গরমের পরেই আসছে বর্ষা—মাছের ডিম পাড়ার সময়। মাছ চাষের জন্য এই সময় বিভিন্ন ধরনের ডিমপোনার চাহিদা থাকে। কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশে মাছের ডিম অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়। পরিবহণের সময়ও প্রচুর ডিমপোনা নষ্ট হয়। ফলে চাহিদা মতো মাছের চারা পাওয়া যায় না। কৃত্রিম উপায়ে হ্যাচারিতে প্রজনন (প্রণোদিত প্রজনন) করিয়ে এই সমস্যা কিছুটা মিটেছে এখন। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জোগাতে গিয়ে হ্যাচারি মালিকেরা অনেক সময় অপ্রাপ্তবয়স্ক মাছেদের প্রজনন করায়। ফলে দুর্বল ও অসুস্থ চারা উৎপাদন হয়, চাষিরা লোকসানে পড়েন। এই প্রেক্ষিতে উন্নত পদ্ধতিতে সুস্থ, সবল মাছের চারা তৈরি করার জন্য প্রজননক্ষম মাছের চাহিদা বাড়ছে হ্যাচারিগুলোতে। যে সমস্ত চাষিরা বড় মাছের চাষ করেন, তাঁরা আর একটু পরিচর্যা করে প্রজননক্ষম মাছে পরিণত করতে পারলে আরও বেশি দামে বিক্রি করতে পারবেন হ্যাচারি মালিকদের কাছে। হ্যাচারিগুলো নিজেরাও এখন প্রজননক্ষম মাছ লালন-পালন করছে।
সুস্থ, সবল পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে আলাদা পুকুরে পরিচর্যা করে বেশি ডিম পাওয়া যায়।
এই ধরনের মাছের পরিচর্যা করার পুকুরগুলি আয়তনে ২-৫ বিঘা ও ৩-৭ ফুট গভীর হলে ভাল হয়।
পুকুর শুকিয়ে অথবা মহুয়া খোল (১০০ কেজি/বিঘা) প্রয়োগ করে অবাঞ্ছিত মাছেদের মেরে ফেলতে হবে। তারপর বিঘা প্রতি ১০০০ কেজি গোবর সার বা ৩৫০ কেজি সর্ষের খোল ও তার সাত দিন বাদে বিঘা প্রতি ৩০-৪০ কেজি চুন প্রয়োগ করে পুকুর তৈরি করতে হবে। পুকুরের রং যেন হাল্কা সবুজ বা কচি কলাপাতার মতো হয়।
এবার সুস্থ, সবল পুরুষ ও স্ত্রী মাছ (২-৪ বছর, ওজন ১.৫-৫ কেজি) বিঘা প্রতি ২৫০-৩০০ কেজি হারে মজুত করতে হবে।
প্রতি দিন মাছের মোট ওজনের ২-৩% হারে খাবার দিতে হবে। চালের খুদ, ছোলা দানা, মটর দানা ইত্যাদি মিশিয়ে সিদ্ধ করে দিলে ভাল হয়। সন্ধেবেলা অল্প করে বাদাম খোল জলে ছড়িয়ে দিতে হবে। এছাড়া ধানের গুঁড়ো, সর্ষের খোল বা বাদাম খোল, ছোলা বা ডালের বেসন সমান অনুপাতে মিশিয়ে এবং এর সঙ্গে ৫-১০% শুকনো মাছের গুঁড়ো ও ১% খনিজ লবণ বা ২% সাধারণ লবণ মিশিয়ে খাবার হিসাবে দিতে হবে। যাতে পুকুরে নষ্ট না হয় বা মাছের কোনও ক্ষতি না হয়, সেই হিসাবে খাবারকে জলে ভিজিয়ে মণ্ড করে পাত্রের মধ্যে নির্দিষ্ট জায়গায় ডুবিয়ে রাখতে হবে। এছাড়াও প্রতি মাসে পুকুরে বিঘা প্রতি ১৫০ কেজি গোবর সার বা ৪ কেজি ডিএপি (২ বারে) গোবর জলে গুলে ও ৫ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হবে। এমন ভাবে খাবার দিতে হবে যাতে মাছের প্রজননক্ষমতা হ্রাস না পায় বা বেশি খেয়ে দেহে চর্বি না বাড়ে।
প্রতি ১৫ দিন অন্তর জাল বা হড়রা টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। তবে মাছের পেটে বার বার চাপ দেওয়া চলবে না। ঠিক ভাবে পরিচর্যা করলে এক বিঘা জলাশয়ে ৫-৭ কুইন্ট্যাল প্রজননক্ষম মাছ উৎপাদন করা যাবে এবং একই মাছকে এক বছরে সর্বোচ্চ তিন বার পর্যন্ত প্রজননে ব্যবহার করা যাবে।
সফল প্রজননের জন্য সঠিক প্রজননক্ষম মাছ নির্বাচন একান্ত জরুরি। প্রজননক্ষম পুরুষ মাছ সাধারণত দেখতে কালচে রঙের হয়, পাখনাগুলো খসখসে, মলদ্বারে হাল্কা চাপ দিলে শুক্রাণু বেরিয়ে আসে। প্রজননক্ষম স্ত্রী মাছের পেট ফুলে থাকে। পাখনাগুলো নরম-মসৃন, গায়ের রং উজ্জ্বল এবং মলদ্বারের অংশটি ইষৎ গোলাপী। প্রজননকাল শুরু হওয়ার প্রায় ২-৩ মাস আগে থেকেই মাছেদের পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। পরিবহণের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে মাছের দেহে আঘাত না লাগে।
লেখক: মালদহ কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রের মৎস্যবিজ্ঞানী।
সুত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/14/2019