংস্কার করে নিতে হবে। গোলাকার ও বর্গাকার পুকুরের চেয়ে দীর্ঘ আয়তাকার পুকুর ভাল। পুকুর যাতে বন্যার জলে ভেসে না যায় সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। জলের তলে কিছু কিছু ঝাউঝাঁঝি, কাঁটাঝাঁঝি থাকলে অসুবিধা নেই। ওগুলি গ্রাস কার্পের প্রিয় খাদ্য।
পুকুরে মৎস্যভুক মাছ থাকলে কী ক্ষতি হয় ?
শাল, শোল, বোয়াল প্রভৃতি মৎস্যভুক মাছ, মাছ চাষের খুব ক্ষতি করে। চারাপোনাগুলিকে ওরা খেয়ে ফেলে। তাই ওদের নির্মূল করতে হবে। মহুয়ার খৈল দিয়ে ওদের মেরে ফেলা সম্ভব। মহুয়ার খৈলের বিষক্রিয়ায় ওরা মারা যায় এবং মহুয়ার খৈল পরবর্তী সারের কাজ করে।
কী ভাবে এবং কত পরিমাণে মহুয়ার খৈল দিতে হবে ? এর কোন উপকারিতা আছে কি ?
প্রতি মিটার জলের গভীরতার জন্য হেক্টর প্রতি ২০০০ – ২৫০০ কেজি (২৫০ পি পি এম ) খৈলের প্রয়োজন। এই খৈল পুকুরে ছড়িয়ে দিতে হয়। এই খৈলের বিষক্রিয়া প্রায় ১৫ – ২১ দিন থাকে। তার পরে খৈল সারে রূপান্তরিত হয়ে পুকুরের উর্বরতা বাড়ায়। রোদের দিনে এই খৈল প্রয়োগ করা উচিত।
তার পর কী করতে হবে ?
তার পর পুকুরে সার দিতে হবে।
সার কেন দিতে হয় ?
কৃষিকাজে যেমন সার লাগে মাছ চাষের বেলায়ও তাই। এই সার থেকেই পুকুরে মাছের খাদ্য জন্মে থাকে। এদের আমরা বলি প্লাংকটন। এরা দু’ রকমের হয়ে থাকে, উদ্ভিদকণা আর প্রাণীকণা। মাছেরা এদের খেয়েই বেঁচে থাকে, এদের খেয়েই বাড়ে। এদের ঘাটতি হলে মাছ বাড়ে না এবং উৎপাদনের ক্ষতি হয়। পুকুরে সার প্রয়োগের আগে চুন দেওয়া একান্ত দরকার।
চুন দেওয়ার ক’দিন পরে সার দিতে হয় এবং কী পরিমাণে ?
চুন দেওয়ার ৭ – ১০ দিন আগে সার প্রয়োগ করতে হবে এবং জৈব সার প্রয়োগের ১৫ দিন পর রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। বিঘা প্রতি নিন্মলিখিত হারে সার প্রয়োগ করতে হয় —
সারের নাম |
পরিমাণ ( কি গ্রা : / বিঘা) |
মন্তব্য |
গোবর |
২৬৭ |
প্রাথমিক হার |
গোবর |
১৩৩ |
মাসিক কিস্তিতে |
ইউরিয়া |
৩.৫ |
ওই |
অথবা |
||
অ্যামোনিয়া সালফেট |
৪.০ |
ওই |
অথবা |
||
ক্যালসিয়াম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট |
৪.০ |
ওই |
সিঙ্গল সুপার ফসফেট |
২.৭ |
ওই |
অথবা |
||
ট্রিপল সুপার ফসফেট |
১.০ |
ওই |
মাটির pH- এর পরিমাণ অনুযায়ী নাইট্রোজেন ঘটিত রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়। যেমন
pH পরিমাণ |
পরিমাণ |
৫.৫ – ৬.৫ |
ক্যালসিয়াম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট |
৬.৫ – ৭.৫ |
ইউরিয়া |
৭.৫ – এর বেশি |
অ্যামোনিয়াম সালফেট |
পুকুরে চারা মাছ ছাড়ার পরিমাণ কী ?
হেক্টর পিছু ৫০০০ – ৭৫০০ চারা মাছ পুকুরে ছাড়া যেতে পারে। কাতলা ৫০০, সিলভার কার্প ১০০০, রুই ১৫০০, গ্রাস কার্প ৫০০, সাইপ্রিনাস কার্প ৭৫০ এবং মৃগেল ৭৫০ এই অনুপাতে অথবা বর্ধিত হারে মাছ ছাড়া যেতে পারে। যদি বিদেশি মাছ নাও পাওয়া যায় তবে দেশি রুই, কাতলা, মৃগেল দিয়েও চাষ করা যায়। গলদা চিংড়ি দিয়ে চাষ করতে হলে মৃগেল ও সাইপ্রিনাস কার্প-এর পরিবর্তে ৫০০০ – ১০০০০ সংখ্যায় গলদা চিংড়ি ছাড়তে হয়।
চারা পোনা মাছ কত বড় মাপের ছাড়তে হয় ? কখন চারা মাছ ছাড়া হয় ?
চারা মাছ ১০ – ১৫ সেমি মাপের হলেই ভালো। এর চেয়ে বড় হলেও চলবে। বর্ষার পরই চারা মাছ বাজারে পাওয়া যায়।
পরিপূরক খাদ্য কেন দরকার ?
বৃদ্ধি দ্রুত পেতে হলে পরিপূরক খাদ্য নিত্য জোগান দেওয়া দরকার। সুষম পরিপূরক খাদ্য হিসাবে সরিষা অথবা বাদাম খৈলের গুঁড়ো এবং চালের কুঁড়োই ভালো। এই দু’টি সম পরিমাণে মিশিয়ে রোজ পুকুরে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
কী হারে পরিপূরক খাদ্য দিতে হয় ?
১ হেক্টর (৭১ / ২ বিঘা) জল করে ৫০০০ সংখ্যায় মাছ ছাড়লে খাবার জল দিয়ে মেখে মন্ডাকারে পাত্রে নির্দিষ্ট জায়গায় সকালে জলের বিভিন্ন গভীরতায় পাত্রটিকে ঝুলিয়ে পরিবেশন করতে হয়।
১ মাস |
৪ কিগ্রা দৈনিক |
২য় মাস |
৫ কিগ্রা দৈনিক |
৩য় মাস |
৬ কিগ্রা দৈনিক |
৪র্থ মাস |
৮ কিগ্রা দৈনিক |
৫ম মাস |
১০ কিগ্রা দৈনিক |
৬ষ্ঠ মাস |
১২ কিগ্রা দৈনিক |
৭ম মাস |
১৪ কিগ্রা দৈনিক |
৮ম মাস |
১৬ কিগ্রা দৈনিক |
৯ম মাস |
১৮ কিগ্রা দৈনিক |
১০ম মাস |
২০ কিগ্রা দৈনিক |
১১শ মাস |
২২ কিগ্রা দৈনিক |
১২শ মাস |
২৪ কিগ্রা দৈনিক |
গ্রাস কার্পের জন্য কী খাদ্য দিতে হবে ?
গ্রাস কার্প যদি পুকুরে ছাড়া হয়ে থাকে তবে রোজ কিছুটা কাঁটাঝাঁঝি বা ঝাউঝাঁঝি এবং খুদিপানা বা তেপাতিপানা বা সুজিপানা বা নাকছাবিপানা ওদের খেতে দিতে হবে। পুকুরের এক পাশে দড়ির মাচায় জলে এগুলি দিয়ে রাখতে হবে, খাবার ফুরিয়ে গেলে আবার দিতে হবে। মাঝে মাঝে ২ মাস অন্তর জাল টেনে মাছের বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা ভালো।
কত দিন পর মাছ বিক্রি করা যেতে পারে ?
১০ – ১২ মাস পরে যখন দেখা যাবে সব মাছই বাজারে বিক্রির উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। ওজনে ৭৫০ গ্রাম থেকে ১ কেজি। তখন জাল দিয়ে বা মহুয়া খৈল দিয়ে মাছ মেরে তুলে ফেলাই ভালো। মাছ বেশি বড় করলে দর হয়তো বেশি পাওয়া যায় কিন্তু মোটের উপর লাভ বেশি হয় না। পুকুর আবার পরের বছরের পোনা ছাড়ার জন্যে তৈরি করে ফেলাই ভালো।
সূত্র : মৎস্য বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/25/2020